বাঙলাদেশের সংগ্রামের সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী চরিত্র (২)
ভূপেশ গুপ্ত
নিক্সন ইয়াহিয়ার প্রকাশ্য মিত্র
অতএব নিক্সন এখন বাঙলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধের মাধ্যমে যতটা রক্ষা করা যায় তা করার জন্য ইয়াহিয়া খানের প্রকাশ্য মিত্র হয়েছেন। কার্যত নিক্সন এখন ইয়াহিয়ার যুদ্ধকে নিজের যুদ্ধ রূপে গণ্য করছেন। অবশ্য এখনও বাঙলাদেশে আমেরিকার লড়াইয়ে সৈন্যরা আসে নি। ভিয়েতনামেও তাে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত তারা সৈন্য পাঠায়নি। মিত্রকে সৈন্য পাঠাতে হয় তবে সব সময়ে তার প্রয়ােজন হয় না।
আর একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণের জন্য নিক্সন প্রায় মরিয়া। বাঙলাদেশের সগ্রাম শেষ পর্যন্ত যদি জিতে যায়, যা জিতবেই এবং পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের যদি বাঙলাদেশ থেকে বের করে দেওয়া হয় তবে তা হবে ভারতের প্রসঙ্গে মার্কিন নীতির এক বড় ধরনের পরাজয়। এই নীতির একটা প্রধান অঙ্গ হল। ভারতপাক উত্তেজনাকে ধারাবাহিকভাবে সৃষ্টি করা। ভারতের পাশে শান্তি ও মৈত্রির নীতি নিয়ে বাঙলাদেশ দাঁড়ালে মার্কিন সমর্থিত পশ্চিম পাকিস্তানের সমরবাদী এবং উগ্র জাতীয়তাবাদীরা কেবল যে পঙ্গু হয়ে পড়বে তাই নয় তারা এমন এক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকটের আবর্তে পড়বে যার কোন সমাধান নেই। বাঙলাদেশের গৌরবজ্জ্বল সগ্রাম ওয়াশিংটনের ভারত সম্পর্কিত নীতির বিষ দাঁত ভেঙে দেবে এই সচেতনতা থেকেই নিক্সন বাঙলাদেশকে ইসলামাবাদের দখলে রাখার জন্য সর্বপ্রকার সাহায্যদানের সিদ্ধান্ত করেছে।
জনগণের জঙ্গী গণতান্ত্রিক অভ্যুদয়ের মধ্যে যে স্বাধীন বাঙলাদেশ জন্ম নেবে তা সমগ্র পূর্ব এবং দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় আমেরিকার অবস্থান গুরুতর খেললা না করে পারে না। এটা যে সমগ্র প্রগতিবাদ। মানবজাতির পক্ষে পরম লাভের কারণ হবে তা না বললেও চলে। ভিয়েতনামের সঙ্গে পাকিস্তানের বিপর্যয়কে যুক্ত করলে তা অনিবার্য ভাবেই সমগ্র মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের পক্ষে মারাত্মক আঘাতের সামিল হবে। বিশ্বের শক্তিগুলির ভারসাম্যে আরও পরিবর্তন হবে-শান্তি ও মুক্তির পক্ষের পাল্লা অনেক বেশী ভারী হবে।
একথা বােঝা যায়, যখন কোন বন্ধু-রাষ্ট্র তাদের নিজেদের অবস্থান থেকে, মুজিবর রহমানে এবং আওয়ামী লীগের সঙ্গে রাজনৈতিক মীমাংসার পরামর্শ দেন। এঁরা নির্বাচনের জয়লাভ করেছেন এবং পাকিস্তানের ভাগ্য নিরূপনের জন্য এরা জনগণের সুস্পষ্ট রায় পেয়েছেন। ঐ রাষ্ট্রগুলির নিজস্ব কূটনৈতিক এবং রাজনৈতিক কারণ আছে। আমরা একথা ভুলি না যে এমনকি ভারত এখনও বাঙলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেয় নি।
এই সব বন্ধু রাষ্ট্রের নীতি বাঙলাদেশের জনগণের প্রতি সহানুভূতি পূর্ণ এবং এটা সামরিক জুন্টাকে বিচ্ছিন্ন করতে সাহায্য করেছে। যাইহােক, ২৮ জুন ইয়াহিয়া খান বেতার ভাষণে রাজনৈতিক সমাধান হিসেবে যে ফর্মূলা দিয়েছেন তার মধ্যে “রাজনৈতিক সমাধানের পক্ষে গ্রহণীয় হতে পারে এমন সামান্যতম কোন ভিত্তি নেই। বন্ধু দেশগুলির নজর এ বিষয় থেকে নিশ্চয় সরে যেতে পারে না।
ইসলামাবাদের শাসকদের পক্ষে প্রকাশ্যে হস্তক্ষেপ করে নিক্সন প্রশাসন কোন রাজনৈতিক মীমাংসা এমনকি পূর্বের তুলনায়ও অসম্ভব করে তুলেছে। একমাত্র মীমাংসা যা বাঙলাদেশের জনগণের স্বাধীনতা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে তা হবে বাঙলাদেশের মুক্তিযোেদ্ধাদের অস্ত্রের জোরে। সেই মীমাংসা সেদিনই সম্ভব হবে যেদিন বাঙলাদেশের স্বাধীনতার পতাকা বিজয়গর্বে বাঙলাদেশে উড়বে।
ভারতের পক্ষে, বাঙলাদেশে মার্কিন হস্তক্ষেপ সেই একই নীতির ধারাবাহিকতা যা এই উপ-মহাদেশে সব সময়ে শান্তি, স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়েছে। এই নীতি হল মূলগত ভাবে ভারত -বিরােধী নীতি যা কখনও কখনও মিথ্যা এবং ভণ্ডামি পূর্ণ আশ্বাস দিয়ে সুন্দর করার চেষ্টা হয়। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা মনে করে যে, এই দেশে অর্থনৈতিক সাহায্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিং, ভারতীয় দূত এল, কে, ঝা এবং অন্যান্যদের বিদেশ ভ্রমণের জন্য নিয়ে যেতে পারে। কিন্তু এদেশের জনতাকে কখনও প্রবঞ্চিত করা যাবে না। বাঙলাদেশ থেকে অভূতপূর্ব শরণার্থী স্রোত এবং আরও কিছু গুরুতর সমস্যা ইসলামাবাদের শাসকগােষ্ঠী যার স্রস্টা তার ফলে ভারত যে গুরুতর পরিস্থিতির সম্মুখীন হবে একথা উপলব্ধি করে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা আন্তরিক ভাবেই খুশি। আমাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবন বিপর্যস্ত হওয়ার গুরুতর বিপদের সম্মুখীন আর মার্কিণ নয়া উপনিবেশিকতাবাদীদের পরিকল্পনায় এটাই খাপ খায়।
শরণার্থী সমস্যা, জনগণের অন্য সব জরুরী সমস্যাকে ছাপিয়ে যাচ্ছে। অন্তত শশাষকশ্রেণী বাঙলাদেশকে সমর্থনের নামে নির্বাচনের রায় কার্যকর করার জন্য সব রকমের প্রগতিশীল ব্যবস্থার রূপায়ণে বাধাদানের চেষ্টা করবে। মার্কিন সরকারের হিসেব হলাে ভারতের মধ্যে স্থায়ী উত্তেজনা এবং শরণার্থীদের বােঝা ভারততে এমন বিবৃত করে রাখবে যাতে অন্যান্য বিষয় এমন কি নির্বাচনের রায় কার্যকর করার দিকেও নজর দিতে দেবে না।
এ কথা স্বীকার করতেই হবে যে, ওয়াশিংটনে ভারতীয় দূত প্রতিরক্ষা দপ্তর এবং পেন্টাগণকে সংযত করতে ব্যর্থ হয়েছেন। এল, কে, ঝা আমেরিকানদের সঙ্গে যথােচিত ব্যবহার করার সম্পূর্ণ অযােগ্য কেবল এ কারণের জন্যই এটা হয়নি। ঐ অবসরপ্রাপ্ত আই সি এস ভদ্রলােকের অতীত রেকর্ড হলাে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের নির্লজ্জ দাসত্বের ইতিহাস এবং যে কেউ এই ভদ্রলােকের পূর্বাপর কিছু জানেন তাদের কাছে এ বিষয়টা অত্যন্ত পরিষ্কার। মনে হয় একজন যত বেশি আমেরিকার সমর্থক, তিনি ওয়াশিংটনের দূত হওয়ার পক্ষে তত বেশি উপযুক্ত।
অবশ্য মার্কিন প্রশাসনের পরিকল্পিত ভারত বিরােধী অভিযান প্রতিহত করার ভারতীয় কূটনীতির ব্যর্থতার এটাই প্রধান কারণ নয়।… যেগুলি মানি স্বরাষ্ট্র দপ্তরে পাকার হয় কিন্তু ভারতের ক্ষতি করার মৌলিক মার্কিন নীতির কোন পরিবর্তন হয় না। এমন কি ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সর্বশেষ সফরও ভারত সরকারের চোখ খুলতে ব্যর্থ হয়েছে।
শরণ সিং কৃতিত্ব
আমেরিকা সােভিয়েত ইউনিয়ন বৃটেন এবং অন্যান্য দেশ থেকে স্বদেশে ফেরার পর ২৫ জুন শরণ সিং সংসদের কাছে যে বিবৃতি দেন সেখানে বিভিন্ন রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গীর মূল্যায়ন কালে তিনি সােভিয়েত ইউনিয়ন এবং আমেরিকাকে একই পর্যায়ভূক্ত করে বলেন আমি যে দেশগুলি সফর করেছি সেই সব দেশের সরকারের সঙ্গে আলােচনার ফলে নিম্নলিখিত মতৈক্যের ক্ষেত্রগুলি পাওয়া গেছেঃ
১। কোন সামরিক সমাধান হতে পারে না এবং পূর্ববাঙলায় সব সামরিক কার্যকলাপ বন্ধ করতে হবে।
২। পূর্ব-বাঙলা থেকে ভারতে শরণার্থী আগমনের স্রোত অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে।
৩। শরণার্থী শান্তি ও নিরাপত্তার মাঝে যেন নিজ নিজ ঘরে ফিরে যেতে পারেন সে জন্য পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে এবং এটা হতে পারে যদি কেবল শরণার্থীর পূর্ব বাংলায় তাদের বাসস্থানে নিরাপদে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আশ্বস্ত করা যায়।
৪। পূর্ব বাঙলায় স্বাভাবিক অবস্থা পুনপ্রবর্তনের একমাত্র পথ হলাে ঐ দেশের জনগণের গ্রহণ যােগ্য রাজনৈতিক সমাধান।
৫। বর্তমানে পরিস্থিতি ঐ অঞ্চলের শাস্তি এবং নিরাপত্তার পক্ষে গুরুতর এবং বিপজ্জনক।
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের “মতৈক্য” এর এই প্রচণ্ড গুপ্ত কথাটি ফাঁস করে দেওয়ার আগে পররাষ্ট্র মন্ত্রী শরণ সিং সংসদ এবং জাতিকে আরও কিছুটা গুরুত্ব দিতে পারতেন। ঐ তথাকথিত মতৈক্যের প্রতিটি বিষয় নিক্সনী প্রশাসন বিরােধিতা করেছে। কোথায় শরণ সিং আমেরিকার শাসকবর্গকে সাফ সাফ কথা বলবেন তার বদলে তিনিই…
শান্তি মুক্তির জন্য অন্য সব বাদ দিলেও বাঙলাদেশের গণহত্যা এবং সন্ত্রাসের পেছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন যে কোন ব্যক্তিকেই একথা বিশ্বাস করাতে পারে যে ওখানকার বীর পুরুষ এবং মহিলারা কেবল তাদের মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকার এবং তাদের সম্মান অর্জনের জন্যই উঠে দাঁড়ান না, তাদের এই ঋজুতা আরও বৃহত্তর উদ্দেশ্য, শান্তি এবং মুক্তির উদ্দেশ্যেও। এখানেই এই সংগ্রামের সাম্রাজ্যবাদ-বিরােধ চরিত্রের উপাদান এবং আন্তর্জাতিক তাৎপর্যের মূল্যায়ন আর মার্কিন শাসকগােষ্ঠী প্রতিদিন এই তাৎপর্যকেই চাপা দেওয়ার চেষ্টা করছে, কোন ঘটনার ক্রম পরিণতির মাঝে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা যখন কোন দৃষ্টিভঙ্গি, অবলম্বন করে তখন প্রায় ক্ষেত্রেই ঐ সগ্রামের সামাজিক এবং রাজনৈতিক উপাদান বােঝায় সহায়ক হয়।
আড়ালে তাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য গােপন করতে পারবে। তারা এই হিসেবেও করে যে, মার্কিন অর্থনৈতিক সাহায্যের উপর নির্ভরশীল ভারত তার প্রতিবাদ জানাতে খুব বেশি এগােবে না।
স্বাধীন ভারতের প্রথম দিকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীলা কাশ্মীর প্রশ্নে হস্তক্ষেপ করে এবং বছরের পর বছর ভারতকে ব্ৰিত করে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ পাকিস্তানী শাসকবর্গকে সমর্থন জানালে আর তারা এই বিষয়টির পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে ভারত-বিরােধী বিদ্বেষকে জাগিয়ে তােলে এবং এইভাবে নিজেদের ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত থাকতে সাহায্য করে। যখনই কোন সীমান্ত ঘটনা ঘটেছে, তখনই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ একইভাবে ভারতকে দোষ করে এবং পাকিস্তানকে সমর্থন করে। ওয়াশিংটন এমনকি একবারের জন্যও পাকিস্তানী শাসকদের দোষ খুজে পায় নি। কল্পিত ভারত বিরােধী অভিযানকে প্রতিহত করায় ভারতীয় কূটনীতির ব্যর্থতার এটাই প্রধান কারণ নয়। ভারত সরকারের মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গী ছিল এবং আছে-দৃঢ়পণ কূটনৈতিক এবং রাজনৈতিক সংগ্রাম পরিচালনার পরিবর্তে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের খাতির করে চলার। বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিতের বিবৃতি এ প্রসঙ্গে স্মরণযােগ্য। ১৯৫১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর আমেরিকায় ভারতের রাষ্ট্রদূত হিসবে তিনি নিউইয়র্কে বলেছিলেন …“জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সাম্প্রতিক অধিবেশনে আমরা আপনাদের (আমেরিকা) মতই ৫১ বারের মধ্যে ৩৮ বার পক্ষে ভােট দিয়েছি, ১১ বার ভােটদানে বিরত থেকেছি এবং মাত্র ২ বার আপনাদের সঙ্গে একমত হতে পারিনি।”… কোথায় শরণ সিং আমেরিকার শাসকবর্গকে সাফ সাফ কথা বলবেন তার বদলে তিনিই তাদের দ্বারা প্রতারিত হয়েছেন। কিন্তু আমরা জানি শরণ সিং এর এই ভালােমানুষীর উৎস হলাে আমেরিকার প্রতি ভারত সরকারের দুর্বল নীতি।
তবুও, এই শরণ সিং কিন্তু সােভিয়েত সরকার যখন বলে যে, ১৯৭০-৭১ এর মধ্যে পাকিস্তানকে সােভিয়েত কোন সামরিক সরঞ্জাম দেয় নি একথা বিশ্বাস করেন নি। সােভিয়েত বিরােধী কুৎসার সুদৃঢ় প্রতিবাদ সত্ত্বেও শরণ সিং ৬ জুলাই লােকসভায় মন্তব্য করলেন ২৫ মার্চ এর পূর্বে সরবরাহ ২৫ মার্চ এর পর পৌচেচ্ছে এই সম্ভাবনা বাতিল করা যায় না। এ ধরনের ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য করার বিন্দুমাত্র কারণ ছিল না।…
সূত্র: কালান্তর, ১৯.৭.১৯৭১