বাঙলাদেশকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক জটিলতা
-সত্যব্রত শর্মা
জাতিসংঘের প্রধান সচিব উ-খান্টের আবেদনে মার্কিন সরকার ভিক্ষা আস্তিত্ব ধরে যখন টান পড়েছে, লক্ষ লক্ষ নারী ও শিশুকে যখন ইয়াহিয়া খানের জল্লাদের হাতে বলির পাঠায় মতন প্রাণ দিতে হয়েছে, প্রাণভয়ে বহু লক্ষ মানুষ বাঁচার আশায় যখন প্রতিবেশী রাষ্ট্রে ছুটে এসেছে, তখন যেসব রাষ্ট্র উদ্যোগী হলে বাঙলাদেশকে এই গণহত্যা থেকে বাঁচাতে পারে তাদের অনেকগুলিই নিজেদের স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত। তাদের দৃষ্টি বাঙলাদেশের এই বিপর্যয়ের সুযোেগ নিয়ে কীভাবে পাকিস্তানের জঙ্গী শাসক গােষ্ঠীকে আরাে খানিকটা তাঁকে আনা যায়। লক্ষ লক্ষ বাঙালীর রক্তের বিনিময়ে তারা চায় পাকিস্তানের উপর আরাে প্রধান্য বিস্তার করতে। বাঙলাদেশের যুদ্ধ যতই দীর্ঘস্থায়ী হবে পাকিস্তানের অর্থনীতিক কাঠামাে ততই ভেঙে পড়বে এবং বিদেশ থেকে তার অস্ত্র আমদানির প্রয়ােজনও দিন দিন বাড়বে। ইয়াহিয়া খানের জঙ্গীচক্র বাঙলাদেশকে এমন একটা অবস্থায় ঠেলে দিয়েছিল যে সেখানকার বাঙালীদের অস্ত্র ধারণ ও স্বাধীনতা ঘােষণা করা ছাড়া উপায় ছিল না। সে পথ অবলম্বন না করলে গােটা বাঙালী জাতিকে নতজানু হয়ে ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে হত। তার অর্থ দাঁড়াত নির্বাচকমণ্ডলীর প্রতি আওয়ামী লীগের বিশ্বাসঘাতকতা, পূর্ববঙ্গের সমস্ত গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও গণশক্তির বুকে ছুরিকাঘাত।
সেই আত্মহননের পথে যায় নি আওয়ামী লীগ। দল হিসেবে আওয়ামী লীগ অপ্রতিদ্বন্দ্বী রূপে বেরিয়ে এলেও এ জয় শুধু তার একার নয়; আওয়ামী লীগের ছ’দফা দাবির প্রতি অন্যান্য গণতান্ত্রিক দলেরও সমর্থন ছিল। অবশ্য কোন কোন দলের দাবি তারও চাইতে কিছু বেশি থাকলেও একমাত্র প্রতিক্রিয়াশীল ও সাম্প্রদায়িকতাবাদী দলগুলি ছাড়া আওয়ামী লীগের দু’দফা দাবির প্রতি কারাে বিরূপতা ছিল না। সুতরাং বাঙলাদেশের নির্বাচনকে বস্ততপক্ষে বলা যায় গণভােট, যার রায় প্রতিক্রিয়াশীল ও সাম্প্রদায়িকতাবাদী
একে একেবারে কোণঠাসা করে। অবশ্য নির্বাচনের দ্বারা এ ধরনের দলের একেবারে বিলুপ্তি ঘটানাে সম্ভব নয়। কারণ কিছু কিছু সমর্থক তাদের থেকেই যায়। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের পর প্রগতিশীল কর্মসূচীর দ্বারা সেসব প্রতিক্রিয়াশীল দলের সমর্থকদের মােহভঙ্গ করে তাদের অবশিষ্ট গণভিত্তি নষ্ট করে দেওয়া সম্ভব। কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব সেই প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দায়িত্ব পালনের সুযােগ পান নি; তার আগেই অস্ত্রবলে তাকে খতম করার কাজ শুরু হয়ে যায়। তারই সুযােগ নিয়ে নির্বাচনে মার খাওয়া মুসলিম লীগ ও আরাে দু-একটি সাম্প্রদায়িকতাবাদী দল মুক্তিযুদ্ধকে বানচাল করার উদ্দেশ্যে বিশ্বাসঘাতকতার পথ নিয়েছে।
প্রকাশ্য না বললেও এরাই এখন ইয়াহিয়া খান ও পাঞ্জাবের পুঁজিপতি গােষ্ঠীর ভরসা। কিন্তু বাঙলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ গণযুদ্ধের রুপ নেওয়ায় ইয়াহিয়া খান এদের উপর ভরসা করে একটা নকল অসামরিক শাসনকাঠামাে ঘােষণা করতে সাহসী হচ্ছেন না। বাঙলাদেশের উপর অস্ত্রাঘাতের পেছনে তার একটা আশা ছিল, ঘা খেয়ে আওয়ামী লীগের মধ্যে ভাঙন ধরবে-অর্থাৎ তার হিসেব মতাে লীগের নরমপন্থী অংশ সশস্ত্র প্রতিরােধের পথ বর্জন করে আপসকামী হবে এবং তখন তিনি সেই অংশকে ভুট্টোর সঙ্গে মীমাংসা করতে বলবেন। তা করতে পারলে ইয়াহিয়া খানের ইজ্জত বাঁচবে অর্থাৎ তিনি বলতে পারবেন, নির্বাচনের রায় অনুয়ায়ীই জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডেকে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সুযােগ দেওয়া হল। কিন্তু ইয়াহিয়া খানের সেই আশা ব্যর্থ হয়েছে। আওয়ামী লীগ দ্বিধাবিভক্ত হওয়া তাে দূরের কথা, জঙ্গীচক্রের বর্বরতা তার ঐক্যকে আরাে ইস্পাতসদৃশ দৃঢ় করে তুলেছে। কেবল তাই নয়, রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের সঙ্গে যাদের মতবিরােধ ছিল মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ায় তারাও তার জাতীয় নেতৃত্ব স্বীকার করে নিয়েছে। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির নেতা মৌলানা ভাসানী ও পূর্ববঙ্গের কমিউনিস্ট পার্টি (যা এতদিন নিষিদ্ধ অবস্থায় ন্যাপের মধ্যে থেকেই কাজ করে আসছিল) প্রকাশ্যেই ঘােষণা করেছেন যে, আওয়ামী লীগই বাঙলাদেশের সর্বজনস্বীকৃত নেতা এবং এই দল কর্তৃক গঠিত স্বাধীন বাঙলা সরকারই একমাত্র বৈধ সরকার। পিকিংপন্থী তােহার দলের ভূমিকা অন্যরূপ হলেও মুক্তি-সগ্রামে জাতীয় ঐক্য তার দ্বারা তেমন বিঘ্নিত হবার সম্ভাবনা নেই; কারণ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কয়েকটি পকেট ছাড়া জনতার উপর তাঁর দলের প্রভাব প্রায় শূন্যের ঘরে।
কিন্তু চীনের মাওবাদী নেতৃত্বের ভরসা বােধ হয় তােহার এই ক্ষুদে দলটিরই উপর। গেরিলা যুদ্ধের দীর্ঘস্থায়িত্ব শেষ পর্যন্ত তােহার নেতৃত্বকেই প্রতিষ্ঠিত করবে এবং বুর্জোয়া মুজিবরের প্রভাব ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হবে -চীনের রাজনৈতিক মানদণ্ডের বিচার এরূপ হলেও বাঙলাদেশের ব্যাপার নিয়ে তার মতিগতিও অনেককে বিস্মিত করেছে। তােহা যদি পূর্ণ সাফল্যের দিকে অগ্রসর হতে না-ও পারেন অন্ততঃ ভেতরে থেকে চীনের সাহায্যে মুক্তিযুদ্ধকে খানিকটা বানচাল করতে পারলেও পিকিং নেতৃত্বের লাভ। তা করতে পারলে একদিকে যেমন ইয়াহিয়া খানের হাত শক্ত হবে অন্যদিকে তেমনি গােটা বাঙলাদেশের উপর আওয়ামী লীগ সরকারের কর্তৃত্ব স্থাপনের বিপ্ন দেখা দেবে। মুজিবের নেতৃত্বকে বাঙলা দেশে আধিপত্য করতে দেওয়া হবে না, যেভাবেই হােক তা ঠেকিয়ে রাখতে হবে এই হচ্ছে চীনের দৃঢ় পণ। বাঙলাদেশে পিকিং পন্থীদের তাই স্লোগান। “এ হচ্ছে পাঞ্জাবী কুত্তা বাঙালী কুত্তার লড়াই-এর সঙ্গে জনসাধারণের স্বার্থের কোনাে যোেগ এই রাজনৈতিক বুদ্ধি থেকেই পিকিং নেতাদের পাকপ্রেম উথলে উঠেছে। এই উপলক্ষ্যে ভারতের উপর চাপ সৃষ্টিরও মওকা পেয়েছে চীন। ক্রমাগত শরণার্থীর চাপে একদিকে যেমন ভারতের অর্থনৈতিক কাঠামোেটা খা তেমনি ভারতের অভ্যন্তরে শৃঙ্খলা সৃষ্টিরও সুযােগ মিলবে। ভারত যদি পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে নাও পড়ে তবু পাক সামরিক চাপের দরুন তাকে প্রতিরক্ষার দিকে অধিকতর দৃষ্টি দিতে হবে। তার অর্থ দেশের উন্নয়ন থেকে ভারত সরকারের দৃষ্টি প্রকল্প প্রতিরক্ষার দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া। মােট কথা ইয়াহিয়ার পথ চীনকে সুযােগ দিয়েছে ভারতকে বিব্রত করার।
চীনের শূন্যদৃষ্টি আরাে সুদূর প্রসারী। সােভিয়েত ইউনিয়ন ভারতের অকৃত্রিম বন্ধু তা চীন জানে। ভারত একটি অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়লে সােভিয়েত ইউনিয়নও খানিকটা ব্রিত হবে। এমন একটা অবস্থার সৃষ্টি যদি করা যায় যাতে ভারত শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করতে বাধ্য হয় তবে সােভিয়েত ইউনিয়নও চাপে পড়বে। বন্ধুরাষ্ট্রের বিপর্যয়ে সােভিয়েত ইউনিয়নের চুপ করে থাকা তখন হয়তাে সম্ভব হবে
সেই অবস্থায় সােভিয়েত ইউনিয়ন যদি মিত্র রাষ্ট্রকে অস্ত্র সাহায্য করতে অগ্রসর হয় তবে চীনের মনস্কামনা সিদ্ধ হবে। সেক্ষেত্রে মার্কিন শক্তিকে পাশে পাবার আশা রাখে চীন। ইন্দোচীনে সামরিক হস্তক্ষেপের জন্য বিশ্ববাসীর যে ঘৃণা কুড়ােতে হচ্ছে মার্কিন শাসকবর্গকে সেই কলঙ্ক অপলােদনের আশায় তারা তখন বলতে শুরু করবেন, সােভিয়েত ইউনিয়ন পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করছে। এই অজুহাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দরাজ হাতে পাকিস্তানকে অস্ত্র দিতে শুরু করবে। পশ্চিম এশিয়া ও পূর্ব এশিয়ার যুদ্ধটা এসে স্থান নেবে একেবারে ভারত পাকিস্তান উপ-মহাদেশে। দুই প্রধান শক্তির এই সংঘাত বাধিয়ে দিতে পারলে চীনের বহুদিনের মতলব হাসিল হবে। মাওবাদী চীন বেশ কিছুকাল যাবতই চেষ্টা করে আসছে যাতে সােভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে একটা যুদ্ধ বাধে। বাঙলাদেশকে কেন্দ্র করে তেমন একটা অবস্থার সৃষ্টি করা যায় কিনা তারই তালে আছে চীন। তার হিসেব, সােভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পরস্পর এই উপলক্ষ্যে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে উভয় রাষ্ট্রের শক্তি হ্রাস হবে এবং সে তখন বিশ্বের সেরা শক্তি হয়ে দাঁড়াবে। এই উপমহাদেশে যুদ্ধ বাধলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বাধ্য হয়েই ইন্দোচীনের উপর সামরিক চাপ হ্রাস করতে এবং সেই সুযােগে চীন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় তার প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হবে পিকিং নেতাদের মনে এরূপ আশাও উকিঝুঁকি মারছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাঙলাদেশের ঘটনাকে দেখছে ভিন্ন দৃষ্টিতে- কিন্তু লক্ষ্য এক। সাপও মরে লাঠিও না ভাঙে। পাঞ্জাবের পুঁজিপতি-গােষ্ঠী ও সামরিক চক্রকে হাতে রেখে পাকিস্তানের উপর প্রভাব অক্ষুন্ন রাখা এবং একই সঙ্গে বাঙলাদেশ একেবারে আওতার বাইরে চলে না যায় তা-ও দেখা। বৃটিশ আমল থেকেই পূর্ববঙ্গে বৃটিশ পুজি ঘাঁটি গেড়ে আছে। পাট ব্যবসায়েই বৃটিশ পুঁজি খাটে বেশি। পাকিস্তান হবার পরেও মার্কিন পুঁজি পশ্চিম পাকিস্তানে যতটা অনুপ্রবেশ করতে পেরেছে পূর্ববঙ্গে ততটা পারে নি। বৃটিশ পুঁজির সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতাই তার একমাত্র কারণ নয়, পূর্ববঙ্গের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মার্কিন সামাজ্যবাদী-বিরােধী চরিত্র ও সে পথে বাধা। সুতরাং পূর্ববঙ্গে বৃটিশ পুঁজি হঠিয়ে মার্কিন পুঁজির জন্য যদি স্থান করে নিতে হয় তবে পাঁজির হাত ধরে এগুনােই সুবিধাজনক। পূর্ববঙ্গে মুজিবর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী মার্কিন শাসকমহল চীন পূর্ববঙ্গে এমন একটি শাসক দল যারা পাঞ্জাবী প্রভুদের আজ্ঞাবহ হয়ে চলবে। সেদিক থেকে বাঙলাদেশে মুক্তি যুদ্ধের সাফল্য তাদের কাম্য হতে পারে না। আবার এক যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে নেতৃত্ব পিকিংপন্থীদের হাতে চলে যেতে পারে এ ভয়ও তাদের আছে। পাকিস্তানের কোন অংশেরই উপর চীনের প্রভাব বৃদ্ধি পায়, মার্কিনকর্তারা তা চান না।
এ সব কারণেই উভয়কুল রক্ষার কথা ভাবছেন আমেরিকার শাসকগােষ্ঠী। সােভিয়েত ইউনিয়ন এরই মধ্যে পাকিস্তানে সর্বপ্রকার সাহায্য প্রেরণ বন্ধ করে দিয়েছে। চীন প্রকাশ্যেই ইয়াহিয়া খানকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়ে পাকিস্তানকে তার দিকে আরাে হেলাবার চেষ্টায় আছে। ইয়াহিয়া খানের ভাণ্ডার আজ বাড়ন্ত বাঙলাদেশকে পর্যুদস্ত করার জন্য সেখান থেকেই সাহায্য আসুক তিনি এখন তা লুফে নেবেন। ঐ অবস্থায় মার্কিন শাসকরা সাহায্যদান বন্ধ করে ইয়াহিয়া খানকে হাতছাড়া করতে যাবেন কেন? তাই তারা প্রতিশ্রুত সাহায্য ইসলামাবাদকে দিয়ে যাচ্ছেন। আশু ৭৫ কোটি টাকা এবং পরে ৩৫০ থেকে ৭৫০ কোটি। আরজি পাক সরকারে তরফ থেকে মার্কিন দরবারে পেশ করা হয়েছে শেষ পর্যন্ত দেখা যাবে তা-ও মঞ্জুর হয়ে গেছে। ইয়াহিয়া খানের হাত আরাে শক্ত করে বাঙলাদেশকে নীতি স্বীকারে বাধ্য করাতে পারলেই আমেরিকার অভীষ্ট লাভ হয়। সাহায্য বন্ধ করার জন্য মার্কিন সেনেটের পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান সেনেটর ফুলব্রাইট করুন না যত খুশি চেঁাচমেচি, দু-চারটে মার্কিন পত্রিকায় বেরুক না।
মুক্তিযুদ্ধকে তারা বিচার করছে কি-না বলা যায় না। সে দুটো ছিল সাম্রাজ্যবাদীদের উস্কানিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ থেকে সংখ্যালঘুদের বিছিন্ন হবার জন্য সশস্ত্র বিদ্রোহ। কিন্তু বাঙলাদেশের ঘটনা বিপরীত। সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের বিরুদ্ধে সংখ্যালঘু অংশের সশস্ত্র বলপ্রেয়ােগ। তাই এটা বিদ্রোহ নয়-মুক্তিযুদ্ধ। মনে হয় আফ্রিকার দেশগুলির কাছে এই পার্থক্য পরিষ্কারভাবে তুলে ধরা হয় নি বলেই এখনাে পর্যন্ত তারা নীরব।
তবে তৃতীয় বিশ্বের সবাই চোখ বুজে আছেন এমন নয়। যুগােশ্লাভিয়ার রাষ্ট্রপতি মার্শাল টিটো এই গণহত্যার নিন্দা করেছেন এবং বাঙলাদেশের প্রতি সহানুভূতি জানিয়েছেন।
বাঙলাদেশকে কেন্দ্র করে আন্তজার্তিক জটিলতা রয়েছে বলেই সােভিয়েত ইউনিয়নকে সন্তর্পণে পদক্ষেপ করতে হচ্ছে। রাষ্ট্রপতি পদগাের্ণি রক্তপাত বন্ধ করতে বলেছেন ইসলামাবাদকে। শরণার্থীদের জন্য সাহায্যও দিয়েছেন সােভিয়েত সরকার। গণতান্ত্রিক জার্মানিও শরণার্থীদের সাহায্য করবে বলে জানিয়েছেন। জাতিসংঘের প্রধান সচিব উ-থান্টের আবেদনে মার্কিন সরকার ভিক্ষা-স্বরূপ যৎসামান্য দিয়েই দায় সেরেছেন। এ যাবৎ তার আবেদনে সামান্য সাড়াই পাওয়া গেছে।
প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা পাকিস্তানের উপর কূটনৈতিক চাপ সৃস্টির জন্য বিভিন্ন রাষ্ট্রকে অনুরােধ করেছেন। যারা বাঙালা জাতির দুর্ভাগ্য নিয়ে নিজ নিজ স্বার্থের হিসেব-নিকেশে ব্যস্ত তারা কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টি করে রাজনৈতিক সমাধানে প্রয়াসী হবে এমন আশা কম। অথচ বিপুল সংখ্যক শরণার্থীর বােঝা ঘাড়ে নিয়ে অনির্দিষ্টকাল ভারতের চুপ করে বসে থাকাও কঠিন। একটা পথ তাকে বেছে নিতেই হবে। সে পথ শরণার্থীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ও তাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা। সােজা আঙ্গুলে ঘি ওঠে না। কোনাে সৎ যুক্তিই ইয়াহিয়া শুনবেন না। সুতরাং একমাত্র উপায় বাঙলাদেশে শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তনের জন্য নিরাপ সুরক্ষিত মুক্ত অঞ্চল সৃষ্টি করা যেখানে ইয়াহিয়া খানের জল্লাদরা নিশ্চিত মৃত্যু জেনে হানা দিতে ভয় পাবে। মুক্তিযােদ্ধাদের রণশক্তি বৃদ্ধিই তার একমাত্র উপায়। অস্ত্র ছাড়া রণশক্তি বৃদ্ধি সম্ভব নয়। স্বাধীন বাঙলা সরকারকে স্বীকৃতি দিয়ে মুক্তিযােদ্ধাদের অস্ত্রবল বাড়ানােই একমাত্র পথ। আলােচিত আন্তর্জাতিক জটিলতার মধ্যে ভারত যদি এগিয়ে গিয়ে বাঙলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় তাতে ঝুঁকি আছে ঠিকই, কিন্তু সেই ঝুঁকি নিয়েই স্বীকৃতি দিতে হবে। তাছাড়া গত্যন্তর নেই। ভারতকে চাপমুক্ত করার জন্য কোনাে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিই এগিয়ে আসবে না। আপন শক্তির উপর নির্ভর করেই তাকে কাঁধের বােঝা নামাতে হবে। তা না করলে বােঝা উত্তরােত্তর বাড়বে বই কমবে না।
বাঙলাদেশকে স্বীকৃতি দিলে পাকিস্তান একবার মরণ কামড় দেবার চেষ্টা করবে সন্দেহ নেই। আন্তর্জাতিক জটিলতাও ও বাড়তে পারে। সে ভয়ে পৌছুলে চলবে না। জাতির কাঁধে যদি বিপদ এসে চাপে জাতিই সংহত হয়ে তার মােকাবিলা করবে। বাঙলাদেশে আজ যে ঐক্য সম্ভব হয়েছে বিপদের দিনে ভারতেও তেমন ঐক্য গড়ে উঠবে না এমন ভাবা নৈরাশ্যবাদিকে প্রশ্রয় দেওয়া। যদি কেউ পৃষ্ঠদেশে ছুরিকাঘাতের চেষ্টা করে জাতিই সেই বিশ্বাসঘাতকদের উপযুক্ত সাজা দেবে-যেমন বাঙলাদেশে আজ মুক্তিযোেদ্ধারা দিচ্ছে। সেখানকার কুলাঙ্গার দেশদ্রোহীদের।
সূত্র: কালান্তর, ২৭.৫.১৯৭১