সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ
পূর্ব-পাকিস্তানে সামরিক কর্তৃপক্ষের চরম হুমকির বিরুদ্ধে প্রচণ্ড রাজনৈতিক বিস্ফোরণ সারা পাকিস্তানকে তােলপাড় করে তুলেছে। সামরিক সংস্থার কর্মচারীদের বিরুদ্ধে ইয়াহিয়া খানের হুমকি উত্তপ্ত বারুদে অগ্নিসংযোেগ করেছে। সেই আগুনের লেলিহান জিহ্বা সামরিক শাসনকে চতুর্দিকে বেষ্টিত করে একেবারে পঙ্গু করে দিচ্ছে।
আওয়ামী লীগের নেতা জনাব মুজিবর রহমানের উদ্দীপ্ত আহ্বানে পূর্ব-পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ বিদ্রোহ ঘােষণা করেছে। সামরিক শাসনের হুকুম অগ্রাহ্য করার জন্য জনাব মুজিবর আহ্বান জানিয়েছেন।
পাকিস্তানের সামরিক হুকুমের বিরুদ্ধে অসহযােগ আন্দোলন অব্যাহত, স্কুল-কলেজ, সরকারী ও আধা সরকারী অফিস, আদালত সবই বন্ধ। সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে দীর্ঘকালের পুঞ্জীভূত বিক্ষোভ জাতীয় পরিষদকে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেওয়ার ঘৃণ্য চক্রান্ত এবং নির্বিচারে গণহত্যার বিরুদ্ধে অবশ্যম্ভাবী পরিণতি যা হওয়া স্বাভাবিক তাই হয়েছে। এই বিদ্রোহ কোন একশ্রেণীর মানুষের বিদ্রোহ নয়, সারা পূর্ববাংলার জাতীয় বিদ্রোহ। বাঙলার ভাষার উপর আক্রমণ থেকে শুরু করে গণতন্ত্র নিধনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ আজ বিদ্রোহে পরিণত হয়েছে।
জনাব মুজিবর রহমান পূর্ব-পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতা স্ব-হস্তে গ্রহণ করে ঘােষণা করেছেন যে, এই পথ হল জনগণের মুক্তির পথ। সামরিক শাসনকে প্রতিরােধ করার সবরকম সম্ভাব্য ব্যবস্থাই তিনি অবলম্বন করেছেন। পুলিসই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করবে। জাগ্রত জনসাধারণের উপর আস্থা এবং তাদের প্রতিরােধ ক্ষমতার উপর প্রগাঢ় বিশ্বাসেরই উপর দৃঢ়ভাবে নির্ভর করে সামরিক দুঃশাসনের বিরুদ্ধে তিনি জনগণকে নির্ভীক সংগ্রামের আহ্বান জানিয়েছেন। জনসাধারণও সেই আহ্বানে বিপুল সাড়া দিয়ে সামরিক শাসনকে অচল করে দিয়েছে এবং তাকে একটা কাগজের বাঘে পরিণত করেছে। জনাব রহমান অস্ত্র ধারণ করেননি; জনগণই তার শক্তির উৎস। সেই শক্তি নিয়ে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের জয়যাত্রা শুরু করেছেন।
জনতা অমর, গণতন্ত্রের মৃত্যু নেই, ইতিহাসের চাকা পেছনের দিকে ঘােরে না কিন্তু সামরিক শাসনের বিলােপ আছে, মৃত্যু ও আছে। গণতন্ত্রের দুর্বার অভিযানে সেই মৃত্যু যন্ত্রণা শুরু হয়েছে পূর্ব-পাকিস্তানের বুকে। পূর্ব পাকিস্তানে যে আগুন জ্বলেছে সেই আগুন নির্বাপিত হবে সামরিক শাসনের মৃত্যুতে এবং গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠায়। নতুবা সেই আগুন পশ্চিম পাকিস্তানকেও গ্রাস করবে।
জনাব মুজিবর রহমান পূর্ব-পাকিস্তানের শাসনকার্য পরিচালনার জন্য ৩৫ দফা কর্মসূচী ঘােষণা করেছেন। সেই কর্মসূচী এখনও আমাদের কাছে এসে না পৌছালেও একথা আমরা বলতে পারি যে, সারা পাকিস্তানে আজ দ্বৈত-শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। একদিকে গণতান্ত্রিক শক্তির সম্মিলিত শাসন, আর অন্যদিকে সামরিক শাসন। অন্য দেশে বসে পাকিস্তানের রাজনৈতিক সঙ্কটের গভীরতা পরিমাপ করা কঠিন। একথা নিশ্চয়ই বলা চলে যে, সামরিক শাসনের পশ্চাৎ অপসারণ অবশ্যম্ভাবী।
পূর্ব-পাকিস্তানের ঘটনাবলী প্রত্যক্ষ করে সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তকারীরা বিশেষত ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বিচলিত হবে বৈকি। ভারতীয় বিমান ছিনতাই করে ও তাকে ধ্বংস করে পাক-ভারত বিরােধের নতুন উপাদান সৃষ্টি করেও গণতন্ত্রের প্রবল স্রোতের গরিরােধ করা সম্ভব হয়নি। রাজনৈতিক কূটবুদ্ধি ব্যর্থ হয়েছে, ইয়াহিয়ার ক্রীড়নক ভুট্টোর ভেদপন্থা চূর্ণ হয়েছে এবং সামরিক শাসনের নাভিশ্বাস উঠছে। গণতন্ত্রের জয় হবেই। আমরা আবার বলি, জাগ্রত জনতার মৃত্যু নেই। গণতন্ত্রের জয়যাত্রাকে স্তব্ধ করার ক্ষমতা কারও নেই। পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের জয় হবেই। ধন্য পূর্ব-পাকিস্তান, তােমাকে প্রণাম জানাই। আমরাও তােমাদের সাথে আছি।
সূত্র: কালান্তর, ১০.৩.১৯৭১