You dont have javascript enabled! Please enable it!

প্রসঙ্গক্রমে মােহমুক্ত মৌলনা ভাসানী

পিকিং পন্থী ও ভারত বিদ্বেষী বলে মৌলানা ভাসানীর খ্যাতি ছিল। কিন্তু স্বাধীন বাংলার সংগ্রামের তিক্ত অভিজ্ঞতা মৌলনা ভাসানীর মধ্যে গুরুতর পরিবর্তন সূচনা করেছে। একটা স্বাভাবিক। স্বাভাবিক অবস্থায় মানুষ যা দশ বছরে উপলব্ধি করে না, অস্বাভাবিক ও বিপ্লবী পরিস্থিতিতে সেই মানুষ দশ দিনেই তা উপলব্ধি করে। সংগ্রামই মানুষের শিক্ষক। প্রাচীন ও সংকীর্ণ চিন্তাকে উপড়ে ফেলে সগ্রাম যেমন নব জীবন সৃষ্টি করে তেমনই নতুন চিন্তারও সূচনা করে। মৌলানা ভাসানীর চিন্তার পরিবর্তন তারই ইঙ্গিত।
তিনি বলেছেন যে পশ্চিম পাকিস্তানে কায়েমী স্বার্থবাদীদের নগ্ন আক্রমণের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষ এক পবিত্র সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছে। আর চীন বাংলাদেশ ও তার পবিত্র সগ্রামকে পথে বসাবার চক্রান্ত করছে।
বাংলা দেশের স্বাধীনতা সগ্রামের প্রতি চীনের বিশ্বাসঘাতকতা এবং নয়া উপনিবেশবাদী সামরিক শাসনের প্রতি তার সমর্থন মৌলানা ভাসানীর চিন্তাধারার মধ্যে মৌলিক পরিবর্তন সূচনা করেছে। এ কথা আজ অস্বীকার করার উপায় নেই যে চীনের নেতারা কেবল আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে ভেদ সৃষ্টি করে নি, সামাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সােভিয়েতের সঙ্গে যুক্তফ্রন্ট গঠন করতে অস্বীকার করে নি, তারা বাংলা দেশের ৭ কোটি মানুষের মৌলিক স্বার্থকে উপনিবেশবাদী সামরিক শাসনের কাছে বিসর্জন দেবার চক্রান্তে লিপ্ত হয়েছে। মুখে বিপ্লবের বুলি। আর কাজে কোটি কোটি মানুষের স্বাধীনতা সগ্রামের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতাএটাই হলাে চীনের চিরাচরিত নীতি।
চীনের ভূমিকা সম্পর্কে মৌলানার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা তাঁকে চীন সম্পর্কে মােহমুক্ত করেছে। এটা শুভ ঘটনা। পশ্চিমবঙ্গে চীন পন্থীরা কি এর থেকে কোন শিক্ষা গ্রহণ করবেন?

একেই বলে বরাত
মহাজনের কাছে খাতক যে কত অসহায়, আকণ্ঠ অস্ত্রসজ্জিত রক্তপায়ী পাক জঙ্গীশাহী তার জাজ্বল্য নজীর। আমেরিকার ভারতস্থ রাষ্ট্রদূত কিটিং সাহেব সম্ভবত হঠাৎ মুখ ফস্কে বলে ফেলেছেন, পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনায় বিশ্বের মানব সম্প্রদায় উদ্বেগ বােধ করছেন। তিনি আরও বলেছেন, ঘটনাটি পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার নয়।
ঠিক এই কথা বরং আরও কিছুটা নরমভাবে বলার জন্য ভারতকে কি গালাগালটাই না শুনতে হচ্ছে। করাচী বা ঢাকা রেডিও সুযােগ পেলেই ভারতের বিরুদ্ধে কুৎসা ছড়াচ্ছে, ভয় দেখাচ্ছে, উপদেশ দিচ্ছে। ইয়াহিয়া সাহেব এবং তার বর্বর সৈন্যরা বাঙলাদেশে নিরস্ত্র জনতার রক্ত নিয়ে পিশাচ-নৃত্য করবেন কিন্তু কারুর কিছু বলা চলবে না। ইয়াহিয়া ও তার সাকরেদরা ভারতকে ধমকেছেন, রাশিয়াকে বলেছেন, ওটা পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার। কিন্তু আমেরিকার বেলায় এই তেজটা হঠাৎ কেমন চুপসে গেছে।
পশ্চিম পাকিস্তানের বৈদেশিক বিভাগের মুখপাত্ররা কিটিং সাহেবের মন্তব্যের পূর্ণপাঠ সংগ্রহ করার চেষ্টা করছেন। এই বিবৃতির সবটা জানার পর যাচাই করে দেখা হবে এবং তার পরে মার্কিন সরকারের কাছে ঐ বক্তব্যের ব্যাখ্যা চাওয়া হবে। সেই ব্যাখ্যা এলে ইয়াহিয়া সরকার তখন হুঙ্কার ছাড়ুন বা মিউ মিউ করুন, তা করবেন-তার আগে নয়।
রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া প্রকাশের পদ্ধতিটা ঐ রকম। কিন্তু ইয়াহিয়ারা ইতিপূর্বে ভারত বা ঐ ধরনের রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে এই নীতি কোনদিন অনুসরণ করেনি। তবে আমেরিকার বেলায় সব পদ্ধতিরই ব্যতিক্রম হয়। কারণ জঙ্গীশাহীর বর্তমান বর্বরতা, পৈশাচিকতা এবং জঙ্গী রাজনীতির সমস্ত পাঠ এবং তার রসদ ত’ আমেরিকাই যােগাচ্ছে। তাই জঙ্গীশাহীকে কিটিং’এর কিল আপাততঃ হজম করতে হচ্ছে। একেই বলে খাতকের বরাত।

সূত্র: কালান্তর, ১৯.৪.১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!