ঢাকা মুক্ত
(বিশেষ প্রতিনিধি)
শেষ পর্যন্ত আত্মসমর্পণ। বিনা শর্তে। বাঙলাদেশ পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর সবচেয়ে বড় ঘাঁটি ঢাকা আজ মুক্ত। পরাজয়ের একেবারে মুখােমুখি দাঁড়িয়েও পাকিস্তানি সেনানায়ক পঁাচ খেলবার চেষ্টা করেছিলেন। জেনারেল নিয়াজি চতুর্কিক থেকে ভারতীয়বাহিনী ও মুক্তিফৌজের আক্রমণের সম্মুখীন হয়ে প্রস্তাব পাঠালেন যুদ্ধবিরতি হােক। জবাব দিলেন, জিনারেল মানেকশ, যুদ্ধবিরতি নয়, আত্মসমর্পণ করতে হবে।
বুধবার বিকেল ৫টা থেকে বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা পর্যন্ত ঢাকার উপর আমাদের বিমান আক্রমণ বন্ধ রইল আত্মসমর্পণের সুযােগ দেবার জন্যে। এ সুযােগ গ্রহণ না করার বিকল্প ছিল—প্রচণ্ড লড়াই। অর্থাৎ ঢাকার দখলদার বাহিনীকে নিশ্চহ্ন হতে হতাে সেক্ষেত্রে।
শেষ পর্যন্ত নিয়াজির সুবুদ্ধি হলাে। মার্কিন সপ্তম নৌবহরের সাহায্যের আশায় বসে থেকে লাভ নেই। খবর পাঠালেন আমাদের সেনাদের আত্মসমর্পণের শর্ত নিয়ে আলােচনার জন্যে। লে. জেনারেল আবারাে পাঠালেন চীফ অফ আর্মি স্টাফ ইস্টার্ন কামণ্ড মেজর জেনারেল জেকবকে। মেজর জেনারেল জেকব গিয়ে জানালেন, একটাই শর্ত আছে বিনা শর্তে আত্মসমপর্ণ চাই। তাই হলাে।
এখন বাঙলাদেশের রাজধানী ঢাকা মুক্ত। কার্যত মুক্ত গােটা বাংলাদেশ। মুজিবের স্বপ্ন, সাড়ে সাত কোটি বাঙালির স্বপ্ন আজ সফল, সার্থক। ধূলিসাৎ হয়ে গেছে অত্যাচারী বর্বর পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক চক্রের জুলুমশাহীর দুর্গ। স্বাধীন বাঙলাদেশের মুক্ত আকাশে আজ মুক্তির নিশ্বাস নিচ্ছে স্বাধীন মানুষের দল। সার্থক আজ শত-সহস্র শহিদের রক্তদান ! জয় বাঙলা ! জয় হিন্দ ! কোন ক্ষতি করতে দেওয়া হয়নি। চল্লিশটিরও বেশি পাক-টুপ বিনষ্ট করে দেওয়া হয়েছে, একজন মেজর মারা গেছেন এবং প্রভূত পরিমণ পাক-অস্ত্রশস্ত্র আমাদের হাতে এসেছে। ভারতীয়বাহিনীর পজিশন, নির্ধারিত ম্যাপটি পর্যন্ত, পাকিবাহিনী ক্যান্টনমেন্টের দেওয়াল থেকে খুলে নিয়ে যাবার সময় পায়নি। ফলে, তারা যে আগে থেকেই চলে গিয়েছিল সে রটনা ঠিক নয়। সেকটর কমাণ্ডার কর্নেল পি. এস. দেশপাণ্ডের মতে, আমাদের বাহিনী বয়ড়া, গরিবপুর, মাশিলা, চৌগাছা ইত্যাদি সবগুলাে কেন্দ্র দিয়েই যে এখানে আক্রমণ করবে একথা পাকিবাহিনী আগে থেকে কল্পনাই করেনি। গরিবপুরে তারা অবশ্য লড়েছিল, কিন্তু নিশ্চিহ্ন হয়ে তাদের পরবর্তী বাধা এসেছিল আফরায়। সেখানকার রাস্তায় তারা ট্যাঙ্ক-বিধ্বংসী মাইন পেতে রেখেছিল কিন্তু আমাদের বাহিনী সে রাস্তা এড়িয়ে পরবর্তী বড় ঘাঁটি দুর্গাবড়কাটিতে আক্রমণ চালিয়ে তাদের উচ্ছেদ করে দেয়।
আমাদের বাহিনী ৭ ডিসেম্বর যশােহরের বিমান ঘাঁটিতে হঠাৎ আক্রমণ শুরু করে দেয়, ফলে দিশাহারা পাকিসৈন্য পালাবার পথ না পেয়ে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। পাকিস্তানিরা নিজেদের নির্মিত উপকরণাদির দ্বারা নিজেরাই বিনষ্ট হলাে। ফলে জীবিতদের পক্ষে পালানাে ছাড়া আর কোন উপায়ই রইল । তাদের একটি গেল দক্ষিণে খুলনার, দিকে অন্যটি পালাল ঝিনাইদহ এখন ভারতীয় বাহিনীর দখলে। ঢাকায় যাবার এই রাস্তাটি এখন কেটে দেওয়া হয়েছে। প্রশ্ন উঠতে পারে, খুলনার দিকে যাবার রাস্তাটি কেটে দেওয়া হয়নি কেন। কর্নেল দেশপাণ্ডে এবং অন্য আরাে অনেকের মতে, এটি হচ্ছে শত্রুবাহিনীকে আত্মসমর্পণের সুযােগ দেওয়া, রক্তক্ষয় যথাসম্ভব কমানাে। পাকিবাহিনীর সঙ্গে বেশকিছু বেসামরিক ব্যক্তিও আছেন। এইরকম সামরিক, বেসামরিক মিলেয়ে এক হাজারটি পরিবারকে যশােহরে রাখা হয়েছে। আশ্বাস দেওয়া হয়েছে, এদের কোনােমতেই হত্যা করা হবে না। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, খুলনায় পালিয়ে গিয়ে এইসব সৈনিকরা কী করতে চায়। তাদের তাে পালাবার কোন রাস্তা নেই, ভারতীয় বাহিনী সব অবরুদ্ধ করে গিয়েছে। আত্মসমর্পণ না করলে মৃত্যু। পাক-সৈন্যদের কাছে এটা যেমন পরিষ্কার হুঁশিয়ারি, তেমনি সাধারণ মানুষেরাও এই যুদ্ধে দুঃখজনকভাবে মারা পড়বেন হয়তাে। পাক জঙ্গীশাহী তা উপলব্ধি করে আত্মসমর্পণ করাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। কর্নেল বুদ্ধিমানের কাজ হবে। কর্নেল দেশপাণ্ডের মতে, পাকিস্তানিরা তাদের আত্মবিশ্বাস সম্পূর্ণ হারিয়ে ফেলেছে—তাই পলায়নই শ্রেয়তর। ভারতীয় বাহিনী মৃত পাক-সৈন্যদের কবর দেবার ব্যবস্থা করছেন দ্রুত, এটা যথাযথভাবে সৈনিকদের প্রতি সৈনিকদের মর্যাদা প্রদর্শন। তবে কর্নেল দেশপাণ্ডের মতে, পাকিস্তানি সৈনিকরা বীর যােদ্ধা কিনা তা বলা যায় না। তবে তারা ব্রিজ, বাড়ি, রাস্তাঘাট এসব উড়িয়ে দেবার ব্যাপারে খুব ওস্তাদ।
ভারতীয় সীমানায় পাক-ফৌজ বেনাপােল থেকে সুরু করে নাভারণ পর্যন্ত যশােহর যাবার পথে ম্যাজিনাে লাইনের মতন দুটি পরিপূর্ণ তিন মাইল দীর্ঘ প্রতিরােধ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল। আবার গড়ে তুলেছিল
সূত্র: সপ্তাহ, ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১