You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.09.18 | বাঙলাদেশের ছাত্র আন্দোলন সম্পর্কে কয়েকটি তথ্য | কালান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

বাঙলাদেশের ছাত্র আন্দোলন সম্পর্কে কয়েকটি তথ্য

মহাশয়,
গত ১৭ সেপ্টেম্বর দৈনিক কালান্তরে যুব-ছাত্র সংবাদ প্রবাহ’ কলমে বাঙলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের এক গৌরবময় অধ্যায় ১৯৬২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বরের ঘটনা সম্পর্কে বাঙলাদেশে ছাত্র দিবস স্মরণে শীর্ষক যে সংক্ষিপ্ত সংবাদ ভাষ্য প্রকাশিত হয়েছে, তার জন্য দৈনিক কালান্তরকে অভিনন্দন করছি।
প্রকাশিত সংবাদ ভাষ্যে কয়েকটি তথ্যগত ভুল রয়েছে। বাঙলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাস সম্পর্কে আগ্রহী ও বর্তমান বাঙলাদেশ মুক্তি সংগ্রামের বিশ্বস্ত বন্ধু ভারতের ছাত্র-যুব সমাজ এবং গণতান্ত্রিক জনগােষ্ঠীর অবগতির জন্য ঐ ঐতিহাসিক ঘটনার যথাযথ তথ্য পরিবেশিত হওয়া প্রয়ােজন।
আইউব খান সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার পর পূর্ব বাঙলার জনগণের শিক্ষার গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব ও পূর্ব বাঙলার শিক্ষা সংস্কৃতির বিরুদ্ধে নতুন চক্রান্তের অংশ হিসেবে জাতীয় শিক্ষা কমিশন’ নামে একটি কমিশন নিয়ােগ করে, যে কমিশন শিক্ষাক্ষেত্রে সংস্কার সাধনের নামে কতকগুলি গণবিরােধী, অগণতান্ত্রিক ও প্রতিক্রিয়াশীল সুপারিশ করে যা প্রকৃতপক্ষে শিক্ষা সঙ্কোচনের নামান্তর। কমিশনের এই রিপাের্ট প্রকাশিত হয় ১৯৬২ সালে।
ঐ বছরের শুরু থেকেই পূর্ব বাঙলার ছাত্র সমাজ সামরিক শাসনাবরােধী ও মার্চ মাসে ঘােষিত আইউবের অগণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্রের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে দিয়েছিল। জাতীয় শিক্ষাকমিশনের রিপাের্ট প্রকাশের পর তা বাতিলের দাবীতে ও সার্বজনীন শিক্ষার অধিকারের দাবীতে আপামর ছাত্র সমাজের অংশ গ্রহণে ঐক্যবদ্ধ জঙ্গীরূপ ধারণ করে।
১৭ সেপ্টেম্বর প্রদেশব্যাপী ছাত্র ধর্মঘট আহূত হয়। ঐ দিন ঢাকায় ছাত্র মিছিলের উপর পুলিসের গুলি বর্ষণে কিশাের গােলাম মােস্তফা, ওয়াজিউল্লা সহ ১১ জন (সরকারী হিসাবে) ছাত্র শহীদ হন। আন্দোলনের চাপে সরকার সাময়িকভাবে জাতীয় শিক্ষা কমিশনের প্রতিক্রিয়াশীল রিপাের্ট বাস্তবায়ন স্থগিত রাখার কথা ঘােষণা করতে হয়। সেই থেকে পূর্ব বাঙলার সগ্রামী ছাত্র সমাজ প্রতি বছর এই দিনটিকে “শিক্ষা দিবস” হিসেবে পালন করে আসছে।
উল্লিখিত সংবাদ ভাষ্যে “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসব” সম্পর্কে যে ঘটনার উল্লেখ করা হয়েছে। তা প্রকৃতপক্ষে ঘটেছিল ১৯৬৪ সালে এবং ঐ সমাবর্তনে ভাষণ দেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করেছিল আইউব খান নয়, তার সুযােগ্য সাগরেদ মােনায়েম খান) ছাত্ররা স্বৈরাচারী সরকারের প্রতিভূ পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণরকে (তৎকালে অর্ধ-শিক্ষিত) মােনায়েম খান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর হিসাবে মেনে নেয় নি। সেক্ষেত্রে তাদের দাবি ছিল হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি অথবা সর্বজনমান্য নিরপেক্ষ কোন শিক্ষাবিদকে বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর পদে নিয়ােগ।
ছাত্র সমাজ আইউবের স্বেরাচারী সরকারকেই কোনদিন মেনে নেয় নি। তারা মােনায়েম খানের হাত থেকে তাদের শিক্ষাসমাপ্তির সার্টিফিকেট গ্রহণ করবেন না। তাই আইউবশাহী দীর্ঘ ছয় বত্সর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠান করাতে পারে নি। ১৯৬৪ সালে মােনায়েম খান কয়েক সহস্র পুলিস প্রহরাধীনে গায়ের জোরে সমাবর্তন অনুষ্ঠান করতে চেয়ে ছিল। ছাত্রদের জঙ্গী বিক্ষোভের মুখে মােনায়েম খান ভাষণ দিতে পারে নি, ছাত্র পুলিস সংঘর্ষে তথাকথিত সমাবর্তন উৎসব ও পণ্ড হয়েছিল।
তখন শিক্ষার গণতান্ত্রিক অধিকার স্বৈরাচারী আইউব শাহীর উৎখাত ও গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্রই ছিল মূল দাবি। অটোনমির দাবি তখন এমন সুস্পষ্ট ও সূচী মুখ তীক্ষ্মতা নিয়ে ছাত্রসমাজের দাবির মধ্যে ছিল না। আর পাঞ্জাবী পুলিসের আমদানিও তখন হয়নি। বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ ও আমলাতন্ত্রের হাতে দীর্ঘদিনের শিক্ষণপ্রাপ্ত পূর্ব পাকিস্তানের পুলিসবাহিনীকেই তখন ছাত্র আন্দোলন দমনের কাজে লাগানাে হত। অবস্থাবিশেষে সশস্ত্র বাহিনীর আমদানী হতাে।
ইতিবাঙলাদেশ ছাত্র ১৮.৯.৭১
বাঙলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের জনৈক কর্মী।

সূত্র: কালান্তর, ১৮.৯.১৯৭১