ভারতের মা বােনেদের কাছে বাঙলাদেশ
‘মহিলা পরিষদ’ সম্পাদিকা মালেকা বেগমের আবেদন
অধিকারগুলিকে দমন করার এক নিষ্ঠুর নীতি অনুসরণ করে চলেন আয়ুব। তাঁর শাসনকালেই পূর্ব বাঙলা ও পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যান্য ক্ষুদ্র প্রদেশ গুলিতে স্বায়ত্বশাসনের দাবি ও আন্দোলন শক্তির সঞ্চয় করেও তীব্রতা লাভ করে। আয়ুবের প্রচণ্ড দমননীতিও আন্দোলনের শক্তিবৃদ্ধি করে। ফলে ১৯৬৮-৬৯ সালে এক বিরাট গণ-অভ্যুত্থান একপ্রান্ত থেকে অপর প্রাপ্ত পর্যন্ত সমগ্র দেশকে উদ্বেলিত করে তােলে-আয়ুবের একনায়কত্বের পতন ঘটায়।
কিন্তু আয়ুবের স্থান অধিকার করে জেনারেল ইয়াহিয়া। বিরাট গণ-অভ্যুত্থানের ফলে জাগ্রত জনতার কাছে কিছু গণতান্ত্রিক দাবি দাওয়া মেনে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিতে হল এবং অবশেষে ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হ’ল। সামরিক চক্র ও দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়া হয়তাে এই নির্বাচনে সংখ্যা গরিষ্ঠতা লাভ করবে বলে আশা করেছিল। কিন্তু দেশের সাধারণ বিশেষ করে পূর্ব বাঙলার মানুষের গণতান্ত্রিক জাতীয়তা বােধের উত্তাল স্রোতের প্রচণ্ড শক্তি সম্বন্ধে তারা সঠিক ধারণা করে উঠতে পারে নি। নির্বাচনে জনতার রায় জাতীয় আত্ম-নিয়ন্ত্রণ অধিকার সম্বন্ধে জনসাধারণের আশা আকাঙ্খকে প্রতিফলিত করেছে। পূর্ববাঙলার প্রধানতম জাতীয় দল আওয়ামী লীগ সমগ্র পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। জেনারেল ইয়াহিয়া আওয়ামী লীগের ছয় দফা জাতীয়তাবাদী কর্মসূচীর কথা বেশ ভাল করেই জানাতেন। তবুও তাঁকে আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানেক পাকিস্তানের ভাবী প্রধানমন্ত্রী বলে ঘােষণা করতে হয়েছিল। আর এই ইয়াহিয়াই শেখ মুজিবরকে এই ছয়দফা কর্মসূচীর জন্যই দেশদ্রোহী বলে প্রচার করলাে। দেশদ্রোহী শেখ মুজিবর না ইয়াহিয়া? বাঙলাদেশের জনসাধারণ না ইয়াহিয়ার সৈন্যবাহিনী?
প্রকৃত ঘটনা হল যে নির্বাচনের ফল পাকিস্তানের শাসকচক্রকে সম্পূর্ণ আতঙ্কিত করে তােলে। কাজেই নির্বাচিত জন প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং গণতান্ত্রিক সংবিধান রচনার বিরুদ্ধে তারা ষড়যন্ত্র আঁটলেন।
বাঙলাদেশের মানুষ তাদের তিক্ত অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে এই ষড়যন্তের কথা জানলেন এবং তার বিরুদ্ধে একহয়ে দাঁড়ালেন। গত ২ মার্চ থেকে সারা দেশজুড়ে অহিংস অসহযােগ আন্দোলন শুরু হল সামরিক শাসকচক্র কোণ ঠাসা হল। এবং কার্যতঃ আওয়ামী লীগের নির্দেশিত কাজকর্ম চলতে লাগলাে।
এই পরিস্থিতিতেই সামরিক চক্র আলাপ আলােচনার মুখােশ পারে জনসাধারণের বিরুদ্ধে সামরিক প্রস্ততি চালাতে লাগলাে এবং ২৫ ও ২৬ মার্চ পাকিস্তানের ফ্যাসিস্ট সামরিক চক্র তাদের অস্ত্রাগারের সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আমাদের জনতার উপর অতর্কিতে আক্রমণ শুরু করল।
ভগ্নিগণ, বাঙলাদেশে পাক সামরিক চক্রের ভয়ঙ্কর গণহত্যা ও বর্বরতার বিস্তারিত বিবরণ আমি দিতে চাই না। কারণ এতদিন তার অনেক কিছু আপনারা জানতে পেরেছেন কিন্তু এই সামরিকচক্র বাঙলাদেশের মা বােনেদের উপর যে নির্মম নির্যাতন, যে বর্বর পাশবিক আক্রমণ, অত্যাচার চালিয়েছে সে সম্বন্ধে আপনাদের কাছে কিছু না বললে আমার অপরাধ হবে। পাকিস্তানী বন্য সৈন্যদল আমাদের মেয়েদের উপর যে নারকীয় অত্যাচার চালিয়েছে ইতিহাসে তার কোন নজির নেই। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও অন্যান্য জেলা শহরের ছাত্রীনিবাসগুলিকে এই রক্ত পিপাসুরা বধ্যভূমিতে পরিণত করেছিল। পরিবারের পুরুষদের সামনে নারীদের উপর বলাৎকার করার পর তাদের হত্যা করা হয়েছে। শহর গ্রাম অট্টালিকা, পুর্ণ-কুটীর-কোন কিছুই এই বর্বর অত্যাচার থেকে রেহাই পায় নি। লক্ষ লক্ষ মানুষ এই জিঘাংসার বলি হয়েছে। বাঙলাদেশের সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কারখানা হাটবাজার, হাসপাতাল আজ সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত। মায়ের কোলে সদ্যজাত শিশু এদের শিকার হয়েছে। আমার বন্ধু ও ভগ্নিগণ আমি নিৰ্দিদায় বলতে চাই যে আমাদের দেশের মানুষের উপর, আমাদের পুত্র কন্যাদের উপর যত অত্যাচার, যত নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ডই চলুক না কেন আমাদের কেউ আর পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারেব না। স্বাধীন ও সার্বভৌম বাঙলাদেশের জন্য আমাদের জনতার সংগ্রাম আমরা বিজয় লাভ না করা পর্যন্ত থামবে না। আমরা বিশ্বাস করি যে আমাদের বীর সন্তানরা মাতৃভূমির মুক্তির জন্য যে কোন ত্যাগ স্বীকারেই পিছিয়ে থাকবে না।
আমাদের সংগ্রামের বিজয় লাভের জন্য আমাদের এখন ও অনেক দুঃখ, অনকে কষ্ট সহ্য করতে হবে। দুনিয়ার প্রতিক্রিয়াশীল চক্র, অর্থাৎ সাম্রাজ্যবাদ বিশেষ করে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের কাছ থেকে আমাদের শত্রু পাকিস্তানী সামরিক চক্র সাহায্য পাচ্ছে। এই সামরিক চক্র চীনের মাওপন্থী কর্তৃপক্ষের কাছ থেকেও নৈতিক ও সামরিক সাহায্য পাচ্ছে।
দ্বিতীয়ত ও সম্পূর্ণ আইন সঙ্গত ভাবে গঠিত বাঙলাদেশের সরকারকে এখন ও স্বীকৃতি দেওয়া হয় নি।
তৃতীয়ত ও পাকিস্তানের এই শক্তিশালী সামরিক চক্রের বিরুদ্ধে আমাদের মুক্তি সংগ্রামে নৈতিক বৈষয়িক ও আর্থিক সাহায্য আজ অত্যন্ত প্রয়ােজন।
চতুর্থতঃ বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ আজ সহায় সম্বলহীন ক্ষুধার্ত, বাস্তহারা মানুষ আজ সহৃদয় বন্ধু ভারতের আশ্রয় প্রার্থী অত্যাচার, নিষ্ঠুর বর্বতায় আজ বাঙলাদেশের মানুষ সর্বহারা, রােগগ্রস্ত।
এত বিপর্যয়ের পরও শেষ পর্যন্ত আমরা জয়ী হবই। তাই পৃথিবীর বিভিন্ন জাতির কাছে, সমস্ত গণতান্ত্রিক মনােভাবাপন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে আমাদের আবেদন আমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসুন। বাঙলাদেশের শরণার্থীদের আগমনে ভারতের অর্থনীতি আজ বিব্রত। এই লক্ষ লক্ষ নরনারীকে খাদ্য ও আশ্রয় দান ভারতের পক্ষে এক কঠিন কাজ, তাই এমন অবস্থার সৃষ্টি করতে হবে যাতে বাঙলাদেশের মানুষ তাদের ঘরে ফিরে যেতে পারেন। বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানী দস্যুদের উৎখাত করতে না পারলে সে পরিবেশ সৃষ্টি করা সম্ভব নয় এবং সেই মনােভাব নিয়েই আমাদের এগােতে হবে।
ধর্মান্ধতা ও সামাজিক কুসংস্কার ভেঙে আজ আমাদের মা বােনেরা এগিয়ে এসেছেন বাঙলাদেশের ছেলেদের যুদ্ধক্ষেত্রে সাহায্য করতে। আমরা স্বাধীনতা সংগ্রামের সৈনিক, আমাদের মহিলা পরিষদ’ শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে মাতৃভূমির স্বাধীনতা সংগ্রামে লড়াই করবে। ২৫ মার্চের বীভৎস ফ্যাসিস্ট আক্রমণের আগেই আমাদের সদস্যরা সামরিক শিক্ষা গ্রহণ শুরু করেছেন। আমার প্রিয় বন্ধু ও বানেরা, জয়ী আমরা হবই। আপনাদের সাহায্য ও সহানুভূতি পাকস্তানী জঙ্গীশাহীকে উচ্ছেদ করতে আমাদের হাত শক্ত করবে। স্বাধীন বাঙলাদেশ ও বাঙালী জাতি দীর্ঘজীবী হােক।
সূত্র: কালান্তর, ২৮.৭.১৯৭১