You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.07.19 | বাঙলাদেশের সংগ্রামের সাম্রাজ্য বিরােধী চরিত্র | কালান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

বাঙলাদেশের সংগ্রামের সাম্রাজ্য বিরােধী চরিত্র
– ভূপেশ গুপ্ত

আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সর্বশেষ সংবাদে জানা গেছে পাকিস্তানে যে অস্ত্রবাহী জাহাজ পাঠানাে হচ্ছে। ক্রমে” কিংবা আমলাতান্ত্রিক ফাসের জন্য নয়, স্বয়ং প্রেসিডেন্ট নিক্সনের আদেশেই এসব ঘটছে। ইজাহার সেনেটর ফ্রাঙ্ক চার্চ সিনেটে দাঁড়িয়ে ৭ জুলাই এই সংবাদ ঘােষণা করেন যে আরও প্রায় ২৬ কোটি ৩৬ লক্ষ টাকার সামরিক সরঞ্জাম পাকিস্তানকে সরবরাহ করার সব ব্যবস্থা প্রস্তুত আছে।
নিক্সন প্রশাসন, বাঙলাদেশের বিরুদ্ধে ইসলামাবাদ প্রশাসনের অপরাধ সম্পর্কে বিশ্ব জনমতকে একেবারেই পরােয়া করে না, এতে আশ্চর্যের কিছু নেই, কারণ, পাকিস্তানকে প্রথমদিকে বিনামূল্যে এবং বর্তমানে নামকা ওয়াস্তে দামে এই অস্ত্র সাহায্য দান সব সময়েরই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ব রাজনীতির একটা গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হয়ে আছে। সেই নীতি যা ভিয়েতনামে বর্বর যুদ্ধকে স্থায়ী করে, আরব এবং অন্য আরব দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইস্রায়েলকে উত্তেজিত করে এবং মদত দেয় এবং সম্প্রতি বাংলাদেশে গণ-হত্যায় উস্কানি দেয় এবং সাড়ে সাত কোটি নরনারী একটি সমগ্র জাতিকে দমন করার কাজে সাহায্য করে।
এর মধ্যে থেকে বিশেষ করে দুটি জিনিস চোখে পড়ে। মার্কিন অস্ত্রগুলি একদা ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের সংখ্যা গরিষ্ঠ (শতকরা ৫৬) অংশের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হচ্ছে। এ হলাে পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তির মর্মান্তিক পরিণতি। এমন এক সময় ছিল যখন অনেকেই এমনকি সে দিনের পূর্ব পাকিস্তানেরও অনেকেই এই ভ্রান্তচিন্তায় আচ্ছন্ন হয়েছিলেন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র পাকিস্তানের প্রতিরক্ষার জন্য। আজ বাঙলাদেশের সমগ্র জনতা নিজেদের তিক্ত অভিজ্ঞতায় পাক-মার্কিন চুক্তির প্রকৃত অর্থ উপলব্ধি করতে পারছেন। যদিও সম্প্রতি ঘৃণ্য পরিস্থিতির আর একটি উল্লেখযােগ্য হল যে পিকিংকে ঠেকিয়ে রাখার জন্য পাক মার্কিন সামরিক চুক্তি রচিত হয়েছিল সেই পিকিং এখন ওয়াশিংটনের বাস্তব সহযােগীরূপে তাদের অভিন্ন বন্ধু এবং “বিশ্বস্ত মিত্র” ইয়াহিয়া খান এবং তার সামরিক জুন্টাকে সাহায্য দিয়ে যাচ্ছে। এই দলবাধা সম্ভবত পিকিং এর পিং পিং কূটনীতির প্রত্যক্ষ ফল।
বাঙলাদেশ প্রশ্নে নিক্সন তার মুখােশটা কেন খুলে ফেলেছেন? একটা জঙ্গী গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠিত দূরের কথা, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা বাঙলাদেশে কোন জঙ্গী গণতান্ত্রিক অভ্যুদয়ও সহ্য করতে নারাজ। ১৯৫৪ সালের পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তির একটি প্রধান লক্ষ্য ছিল তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচনের পরই যে জনপ্রিয় গণতান্ত্রিক শাসনের আবির্ভাবের সম্ভাবনা প্রায় দেখা দিয়েছিল তাকে যথাযথভাবে প্রতিহত করা।
পাকিস্তানের তখনকার রাজধানী করাচী থেকে এক আদেশনামায় নির্বাচিত সরকারকে বরখাস্ত করে, বিধানসভাকে বাতিল করে এক আধা-সামরিক স্বৈরতান্ত্রিক শাসনকে জোর করে বসিয়ে দেওয়া হয়। ঘৃণ্য মার্কিন দালাল ইস্কান্দার মির্জা যে সামরিক চুক্তির মাধ্যমে ইয়াঙ্কি সাম্রাজ্যবাদের কাছে দেশকে বিক্রী করার জন্য এক কলঙ্কজনক ভূমিকা পালন করেছিল তাকেই তৎক্ষণাৎ পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর রূপে নিয়ােগ করা হলাে। এক বছর পরে তাকেই পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল পদে বসানাে হলাে।
১৯৫৮ সালে আয়ুব খানের ক্ষমতা দখলের পূর্ব পর্যন্ত এর শাসন বজায় ছিল। এই সময়ে এর প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল প্রভু মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের পদতলে আত্মসমর্পণের নির্লজ্জতা এবং বিশ্বাসঘাতকতায় ভরা স্বভাবতই আয়ুব খানের আমলে সামরিক একনায়কতন্ত্রের জন্য রাজনৈতিক ঘাঁটি নির্মাণের উদ্দেশ্যে “বুনিয়াদী গণতন্ত্রের” মত কয়েকটি কাঁচা-কৌশল ছাড়া কোন মৌলিক পরিবর্তন হয়নি। এক যুগব্যাপী আয়ুবশাহীর প্রায় সমগ্র কালটা জুড়ে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা ঢালাও ভাবেই সাধারণভাবে গণতন্ত্রকে এবং বিশেষ করে পূর্ব বাঙলার জাতীয় আকাঙ্খাকে দমন করার কাজে আয়ুবকে সমর্থন দিয়েছে। জনগণ অবশ্য দিনের পর দিন ক্রমেই অধীর হয়ে উঠেছিলেন।
ইয়াহিয়া খা আসার পরও একই নীতি অব্যাহত থাকল। কারণ খুবই সহজ। পাকিস্তানে গণতন্ত্রের অর্থ হবে কেবল পাকিস্তানেই নয় বহুলাংশে সমগ্র পাক-ভারত উপমহাদেশে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের খেলার অবসান। গণতন্ত্রের অর্থ হবে, বাঙালী, সিন্ধী, বালুচি, এবং পাখতুন প্রভৃতি যে জাতিগুলি বহুজাতিক পাকিস্তানের ভিত্তি তাদের উপর শােষণের অবসান। গণতন্ত্রের অর্থ হবে পশ্চিম পাকিস্তানের ২২টি পরিবারের শােষণ ও লুণ্ঠনের অবসান না হলেও গুরুতর ক্ষতি। এবং সেই পাকিস্তান সামরিক জুন্টার এবং দুর্নীতিদুষ্ট ও লােভী আমলাদের স্বর্গ রাজ্য হবে না। তার থেকেও বড় কথা হলাে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ব-রণনীতির জন্য যে সাম্রাজ্যবাদী সমর্থক এবং আধা ফ্যাসিস্ট পাকিস্তানের প্রয়ােজন এই উপ মহাদেশে সেই রণনীতি প্রায় অকার্যকরী হয়ে পড়বে।
বাঙলাদেশের বর্তমান অভ্যুত্থানের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে হলে একথা মনে রাখতে হবে। ইতিহাসের যুক্তির দিক থেকে বাঙলাদেশের জনগণের সংগ্রাম মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের পক্ষে একটি আঘাত, একারণেই নিকসন কোন ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত নয়। আর সেজন্যই পাকিস্তানকে পাঠাননা জাহাজের সংখ্যা বাড়িয়ে চলেছে। আরও জানা গেছে, যে মার্কিন জাহাজগুলি বাঙলাদেশে পাক সৈন্য বহনের কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। ইসলামাবাদের অপরাধের সঙ্গে আমেরিকার রাজনৈতিক এবং সামরিক ঘনিষ্ঠতা প্রতিদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং বাঙলাদেশে ইয়াহিয়া খানের বীভৎস আক্রমণের পেছনে ইয়াহিয়ার সাম্রাজ্যবাদ অনুরাগের চেহারাটাও নগ্ন হয়ে পড়ছে।
পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি স্বাক্ষরের পর ১৭ বছরে কম পক্ষে ১৮৭৫ কোটি টাকার (২৫০ কোটি ডলার) মার্কিন অস্ত্র পাকিস্তানকে দান করা হয়েছে এবং এই অস্ত্র সাহায্য স্রোত কখনও বন্ধ হয় নি এমন কি ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত সংঘর্ষকালে প্রচারিত “নিষেধাজ্ঞা জারীর সময়ও এই সাহায্য বন্ধ হয়নি। পশ্চিম জার্মানী, তুরস্ক, ইরান এবং সৌদী আরব পাকিস্তানে অস্ত্র সবরাহের কাজে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে ক্লিয়ারিং এজেন্টের কাজ করে।
তাছাড়া, পাকিস্তান তার রাজনৈতিক কাঠামাের অনুরূপ অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকেও আমেরিকার নয়াঔপনিবেশিকতাবাদের উদ্দেশ্য সিদ্ধির অনুকূলভাবেই গড়ে তুলেছে। পাকিস্তানের জীবনের প্রায় সর্বক্ষেত্রেই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ গভীরভাবে শিকড় গেড়েছে। ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচন অবশ্য শুধু যে ইসলামাবাদের সাজানাে বাগানকে ধ্বংস করতে উদ্যত হয়েছিল তাই নয় সেই সঙ্গে ওয়াশিংটনেরও।
পাকিস্তানের ঘটনাবলীর বৈপ্লবিক মােড় পরিবর্তনকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা কিভাবে সহ্য করতে পারে? মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সৃষ্টির বিরুদ্ধে জনতার এক প্রাথমিক বিদ্রোহ জনগণের পর্যায়ে আওয়ামী লীগের নির্বাচন সাফল্যের জন্য বিরাট প্রভাব বিস্তার করেছিল। বিগত বছরগুলি জুড়ে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ তার আগ্রাসী পরিকল্পনা রূপায়নের উদ্দেশ্য যে সৌধ নির্মাণ করেছিল সাধারণ নির্বাচনের পর তা ধ্বংসের মুখে এসে পড়েছিল। পাকিস্তানের মাটিতে এবং প্রকৃতপক্ষে আমাদের এই উপমহাদেশে মার্কিন নীতির এই আসন্ন বিপর্যয়ের মুখে নিক্সন কি দশকের আসনে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে?

সূত্র: কালান্তর, ১৯.৭.১৯৭১