You dont have javascript enabled! Please enable it!

অপারেশন চান্দিনা

ডিসেম্বর, ১৯৭১

স্থান কুমিল্লার চান্দিনা। মিত্র বাহিনী যোগ দেওয়ায় পাকিস্তানী মিলিটারিরা তখন দিশেহারা। চাঁদপুর থেকে মিলিটারির বিশাল এক ব্যাটালিয়ন কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে মার্চ করে ফিরছিল। খবর পেয়েছে স্থানীয় মুক্তিবাহিনীরা। তাদের সৈন্য শ’খানেকের মতো। বিভিন্ন অঞ্চলের ৩০০ জন মুক্তিযোদ্ধা যোগ দিল তাদের সাথে। লক্ষ্য, মিলিটারি ব্যাটালিয়ন উড়িয়ে দেওয়া।

মিলিটারিরা রসদে ভরপুর। সবার কাছে চাইনিজ রাইফেল, মেশিনগান। সাথে পাকিস্তানী কোয়ালিফাইড আর্মি। মুক্তিযোদ্ধারা দায়সারা ট্রেনিং প্রাপ্ত। আবার সবার কাছেই রাইফেল নেই। বুলেটের বেশ অভাব, কিন্তু অভাব নেই দেশপ্রেমের।

৯ ডিসেম্বর, বিকেল ৪টা।

মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার হিরণের নির্দেশে সবাই ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে পজিশন নিলো। বিশাল খেত, চাষের অভাবে বড় বড় ঘাস জন্মে আছে। ২-৪টা গ্রামের সমান জায়গা। পুরো জমিন চারিদিকে ঘিরে মুক্তিযোদ্ধাদের দল পজিশন নিলো। খবর পেল মিলিটারিরা এখন তাদের ঘেরাও করা পজিশনের মাঝে চলে এসেছে, অর্থাৎ মিলিটারি ক্যাপচার্ড!

মুক্তিযোদ্ধাদের রসদ কম। তাদের লক্ষ ছিল মিলিটারিদের রসদে টান ফেলে সারেন্ডার করানো। এছাড়া সাড়ে তিনশো মুক্তিবাহিনী নিয়ে এক ব্যাটালিয়ন কোয়ালিফাইড মিলিটারির সাথে সম্মুখ যুদ্ধে পেরে ওঠা কঠিন।

কথামতো কাজ চলল। মুক্তিযোদ্ধারা হঠাৎ হঠাৎ ২-১টা ফায়ার করছিল, মিলিটারিরা পাল্টা জবাবে হাজার হাজার বুলেট ছুড়ছিল। ব্যাটালিয়নের চারিপাশ থেকে গোলাগুলির আওয়াজ। তাদের কোন পথ খোলা নেই। তখন ক্যান্টনমেন্ট মাত্র দেড় মাইলের দূরত্বে ছিল।

সারা রাত ক্ষণে ক্ষণে ফায়ার চলছিল। পাল্টা জবাব দিচ্ছিল মিলিটারীরাও। তবে তাদের ফায়ারের মাত্রা ছিল বেশি। মিলিটারিরা ভয় পেয়ে গেল। তারাও এক ব্যাটালিয়ন মুক্তিবাহিনী ভেবেছিল। তাই এগিয়ে যুদ্ধ করতে সাহস পাচ্ছিল না। মাঝে মাঝে মুক্তিযোদ্ধারা গ্রেনেডের বিস্ফোরণ ঘটাচ্ছিল।

পরদিন সকালেও যুদ্ধ চলছে। ইতোমধ্যে গ্রামবাসীদের কেউ কেউ মুক্তিবাহিনীদের সাথে যোগ দিয়েছে। মুক্তিবাহিনীর খাবারে সমস্যা হচ্ছিল না। গ্রামবাসী তাদের খাবার, পানি দিয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। অন্যদিকে মিলিটারিদের রসদ কমে যাচ্ছিল। আস্তে আস্তে তাদের ফায়ারিং এর মাত্রাও ক্ষীণ হয়ে আসে। পুরো দিন এইভাবেই চলে যায়।

পরদিন আর মিলিটারিদের সাড়া পাওয়া যাচ্ছিল না। তারা পুরোপুরি রসদ শূণ্য হয়ে যায়। সারেন্ডারও করছিল না। মুক্তিযোদ্ধারাও কৌশলগত কারণে এগোচ্ছিল না। এক ব্যাটালিয়ন মিলিটারির মোকাবেলা করা অনেক টাফ। বিকেলের দিকে যৌথ বাহিনী আসে। মিলিটারিরা খবর পাঠালো তারা যৌথবাহিনীর কাছে সারেন্ডার করবে। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে সারেন্ডার করা মানে নিশ্চিত মৃত্যু। যৌথবাহিনীর প্রধান কমান্ডে হিরণ, কাঞ্চন ও বাশারের সাথে আলাপ করে। তারা রাজি হয়।

যৌথবাহিনীর এক সৈন্য কিছুটা এগিয়ে বাঁশিতে ফু দিয়ে হুংকার দেয়, ‘রাইজ আপ।’ সব মিলিটারি হাত তুলে দাড়িয়ে পরে। তেরশ সৈন্য সারেন্ডার করে। মুক্তিবাহিনী দেখে বিস্মিত, এতো মিলিটারিকে দুইদিন ঘোল খাইয়েছে। অন্যদিকে মুক্তিবাহিনীর সংখ্যা দেখেও মিলিটারি কমান্ডার অবাক বনে যায়। তারা ভেবেছিল মুক্তিবাহিনীর বিশাল ফোর্স তাদের ঘিরে রেখেছিল। তাদের কাছে তখনও ১০ হাজার বুলেট অবশিষ্ট ছিল, তা দিয়ে নিমিষেই সবাইকে মেরে ফেলা যেত।

গ্রামবাসী ঝাটা, লাঠি, ঢাল-কাৎরা নিয়ে মিলিটারি মারার অপেক্ষায় ছিল। অনেক কষ্টে যৌথবাহিনী মিলিটারিদের গ্রাম থেকে পার করতে পেরেছিল।

ওই সাড়ে তিনশো মুক্তিযোদ্ধার একজন ছিলেন আমার বাবা। তার কাছ থেকে এই অসীম বীরত্বের ঘটনাটা শুনলাম।

Written by – আহমেদ ইমরান হালিমী

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!