খান মার্কা গণতন্ত্র
বেইমান ইয়াহিয়া খান মুখ খুলেছেন। কেবল বাঙলাদেশের প্রতি বেইমানী করেই তিনি ক্ষান্ত হন নি, তার বেতার ঘােষণায় পশ্চিম-পাকিস্তানের জনসাধারণের প্রতিও তিনি বেইমানীর পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন। ভােটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সংবিধান রচনার অধিকার নেই; তাঁর মনােনীত কয়েকজন বিশেষজ্ঞ সংবিধান রচনা করবেন আর সেই সংবিধান প্রসব করবে ইসলামমার্কা সাধারণতন্ত্র। আয়ুর খান পাকিস্তানকে দিয়েছিলেন বেসিক ডেমােক্রাসি; ইয়াহিয়া খান দেবেন অশ্বডিম্ব। সেই অশ্বডিম্বও সরাসরি জনসাধারণের ভাগ্যে জুটবে না; প্রসবের পরে জঙ্গী ইয়াহিয়া খান প্রসূতি ঘরে বসে সেই ডিমে তা দেবেন-অর্থাৎ সরকার গঠিত হলেও তা থাকবে সামরিকভাবে এবং তা কতদিন থাকবে তাও তিনি বলেন নি। ডিম আদৌ ফুটবে কিনা তাই বা কে বলতে পারে।
পাকিস্তানের ঘাড়ে গণতন্ত্র না চাপিয়ে ছাড়বেন না ইয়াহিয়া খান। একবার গণতন্ত্র দিতে গিয়ে বাংলাদেশকে তিনি এমন ‘গণতান্ত্রিক দাওয়াই দিলেন যা খেয়ে গােটা বাঙলাদেশ নীলকণ্ঠ হয়ে গেল। ইয়াহিয়া খানের কোমরবন্ধ তাতে খানিকটা ঢিলে হয়ে গেলেও গণতন্ত্রের কবরে চিরাগ জ্বালনার সংকল্প তিনি ছাড়েন নি। তাই আবার কোমরবন্ধ শক্ত করে এঁটে গােটা পাকিস্তানের গণতন্ত্রকে কবর দেবার জন পেরেক ঠুকতে শুরু করেছেন তিনি। তাঁর এই গণতন্ত্রপ্রীতি দেশে পশ্চিম পাকিস্তানের জনসাধারণও নিশ্চয়ই হাতের নাগালে আসমানের চাঁদ পাওয়ার আনন্দে নাচতে থাকবে।
ইয়াহিয়া খানকে একেবারে নির্দয় বলা যায় না। তার মক্কেল হয়ে জাতীয় পরিষদে যারা আসবেন তারা সংবিধান সংশােধনের সুযােগ পাবেন; তবে সংবিধানে বর্ণিত এসলামিক ফরমানের বাইরে যাওয়া চলবে না। তার অর্থ ইয়াহিয়ার রিক্স মেনে চলতে হবে। তাঁর ব্রিফ মানতে না চাওয়ায় শেখ মুজিবর রহমান ও আওয়ামী লীগের নেতাদের কপালে যা জুটেছে তা সবাই জানে। সুতরাং আর কেউ সেপথে যেতে সাহসী হবে না এই ধারণার বশবর্তী হয়েই বােধ হয় পাকিস্তানের জাদরেল শাহানশা এই নতুন খেল দেখাবার মতলব এঁটেছেন। পােষমানা জীবের মত সবাই ইয়াহিয়া খানের সেই ‘গণতান্ত্রিক’ খোয়াড়ে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়বে কিনা এখনি বলা যায় না। দু চারজন বেয়াড়া ধরনের মাথাগরম লােক বেঁকেও বসতে পারে। বাঙলাদেশের রােগটা যে পশ্চিম পাকিস্তানেও কিছু লােককে পেয়ে বসবে না, এমন কথা কি হলফ করে বলা চলে?
আওয়ামী লীগের বেয়াদব সদস্যদের ছাঁটাই করা হবে। জাতীয় পরিষদ বা প্রাদেশিক বিধানসভা কোথাও তারা স্থান পাবেন না। স্বাধিকারের দাবি তুলে যাঁরা পাক-সৌধকেই ধ্বসিয়ে দিতে চেয়েছেন আর যাঁদের শায়েস্তা করার জন্য খান সাহেবকে এত মেহনত করে গতরের তেল ঢালতে হচ্ছে তাদের কি আবার জাতীয় পরিষদ বা বিধানসভায় ডেকে আনা যায়? তাই খান সাহেব স্থির করেছেন বরখাস্ত সদস্যদের স্থান তিনি পূরণ করাবেন তার মােসায়েবদের দ্বারা। আর সেজন্য উপ-নির্বাচনের প্রহসনও করা হবে।
ইয়াহিয়া খান বলেছেন, কোন রাজনৈতিক দল জাতীয় ভিত্তিক হলে ও তাকে নিষিদ্ধ করার সাংবিধানিক অধিকার থাকবে। আওয়ামী লীগই তার লক্ষ্য। কিন্তু তাঁর বড় পেয়ারের ভুট্টো সাহেবও তাে আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলেরই নেতা। গত সাধারণ নির্বাচনে তাঁর পিপলস পার্টি বাঙলাদেশে একটি আসনও পায় নি। নিষিদ্ধ দলগুলির তালিকায় কি তবে ভুট্টোর পিপলস পার্টিও পড়বে? গণতন্ত্রের অশ্বডিম্ব প্রসবের বেদনায় খান সাহেব হয়ত বেসামাল হয়ে অনেক প্রলাপই বকেছেন। তা না হলে যেখানে তিনি পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার জন্য আদাজল খেয়ে লেগেছেন সেখানে আঞ্চলিক দলে তাঁর অরুচি কেন? কোন অঞ্চলের দল হলেও পাকিস্তানের নাগরিক অধিকার তা তার যায় না। আসলে অখণ্ডতার কথা বলতে গিয়ে ইয়াহিয়া নিজেই পাকিস্তানকে খণ্ড খণ্ড করে দেখছেন। জলাতঙ্ক রােগী যেমন জল না দেখেও চিৎকার করে ওঠে, ইয়াহিয়া খানও আজ নিজের অস্ত্রে খণ্ডিত পাকিস্তানের সর্বত্রই তেমনি বিচ্ছিন্নতার দুঃস্বপ্ন দেখে ভয়ে আঁতকে উঠছেন। নিজের ছায়াই তাঁর ভীতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সূত্র: কালান্তর, ৩০.৬.১৯৭১