You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.06.02 | বাঙলাদেশ ও সি-পি-এম | কালান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

বাঙলাদেশ ও সি-পি-এম

পশ্চিমবাঙলার বিধানসভায় সি-পি এম নেতা শ্রীহরেকৃষ্ণ কোঙার হৈ চৈ করে অভিযােগ করেছিলেন যে, বাঙলাদেশের বয়ােবৃদ্ধ নেতা মৌলানা ভাসানীকে ভারত সরকার নাকি কার্যতঃ অন্তরীণ করে রেখেছেন। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে মৌলানা নিজে ঐ অভিযােগটিকে অস্বীকার করেছেন এবং সি-পি-এম-এর অপপ্রচারের প্রতি তীব্র বিদ্রুপ হেনেই বলেছেন যে, অমন ধরনের সংবাদের বিবৃতি দিয়ে প্রতিবাদ জানাতে হলেও অন্য কিছু করার সময় থাকে না।”
বাঙলাদেশের সংগ্রামকে ভারত সরকারের বিরুদ্ধে প্রচারের মওকা করা ব্যতীত সি-পি এম নেতারা অন্য কোন রাজনীতি বােঝেন না। এমনকি পার্লামেন্টে কিংবা পশ্চিম বাঙলার বিধানসভায় সর্বদলীয় এবং সর্বসম্মত বাঙলাদেশ সম্পর্কিত প্রস্তাব গ্রহণ করার সময়ও সি-পি এম নেতারা ভারত সরকারকেই আক্রমণের লক্ষ্য করে বক্তৃতা করেছেন।
বাঙলাদেশ সম্পর্কিত নীতি নির্ধারণে বিশেষ করে বাঙলাদেশকে স্বীকৃতি দানে ভারত সরকারের দ্বিধাদুর্বলতা এবং ক্লীবতা রয়েছে, সেকথা সঠিক। ভারতের মানুষ তার বিরুদ্ধে লড়ছে। কিন্তু সি-পি- এম-এর আন্দোলন ভারত সরকারের দুর্বলতার বিরুদ্ধ নয়; ভারত সরকারের বিরুদ্ধে। সি-পি-এর নেতৃত্ব নিজেদের নিকষ মার্কসবাদীর খবর জানেন। একটি ন্যায়যুদ্ধের ঝুঁকি নিয়েও অপর একটি মুক্তি-সংগ্রামী রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেবার জন্য দাবি যে সরকারের কাছে তারা জানান, তারই সঙ্গে সঙ্গে ঐ ন্যায়যুদ্ধের শরিক স্বদেশের রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে গৃহযুদ্ধেরও আয়ােজন করেন? সি পি এম নেতৃত্ব বিশ্ব-কমিউনিস্ট আন্দোলন থেকে দূরে সরে গেছেন বহুদিন, আর তার জের ধরে এখন মার্কসবাদের মৌলিক তত্ত্বগুলিকেও নিজেদের রাজনীতি থেকে সম্পূর্ণ। বিসর্জন দিচ্ছেন।
মৌলানা ভাসানী একদা তাঁর দূরদৃষ্টির অভাবে বাঙলাদেশের জাতীয় আন্দোলন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন। অতি বাম সংকীর্ণতাবাদ মৌলানাকে পেয়ে বসেছিল বলেই তিনি ন্যাপ’কে ভেঙে ছিলেন এবং বাঙলাদেশের সাম্প্রতিক ঐতিহাসিক নির্বাচনকে বয়কটেরও ডাক দিয়েছিলেন। বাঙলাদেশের এমন একজন ব্যক্তিকে পশ্চিমবাঙলায় নিশ্চয়ই বেশ গুছিয়ে কাজে লাগান যাবে এই সংকীর্ণ দলবাজির আশায় সি পি এম নেতৃত্ব উৎফুল্ল হয়ে উঠেছিল। কিন্তু সি পি এম নেতাদের কপাল মন্দ। মৌলানা ভাসানী স্বদেশের রাজনীতিতে নিজের সংকীর্ণতাবাদকে সম্পূর্ণ পরিহার করে যেমন মুজিব সরকারের প্রতি দ্ব্যর্থহীন সমর্থন নিয়ে দাঁড়িয়েছেন, তেমনই ভারত সক্কারের বিরুদ্ধে প্রচারে সি পি এম তাঁর নামকে ব্যবহার করবে সে ক্ষেত্রেও বাদ সেধেছেন। ফলে সি পি এম নেতৃত্বের অবস্থাটা দাড়াল, যার জন্য করি চুরি, সেই বলে চোর’।
বাঙলাদেশের মুক্তি ও গণতন্ত্রের সংগ্রামকে কেন্দ্র করে পাক-ভারত সম্পর্ক যে কোন দিন প্রত্যক্ষ সংঘর্ষে রূপান্তরিত হয়ে যেতে পারে, তা আর আদৌ কোন অমূলক আশংকা নয়। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবার জন্য ভারতবাসীর যে দাবি উঠেছে, তা বাঙলাদেশকে নিরামিষ সাহায্যদানের জন্য নয়; প্রয়ােজন হলে ভারত সরকার গণতন্ত্রের জন্য সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত হবে সেটাই ভারতবাসীর নিঃশঙ্ক ঘােষণা। বাঙলাদেশকে স্বীকৃতি দিলে এবং মুক্তিযযাদ্ধাদের সর্বপ্রকার সাহায্য দিলে জঙ্গী ইয়াহিয়া খাঁ তার যুদ্ধকে ভারতবর্ষের মধ্যেও ছড়াবে, তা ধরে নিতে হয় এবং ইয়াহিয়ার বিশ্ব-পৃষ্ঠপােষকদের সঙ্গেও যে ভারতের সেই যুদ্ধ হতে পারে, তা বুঝে নিতে হয়। এইরূপ পরিস্থিতির মধ্যে একটি যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির মধ্যেই, সি পি এম নেতৃত্ব মার্কসবাদকে বিসর্জন দিয়ে যে সুবিধাবাদী রাজনীতি চালাচ্ছে তার ফলে শেষ পর্যন্ত কেউই সি পি এম এর সঙ্গী থাকবে। সংকীর্ণতাবাদের ও সংকীর্ণতাবাদীদের পরিণতি ইতিহাসে ঐ ভাবেই নির্দিষ্ট হয়ে রয়েছে।

সূত্র: কালান্তর, ২.৬.১৯৭১