বাঙলাদেশের রাজনীতিক সমাধান
বাঙলাদেশের সমস্যার একটা রাজনীতিক সমাধান হােক এ ইচ্ছা পৃথিবীর কোন কোন রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রনায়করা প্রকাশ করেছেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রীও বিভিন্ন বক্তৃতায় এর একটা শান্তিপূর্ণ সমাধানের কামনা ব্যক্ত করেছেন। সীমান্ত গান্ধী খান আবদুল গফুর (গাফফার) খান মীমাংসায় পৌছানাের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের জঙ্গীশাহী ও বাঙলাদেশের নেতাদের মধ্যে মধ্যস্থতার প্রস্তাবও করেছিলেন। পাকিস্তানের জঙ্গীশাহী মেনে না নেওয়ায় ঐ প্রস্তাবের অপমৃত্যু ঘটেছে। তা সত্ত্বেও পাকিস্তানের নজীরবিহীন ঘটনার কোন রাজনীতিক সমাধান সম্ভব কিনা এ নিয়ে বিভিন্ন মহলে আজও গবেষণার শেষ নেই। রবিবার স্বাধীন বাঙলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম এক বেতার ভাষণে এই সমাধানের ভিত্তি সম্পর্কে ঐ সরকারের মনােভাব ব্যক্ত করেছেন।
এ পর্যন্ত যারাই রাজনীতিক সমাধানের কথা ভেবেছেন তারা প্রত্যেকেই পাকিস্তানের ঐক্য অক্ষুন্ন রেখে সমাধানের কথা হয়ত চিন্তা করছিলেন। বাঙলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান তাদের এই চিন্তাকে অবাস্তব এবং ভ্রান্ত বলে উল্লেখ করেছেন। “লাখাে শহীদের রক্তে ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তান মরে গেছে, তাকে আর বাঁচানাে যাবে না ”, সৈয়দ ইসলামের এই মর্মান্তিক উক্তির মধ্যে ভাবপ্রবণতার প্রাবল্য থাকতে পারে কিন্তু এটাই আজ বাঙলাদেশের কাছে বাস্তব ঘটনা। একই রাষ্ট্রের মধ্যে থেকেও যে পূর্ববাঙলা ভৌগলিক দিক থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল জঙ্গী রাষ্ট্র নায়করা শহীদের রক্তের নদী সৃষ্টি করে সবদিক থেকে তাকেই আজ সম্পূর্ণ পৃথক করে দিয়েছে। একে গোজামিল দিয়ে ঐক্যবদ্ধ রাখার কোন প্রয়াসই আর সফল হতে পারে না। অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে এবং সুস্পষ্ট ভাষায় সেই ঘােষণা করেছেন।
স্বাধীন বাঙলাদেশকে ভিত্তি করে সৈয়দ নজরুল ইসলাম সমস্যার সমাধানের যে চারটি পূর্বশর্ত দিয়েছেন। তার কোন একটিকে বাদ দিয়ে বাঙলাদেশের সমস্যার সমাধান করা যায় না। মুজিবর রহমান সমেত অন্যান্য গণপ্রতিনিধিদের মুক্তি, হানাদার বাহিনীর বাঙলাদেশ ত্যাগ, স্বাধীন, গণ-প্রজাতন্ত্রী সরকারের স্বীকৃতি এবং বাঙলাদেশের ক্ষয়ক্ষতিপূরণ ছাড়া বাঙলাদেশে কোন শান্তি প্রতিষ্ঠার চিন্তা প্রকৃতই অবাস্তব।
এই উপ-মহাদেশে বাঙলাদেশের মুক্তিযােদ্ধারা এবং সংগ্রামী জনসাধারণ স্বাধিকার ও স্বায়ত্তশাসনের জন্য যে আন্দোলন শুরু করেছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের একচেটিয়া পুঁজি, সামন্ততান্ত্রিক স্বার্থ এবং সামরিক জুন্টার মিলিত আক্রমণ তাকে রক্তের বন্যায় ডুবিয়ে দিতে চেয়েছিলাে। বর্ষার প্রবল জলরাশিকে শুধু বাঁধ দিয়ে ঠেকানাে যায় না। তার অবাধ প্রবাহের পথ করে না দিলে সে বাঁধ ভাঙ্গে। ইয়াহিয়ার বর্বর সৈন্যদের নিষ্ঠুরতার সেই বাঁধ আজ বাঙলাদেশের জনতা ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে এগিয়ে চলেছে। স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা, স্বায়ত্ব শাসন থেকে সার্বভৌমত্ব, পশ্চিমী পুঁজির নাগ পাশের বাঁধন শিথিল নয়, একেবারে ছিন্ন করার শপথে বাঙলাদেশের জনতা আজ সােচ্চার হয়ে উঠেছেন। জনতার সেই দুরন্ত আবেগকেই সমাধানের শর্ত রূপে বিশ্বের রাষ্ট্র নায়কদের কাছে হাজির করেছেন বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্র প্রধান।
বাঙলাদেশের সমস্যা অনেকদিন আগেই পাকিস্তান রাষ্ট্রের অভ্যন্তরিক বিষয়” এর গণ্ডী ছাড়িয়েছে। একটা সামরিক চক্রকে সামনে রেখে বাঙালী জাতিকে (ধর্মের ভিত্তিতে নয়) এবং বাঙলাদেশকে পশ্চিম পাকিস্তানের ঐ একচেটিয়া পুঁজির ঔপনিবেশিক শােষণের ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করার নীতি যেদিন থেকে গ্রহণ করা হয়েছে সেদিন থেকেই বাঙ্গালী জাতির স্বাধিকার ও আত্ম নিয়ন্ত্রণের সংগ্রাম ঘরােয়া আন্দোলনের সীমা অতিক্রম করেছে। আজ বাঙলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রামের সঙ্গে পরাধীন জাতিগুলির মুক্তির আন্দোলন প্রায় একাকার হয়ে গেছে। বাঙলাদেশের কোন সমাধানের কথা যারা চিন্তা করছেন তাঁদের দৃষ্টি যেন বাঙ্গালী জাতির মুক্তি আন্দোলনের এই দিকটা থেকে সরে না যায়-সৈয়দ নজরুল ইসলাম সেই জন্যই তাঁর সরকারের পক্ষ থেকে ঐ পূর্ব শর্তগুলি আরােপ করেছেন।
একটা স্থায়ী রাজনৈতিক সমাধানের জন্য বাঙলাদেশের বাঙালীরা ত প্রয়ােজনের তুলনায় অনেক বেশি দাম দিয়েছেন। চার থেকে পাঁচ লক্ষ বাঙালী রক্ত ঢেলেছেন, অর্ধ কোটি নর-নারী-শিশু সর্বস্ব ত্যাগ করে দেশের মাটির বাইরে দাঁড়িয়ে শত্রুকে ধিক্কার দিচ্ছেন-যদি প্রয়ােজন হয় আরও মূল্য দিতে তারা প্রস্তুত। কিন্তু বিনিময়ে তাঁরা চান মুক্তি, স্বাধীনতা। বাঙলাদেশের স্থায়ী রাজনীতিক সমাধান মাত্র ঐ একটিই। বাঙলাদেশ সরকার অবিচল নিষ্ঠার সঙ্গে সেই একমাত্র শর্তই আরােপ করেছে।
সূত্র: কালান্তর, ৮.৬.১৯৭১