আমার ভায়ের রক্তে রাঙানাে একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি
বেণু এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে এসেছিল। বহু অনুরােধে গানও গেয়েছিল। তারপর দীর্ঘকাল তার কোনাে খবর নেই। শােনা গেল সে মুক্তিফৌজ যােগ দিয়েছে, ফ্রন্টে গিয়ে যুদ্ধ করছে।
কত আর বয়েস? নিজের চোখে সে পঁচিশে মার্চ রাতে এবং পরবর্তী কয়েকটা দিন ঢাকা শহরকে পুড়তে দেখেছে। ছায়ানট’ গােষ্ঠীর শিল্পী বেণু তারপর আর গাইতে পারে না। তার সমস্ত বুক জুড়ে শুধু আক্রোশ আর অভিশাপ। তাই বেণু যুদ্ধে গিয়েছিল।
সেখান থেকে ঢাকা শহরে। কারণ ফৌজীদের বুটের তলায় দমবন্ধ অবস্থায় পড়ে থাকা সেই শহরে শাহন রয়ে গেছে। সে-ও গান গায়, রবীন্দ্র সঙ্গীত। ওদের বিয়ে হবার কথা ছিল। বেণু সেই দৈত্যপুরীতে ঢুকে বিয়ে করে বৌ নিয়ে সােজা কলকাতায় চলে এসেছে। এখন ওরা দুজনেই গান গাইছে। বেণু তারপর আবার ফ্রন্টে যাবে।
স্কোয়াড তৈরি হয়েছে বাঙলাদেশের শিল্পীদের। বাঙলাদেশ- সহায়ক শিল্পী সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী সমিতির অফিশে (১৪৪ লেনিন সরণি, কলকাতা ১৩) রােজ তারা মহলা দিচ্ছেন।
ঢাকা চট্টগ্রাম রাজশাহী খুলনা বাঙলাদেশের এই চারটি বেতার কেন্দ্রকে ঘিরে যে বিরাট শিল্পগােষ্ঠী ছিলেন-মাতৃভূমি ছাড়তে বাধ্য হয়ে শহর কলকাতায় আজ তারা একটিই শিল্পীদলে পরিণত। অনেকে অনেককে চিনতেন না, অনেকে অনেকের নাম পর্যন্ত শশানেনি। এখন তারা পরস্পরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, সহযাত্রী।
এখন কোনাে আঞ্চলিকতা নয়, আত্ম-অভিমান নয়-বাঙলাদেশের জন্য এখন তারা এক। পরস্পর পরস্পরকে গান শেখাচ্ছেন। একুশে ফেব্রুয়ারি একই গান কেউ গাইতেন ঢাকায়, কেউ রাজশাহীতে, কেউ চট্টগ্রাম, কেউ বা খুলনার গণ্ডগ্রামে। এখন তারা পাশাপাশি বসে সেই গান গাইছেন। উনসত্তরের আন্দোলনে এই গান বাধা হয়েছিল খুলনায় না ঢাকা চট্টগ্রামে এ-গান তাে কেউ শােনে নি। সবাই লিখে নিলেন ঃ “ব্যারিকেড বেয়েনেট, বেড়াজাল পাকে পাকে তড়পায় সমকাল….মানুষের কলিজা ছিড়ে খুঁড়ে খাবলায় খাবলায় নরপাল।”
এইভাবে গান বাছা হচ্ছে, শেখা হচ্ছে। ১৯৪৭ থেকে যে-গানগুলি গেয়ে পূর্ব-পাকিস্তান’ এই ১৯৭১ সালে ইতিহাসের দেউড়ি ভেঙে অমােঘ বাঙলাদেশ’ এ পরিণত হল-সেই গান। রবীন্দ্রনাথের, নজরুলের, গুরুসদয় দত্তর পরবর্তী কবিদের লেখা গান। শুনলে বােঝা যায়, কখন গান ইতিহাসের অঙ্গ হয়ে ওঠে, ইতিহাস তৈরি করে; কখন গান আর মুক্তিযুদ্ধকে পৃথক করা যায় না।
‘পূর্ব-পাকিস্তান’- এর বয়েস ছিল তেইশ বছর। কিন্তু তার কোনাে কেন্দ্রীয় এবং প্রতিনিধিত্বমূলক গায়কদল ছিল না। বাঙলাদেশ’- এর বয়েস কয়েক মাস। কিন্তু এরই মধ্যে তার কেন্দ্রীয় স্কোয়াড গড়ে উঠল।
দেশ-বিভাগের পর সীমান্তপারের সঙ্গীতশিল্পীদের এমন প্রতিনিধিত্বমূলক দল ভারতবর্ষে গান গাইবার সুযোগ
কখনাে পান নি। এইবার বাঙলাদেশ’-এর শিল্পীদের এই কেন্দ্রীয় স্কোয়াড আগামী তিন ও চার জুলাই রবীন্দ্র সদনে ভারতবাসীকে গান শােনাবে।
এই স্কোয়াড তারপর যাবে রিলিফ ক্যাম্পে, ট্রেনিং ক্যাম্পে। ঘুরবে ভারতবর্ষের প্রধান প্রধান শহরে। গায়ে। উদ্দেশ্য ঃ বাঙলাদেশের সংস্কৃতির পরিচয় দেওয়া, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনসমর্থন গড়ে তােলা।
অনেকের ঠিকমতাে আশ্রয় নেই, অনেকের দু’বেলা খাওয়া জোটে না। অনেকে পায়ে হেঁটে যাতায়াত করেন।
রােজ মহলা দিতে আসেন স্মৃতি পাল। কোলের বাচ্চাটা ক্ষিধেয় কাঁদে। স্বামী যুদ্ধে গেছে। মাস দুই পরে তার আরও একটা বাচ্চা হবে। তন্ময় হয়ে স্মৃতি গান ঃ
“একি অপরূপ রূপে মা তােমায় হেরিনু পল্লী জননী।”
গান গাইতে গাইতে দম আটকে আসে ফ্লোরার। ওয়েদুলভাই কানে কানে বলেন: দু’দিন না খেয়ে আছে।
রফিক বলেঃ তবু তাে আমরা ভালােই আছি। বুড়াে সেতারী সাহেব তিন টাকা রােজে দিনমজুরি করছেন।
হ্যা, ঠিক আছে। কল্যাণী বলে শুরু হােক তাহলে। ডালিয়া হাসে।
তারপর আবার মহলা শুরু হয়। হেঁড়া আর ময়লা সতরঞ্চির উপর শিল্পীরা গাদাগাদি করে বসেছেন। মাঝখানে আক্ষরিক অর্থেই ভাঙা একটা হারমােনিয়াম। প্রদীপ শিখার ভঙ্গিতে সেই বাজাচ্ছেন প্রায় কিংবদন্তীতে পরিণত শিল্পী সঞ্জিদা খাতুন। লম্বা রঙ ওঠা পুরনাে হলটা সম্মেলক গানের মাঝখানে হঠাৎ আর্তনাদ আর গর্জনে ডানা ঝাপটে উঠে। শিল্পীরা পরস্পরের মুখের দিকে তাকিয়ে একই সঙ্গে সেই অমােঘ পংক্তি উচ্চারণ করেন ?
“আমি কি ভুলিতে পারি!”
সূত্র: কালান্তর, ২.৭.১৯৭১