You dont have javascript enabled! Please enable it!

গভীর ষড়যন্ত্র

পাকিস্তান কর্তৃপক্ষের চোখের সামনে দু-জন বিমানদস্যু যেভাবে ছিনতাই করা ভারতীয় যাত্রী বিমানটিকে অনায়াসে ভস্মীভূত করার সুযােগ পেল তা সত্যি বিস্ময়কর। বিমানঘাঁটিতে সৈন্যসামন্তও এল; সবাই নীরব দর্শক হয়ে এ দৃশ্য দেখল; এই দুষ্কর্ম থেকে দু-জন দুবৃত্তকে প্রতিনিবৃত্ত করার সাধ্য কারাে হলাে না এও বিশ্বাস করতে হবে? ছিনতাইকারী দস্যু-দুজন কি এমনই অজেয় পুরুষ যে তিন দিনের মধ্যে তাদের পাকড়াও করে বিমান থেকে নামিয়ে আনতে পাকিস্তানের জাঁদরেল জঙ্গী শাসক ইয়াহিয়া খানের সমস্ত শক্তি ব্যর্থ হলাে। দু একটা গ্রেনেড ও আগ্নেয়াস্ত্রের কি এতই শক্তি? বিমান ছিনতাই ও তা ভস্মীভূত করা আন্তর্জাতিক অপরাধ। একটি রাষ্ট্রীয় শক্তি সেই অপরাধ অনুষ্ঠানে এভাবে প্রশ্রয় দিতে পারে ও অপরাধীদের জামাই আদরে ঠাই দিতে সাহসী হয় ভাবতেও অবাক লাগে। এই দুষ্কর্মের নিন্দা বা এর জন্য কোনরূপ দুঃখ প্রকাশ করা তাে দূরের কথা, পাক কর্তৃপক্ষ এ দু-জনকে “দেশ প্রেমিক” আখ্যা দিয়ে বীরের মর্যাদা দিয়েছেন।
এ থেকেই নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয় যে এর পেছনে একটা গভীর ষড়যন্ত্র রয়েছে। ভারতীয় বিমানটি অবতরণ করার অব্যবহিত পরেই পাকিস্তানের বেতারে খবরটি সানন্দে প্রচারিত হয়। সানন্দে বলছি এই কারণে যে, এজন্য বেতার ঘােষণায় লেশমাত্র লজ্জা বা দুঃখের আভাসও ছিল না। বেতার ঘােষণার সঙ্গে সঙ্গে বিমানদস্যুদের সমর্থক দলে দলে বিমানঘাঁটিতে এসে ভিড় করে ও দুবৃত্ত দু-জনকে অভিনন্দন জানাতে থাকে। তাদেরই মারফত তারা তাদের দাবি জানায় যে তথাকথিত কাশ্মীর জাতীয় মুক্তিফ্রন্টের ধৃত ৩৬ জনকে অবিলম্বে মুক্তি না দিলে তারা বিমান থেকে তাে নামবেই না, অধিকন্ত এই চরম দাবি অগ্রাহ্য হলে বিমানটিকে ধ্বংস করা হবে। পাক কর্তৃপক্ষ নির্বিকার চিত্তে এই পূর্ণ নাটকটি উপভােগ করলেন ও বিমান বিনাশের দ্বারা নাটকের উপসংহার টানতে দিলেন।
কিন্তু এ নাটকের কি এখানেই শেষ? আমাদের মনে হয় এটি একটি গর্ভীঙ্ক মাত্র। এর সুত্রধার পাকিস্তানের জঙ্গী জোট। গত সাধারণ নির্বাচনে পাকিস্তানের জনগণের অভূতপূর্ব সাফল্য দেখে প্রতিক্রিয়াশীল গােষ্ঠী ও সামরিক চক্র অত্যন্ত শঙ্কিত হয়ে পড়েছে সেই বিজয়কে ধুলিসাৎ করবার জন্যই এই জঘন্য চক্রান্ত। এর সঙ্গে যে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের প্রশাসন যন্ত্রটির যােগসাজস আছে এ বিষয়ে এখন আর সন্দেহ করার কোন কারণ নেই। এর পেছনে সাম্রাজ্যবাদী বিদেশী শক্তির মদত থাকাও খুবই স্বাভাবিক। পাকিস্তানে জঙ্গীশাহীকে টিকিয়ে রাখাই যে এই চক্রান্তের লক্ষ্য আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবর রহমানও তা স্পষ্ট ভাষায়ই ব্যক্ত করেছেন। এই দস্যুবৃত্তির তীব্র নিন্দা করে তিনি বলেছেন যে, এ সম্বন্ধে তদন্ত ও অপরাধীদের কঠোর সাজা হওয়া দরকার। কিন্তু তদন্ত করবে কে? সে সর্ষে দিয়ে ভূত তাড়ানাে হবে সেই সর্ষেই যে ভূত। সাজা দেয়া তাে দূরের কথা, বিমান দস্যুদ্বয়কে নির্বিঘ্নে বিমানঘাটি থেকে সাদরে নিয়ে গিয়ে পাক সরকার তাদের নিরাপদ আশ্রয় দিয়েছেন।
পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনের পর ভারতের লােকসভার অন্তবর্তী নির্বাচন আসন্ন। এই অন্তবর্তী নির্বাচনে বামপন্থী ও গণতান্ত্রিক শক্তি বৃদ্ধি পাবে সন্দেহ নেই। তার ফলশ্রুতি দাঁড়াবে দু’ রাষ্ট্রের সাধারণ মানুষের ঘনিষ্ঠতর হওয়া। এমন একটা সম্ভাবনা দেখে প্রতিক্রিয়াশীল গােষ্ঠী ও সামরিক চক্র বিচলিত না হয়ে পারে না, আর এ অবস্থায় সাম্রাজ্যবাদী শক্তিই বা নিচেষ্ট থাকে কেমন করে। গণতন্ত্রবিরােধী জঙ্গী প্রশাসকরা সর্বদাই সাম্রাজ্যবাদীদের হাতের পুতুল হয়ে থাকেন। এ ক্ষেত্রেও তেমনি পাক শাসকরা হয়তাে বিদেশী শক্তির ক্রীড়নক হয়েই এমন একটা প্ররােচনার পথে পা দিয়েছেন। তা না হলে এমন দুষ্কর্মের নির্লজ্জ সমর্থক হওয়া কারাে পক্ষে সম্ভব নয়।
পাক সরকারের এবাম্বধ আচরণে আমরা স্তম্ভিত। ভারত সরকার বিমানযাত্রীদের তেজসপত্র, ডাক ও অন্যান্য মাল এবং ভষ্মীভূত বিমানের জন্য ক্ষতিপূরণ দাবি করেছেন পাক সরকারের কাছে। যাত্রীদের হয়রানির খেসারত চাওয়া হয়েছে। কিন্তু ইয়াহিয়া খানের সরকারের মতিগতি এ যাবত যেরূপ দেখা গেছে তাতে এর কি জবাব মিলবে বলা যায় না। ভারতের ওপর দিয়ে পাকিস্তানের সামরিক ও বেসামরিক বিমান চলাচল নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন ভারত সরকার আর পাকিস্তানের ওপর দিয়ে ভারতের যেসব বিমান যাতায়াত করতাে সেগুলাের আকাশপথ পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত করেছেন। যে রাষ্ট্রের কর্ণধারেরা দুশমনদের সহায়ক সে রাষ্ট্র সম্পর্কে এই ব্যবস্থা অবলম্বন করা ছাড়া উপায় ছিল না-ভারত সরকারের। এতেও পাকিস্তানের বর্তমান শাসকদের চৈতন্যদয় হবে কি-না জানি না। অবস্থাকে আর গড়াতে না দিয়ে তাদের উচিত অবিলম্বে অপরাধী দুজনকে ভারত সরকারের হাতে সমপর্ণ করা এবং এই দুষ্কর্মের জন্য দুঃখ প্রকাশ করে যথােপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেয়া। কিন্তু তেমন সুবুদ্ধি তাদের হবে মনে হয় না। দিল্লীতে পাক হাই কমিশনের কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করায় পাক হাই কমিশনার চোখ রাঙিয়ে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছেন এবং শাসিয়েছেন যে এরূপ বিক্ষোভ প্রদর্শন চলতে থাকলে তার পরিণাম ভালাে হবে না। কিন্তু তারই কার্যালয়ের কর্মীরা যে ইটপাটকেল ছুড়ে বিক্ষোভকারী ও কর্তব্যরত পুলিসদের এক ডজন লােককে জখম জবাব দেবে কে? কাশ্মীরবাসী মুসলমানদের যারা পাকিস্তানের খাস তালুকের প্রজা বলে মনে ক থােতা মুখ ভোতা করে দিয়েছেন বােরখাপরা ভারতীয় মুসলিম রমণীরা পাকিস্তানের হাই কমিশনের সামনে বিক্ষোভ জানিয়ে।
যারা এই দুরভিসন্ধির মুলাধার তাদের শ্যেনদৃষ্টি সুদুর প্রসারিত। এই বিমান দস্যুতাকে সূত্র করে ও সাম্প্রদায়িকতাবাদীরা চাঙ্গা হয়ে আসন্ন মধ্যবর্তী নির্বাচনের মুখে দাঙ্গাহাঙ্গামা বাধিয়ে দিতে পারে এমন অসদুদ্দেশ্যও হয়তাে আছে। এ সম্বন্ধে আমাদের হুঁশিয়ার থাকা উচিত। এর শিকার হলে শত্রুর উদ্দেশ্যই সাধিত হবে। পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের সমর্থন এই ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে থাকতে পারে না; কারণ এতে তাদের কোনাে স্বার্থ নেই। বর্তমান শাসক চক্রের মুখােস খুলে দিয়ে পাকিস্তানের জনসাধারণই এর প্রতিবিধান করবে। তেমন সামর্থ্য তারা গত সাধারণ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে অর্জন করেছে।

সূত্র: কালান্তর, ৫.২.১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!