স্বাধীনতার ঊষা লগ্ন
নিজস্ব প্রতিনিধি
ভারতীয় সৈন্যবাহিনী বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে একযােগে ৭ই ডিসেম্বর যশাের ক্যান্টনমেন্ট ও সহর মুক্ত করলেন। মুক্তির ৪৮ ঘন্টারও কম সময়ের মধ্যে সেখানে উপস্থিত হতে পারা একটা উত্তেজনাপূর্ণ অভিজ্ঞতা। মনে হলাে বিগত পঁচিশ বছরে গড়ে ওঠা একটা প্রাচীর ভুল বােঝাবুঝি প্রসুত সন্দেহ ও ঘৃণার প্রাচীর অকস্মাৎ ধসে পড়ল। আক্রমণকারী পাক সৈন্যবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর বীর যােদ্ধারা সুনিপুণভাবেই পালন করেছেন, কিন্তু এটাই সব নয়। নিপীড়িতের স্বার্থরক্ষায় বল প্রয়ােগ করা ছাড়াও আরাে কিছু এ ঘটনার ভিতর দিয়ে গড়ে উঠেছে। পাক সৈন্যবাহিনীর আকস্মিক আক্রমণ সুরু হবার পর থেকে বিগত নয় মাস আমাদের এই প্রতিবেশীদের জন্য আমাদের মন ব্যথায় বিদীর্ণ হচ্ছে। স্বাধীনতা লাভের সময় এরা নিজেদের জন্য স্থান করে নিয়েছিলেন। তখন এরা বুঝতেই পারেননি যে একই ধর্মাবলম্বী ক্ষুদ্র একটি গােষ্ঠী সমস্ত সভ্য রীতিনীতি বিসর্জন দিয়ে নিজেদের কলেবর বৃদ্ধি করতে সচেষ্ট হবে। প্রাকৃতিক বাধার দেয়াল ছাড়া অন্য সব বাধাই এই বছরের গােড়ার দিকে ভেঙ্গে পড়ল, কারণ বাংলাদেশের উৎসর্গিত প্রাণ মুক্তিযােদ্ধারা এমন এক ধরনের প্রতিরােধ গড়ে তুললেন, মানব ইতিহাসে যা অনন্য, অতুলনীয় এবং অভূতপূর্ব।
তারা বিশ্বের সমস্ত দেশের ন্যায়বিচার বােধের ওপর বিশেষত সেই সব শক্তিমান ও সমৃদ্ধিশালী প্রাক্তন ঔপনিবেশিকতাবাদীরা-যারা গণতান্ত্রিক মূল্যবােধের ওপর তাদের আস্থা বরাবর ঘােষণা করেছেনতাদের ন্যায়বিচার বােধের ওপর অগাধ বিশ্বাস রেখেছিলেন। কিন্তু চিতাবাঘ তার রং পাল্টাতে পারে না। এই সব সমৃদ্ধিশালী দেশ বাস্তব ঘটনা থেকে মুখ ঘুরিয়ে থাকলেন-ভৌগলিক অখণ্ডতা রক্ষার নামে যা অনুষ্ঠিত হচ্ছে তা দেখে আতঙ্কিত শিউরে উঠে নয়, বরং যা কিছু সভ্য রীতিনীতিসম্মত, তার সব কিছুর প্রতি নির্মম অবজ্ঞা। এক কোটি শরণার্থীদের জন্য তাদের সমবেদনা নিছক ভণ্ডামী। কিন্তু পাকিস্তানের গণহত্যা রক্তঝরান নিষ্পেষণের প্রতি চোখ বুজে রইলেন তাঁরা। ৯ই ডিসেম্বর যশােরের মুক্ত এলাকায় প্রথমবার প্রবেশের জন্য বেনাপােলে সীমান্ত অতিক্রম করার সঙ্গে সঙ্গেই এই সব কথা প্রথমেই মনে হলাে। যশাের রােডের এই অংশে বিরাট বিরাট গাছ রাস্তার ওপর দিয়ে খিলান তৈরি করেছে। ফলে এই পথটি অন্যতম সুন্দর রাজপথে পরিণত হয়েছে। চতুর্দিক শান্ত, কিন্তু কি অস্বস্তিকর নীরবতা। প্রথম দু মাইলের মধ্যে কাউকে দেখতে পেলাম না। সংবর্ধনা লাভ তাে দূরের কথা। সংকীর্ণ বাধানাে রাস্তার ঠিক দুই ধার বরাবর প্রচুর ঝােপঝাড় দেখা গেল। কোনদিকে কোন পথিক নজরে পড়ল না।
সুতরাং রাস্তাটি নিশ্চয়ই ব্যবহার করা হয়নি। দু ধারে কয়েকটি বাড়ি দেখা গেল। দেখে মনে হলাে পােড়ড়া, কোন কোনটির আবার ছাদ বা দরজা জানালা নেই। চতুর্থ মাইলে আমরা দীর্ঘ একটি বাঙ্কার দেখতে পেলাম, ঘাস গজিয়ে এটাকে বেশ লুকিয়ে রাখা হয়েছে। এটাও অবশ্য পরিত্যক্ত কারণ ভারতীয় সেনাবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর সামনে পড়ে পাক সৈনিকরা উর্ধ্বশ্বাসে পালিয়েছে। আরও কয়েক মাইল যাওয়ার পরে আমরা নাভারণে পৌছলাম। সীমান্ত থেকে সাত মাইল দূরে। পলায়নপর পাক বাহিনী বেতনা নদীর ওপর সেতুটি সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিয়ে গেছে। এই সেতুটি শ’দুয়েক গজ দূরে এরই সমান্তরালে রয়েছে বেনাপোেল ও যশােরের মধ্যে সংযােগ রক্ষাকারী রেল সেতুটি, সেটিও দু’একটা থামের ওপর বিপজ্জনকভাবে ঝুলছে। বেনাপােলের দিক থেকে লােকজন নিয়ে এক সারি গাড়ী যেতে দেখে বেশ কিছু গ্রামবাসী হঠাৎ এসে হাজির হলেন, তাঁদের বেশীর ভাগই চাষী এবং ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। স্থানীয় মুদি আবদুর মান্নানের কাছে শােনা গেল কিভাবে তাকে ছােট দোকানটি ফেলে পালাতে হয়েছিল। তার অপরাধ তার জন্মস্থান ফরিদপুর জেলা শেখ মুজিবুর রহমানেরও জন্মস্থান। সুতরাং তার কপালে লাঞ্ছনা অবধারিত ছিল। নাভারণে স্থানীয় জনসাধারণের সক্রিয় সহযােগিতায় সৈন্যবাহিনীর ইঞ্জিনিয়াররা ধানক্ষেতের ওপর দিয়ে দ্রুত একটি রাস্তা মাঝামাঝি আমরা থেমে গেলাম কারণ উল্টোদিক থেকে কয়েকজন স্থানীয় গ্রামবাসীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর কজন স্বেচ্ছাসেবক আসছিলেন।
কয়েকজন সৈন্যবাহিনীর ট্রাক আসছিল জওয়ানদের নিয়ে। সেগুলি জায়গা ছেড়ে দেয়ার জন আমাদের ঐ কাঁচা রাস্তার একধারে থামতে হলাে। কয়েকটি কিশাের দৌড়ে এসে আমাদের অভিনন্দন জানাল, তাদের ঐ এলাকা মুক্ত হওয়ার আনন্দ প্রকাশ করল। নাম না জানা এক বনফুলের মুদু সৌরভে আকাশ বাতাস ভরে গেল। বয়স্ক এক বিদেশী সাংবাদিক বুক ভরে শ্বাস নিয়ে আমাকে ঐ ফুলের নাম জিজ্ঞেস করলেন। অজ্ঞতার জন্য নিজেকে ধিক্কার দিলাম। কপােতাক্ষ তীরে ঝিকরগাছা জমজমাট এক গঞ্জ ছিল। এই স্থানটিও পাক লুঠেরাদের লুণ্ঠনের ছাপ বহন করেছে। নদীর ওপর দিয়ে দুটি সমান্তরাল সেতু ছিল-রাজপথ ও রেল সেতু। পশ্চাদাপশরনকারী দখলদার বাহিনী শেষ পর্যন্ত দুটোই উড়িয়ে দিয়ে গেছে। স্থানীয় অধিবাসীদের সাহায্যে আমাদের সেনারা নদীর ওপর যে ভাসমান সেতু বানিয়েছেন, তার ওপর দিয়ে পালা করে পেরােতে হচ্ছে। আমাদের পালার জন অপেক্ষা করতে করতে আমরা স্থানীয় লােকজনের কাছে ঘটনার বিবরণ শুনলাম। বেশ কয়েকদিন পরে তারা সাপ্তাহিক হাটের জন্য জমা হয়েছেন।
আবদুল মিঞাকে পাক সৈন্যদের হুমকিতে ঘর ছেড়ে পালাতে হয়েছিল। ছােট এক দোকানদার মুসলিম মিঞা ভয়াবহ সব কাহিনী বললেন। চাল ও ময়দার খোজে পাক বাহিনীরা প্রায়ই তার দোকান লুট করত। পরে তিনি দোকান বন্ধ করে দিলেন এবং পাক সেনার রােষবহ্নি এড়াতে আরাে ভেতরের দিকে পালিয়ে গেলেন। ইতিমধ্যে আমাদের সংবর্ধনা জানাতে এবং স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে ছােটখাট এক জনতা ভিড় করেছে। কিছু সবজি ওয়ালা ঝুড়ি ভর্তি বেগুন ও মূলাে নিয়ে বাজারের পথে যেতে আমাদের কাছে ভিড় করলেন। চাষের খবর জিজ্ঞাসা করতেই সকলে একবাক্যে বললেন যে, চাষের কাজ এবার খুবই বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কেননা বড় রাস্তার দুধারে পাক সেনা বহু মাইন পুঁতে রেখে গেছে। প্রকৃতপক্ষে ডিসেম্বরে প্রথম সপ্তাহে দুজন লােক ধান ক্ষেতে মাইন বিস্ফোরণের ফলে মারা গেছে। আশ্চর্য দ্রুততার সঙ্গে আমাদের সৈন্য বাহিনী এই ভাসমান সেতুটি তৈরি করেছেন। এর থেকে যেটা প্রতীয়মান হয়েছে তা হল এই যে আমাদের সৈন্য দলের দক্ষতা অসীম এবং স্থানীয় যে সব যুবক স্বেচ্ছাশ্রম দিতে এগিয়ে এসেছেন, তাঁদের কাছ থেকে যে সাহায্য আমাদের সেনারা পেয়েছেন, তা অমূল্য। সর্বময় কর্তৃত্বে ছিলেন মেজর রাজন, তিনি এবং তার সহকারী লেফটেন্যান্ট রাজপুত, উভয়েই জওয়ানদের এবং স্থানীয় যুবকদের কর্তব্যপরায়ণতার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেন।
কপােতাক্ষের ওপারে আমাদের সঙ্গে দেখা হল মুক্তি বাহিনীর কয়েকজন সৈনিকের। তাদের কাঁধ থেকে বন্দুক ঝুলছে। দুজন আমার হাত ধরে একটা ছােট্ট চায়ের দোকানে টেনে নিয়ে বসালেন এবং তাদের সাধারণ খাবারের ভাগ নিতে ও চায়ে চুমুক দিতে দিতে গল্প করার জন্য অনুরােধ জানালেন। কিন্তু কনভয় তখন যাত্রার জন্যে প্রস্তুত, সুতরাং তাদের বিজয় অভিযানের গল্প আমার আর শােনা হল না, চায়ের লােভও ছাড়তে হলাে। এরপর থেকে রাস্তার দুধারে লােকজন চোখে পড়তে লাগল। প্রথমে অল্প অল্প, কিন্তু যতই আমরা যশােরের দিকে এগােতে লাগলাম, ততই সেই সংখ্যা বাড়তে লাগল। ঝিকরগাছা থেকে যশােরের দুরত্ব ন মাইল। যশােরের কাছাকাছি পুলের হাটে বেশ লােকজন দেখতে পেলাম। পুলের হাটে একটা সরু খালের ওপরের একটা ছােট সেতু উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সুতরাং যশাের রােডে ওঠার জন্য আমাদের আবার ধানক্ষেতের ভিতর দিয়ে ঘুরতে হল। বেলা ১১:৩০ মি. নাগাদ আমরা যশাের শহরের ঠিক উপকণ্ঠে। এই উপকণ্ঠে এই সংযােগস্থলে পৌছুলাম এবং ক্যান্টনমেন্টে যাওয়ার জন্য বাঁ দিকে ঘুরলাম। সংযােগস্থলে বেশ লােকজন জমেছে। তাদের স্বতঃস্ফূর্ত ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে আকাশ বাতাস ভরে উঠছে। বেলা ১১-৩০ মি. আমরা যশাের ক্যান্টনমেন্টে পৌছুলাম।
নবম পদাতিক ডিভিশনের ডিভিশনাল কমান্ডার দেশপান্ডে কীভাবে প্রথমে যশাের বিমানক্ষেত্র এবং তারপর বয়রা সীমান্ত থেকে খােদ ক্যান্টনমেন্টাই দখল করলেন, তার একটা বর্ণনা আমাদের দিলেন। সেক্টরের একটা বিরাট মানচিত্রের ওপর তার ছড়ি দিয়ে কর্ণেল আমাদের সমস্ত জিনিসটা ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিলেন। কোন পথে তিনি এগিয়েছেন এবং কোন দ্রুত অগ্রগতির ফলে তিনি সামান্য ক্ষয়ক্ষতির ভেতর দিয়ে ক্যান্টনমেন্ট দখল করতে পারলেন, সে সবই ব্যাখ্যা করলেন। ভারতীয় বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে পালানাের তাড়ায় পাক সেনারা যে বিপুল সমরসম্ভার ফেলে গেছে তাও আমরা দেখলাম। তাড়াতাড়িতে ওরা অন্যান্য জিনিসপত্র নষ্ট করে ফেলতে পারেনি। পাকিস্তানী হানাদারদের সম্পর্কে ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর নীতি কর্ণেল ব্যাখ্যা করলেন ; বললেন, এই নীতির উদ্দেশ্য ওদের আত্মসমর্পণ করানাে। তিনি আরাে বলেন যে তারা ইতিমধ্যেই পূর্ণসামরিক মর্যাদায় ৪০জন মৃত পাক সৈনিককে সমাধিস্থ করেছেন। এরা সবাই ছিল ২৭তম বালুচ রেজিমেন্টের সৈনিক।
ক্যান্টনমেন্ট থেকে আমরা খুলনার পথে এগােলাম এবং যশােরের কয়েক মাইল দক্ষিণে পিকনিক কর্ণার বলে একটা জায়গায় আধ ডজনের মত পাক বাহিনীর পােড়া জীপ দেখতে পেলাম। ন’টি মৃতদেহও পড়েছিল, তার মধ্যে এক জায়গাতেই ছ’টি। পালানাের পথেই পাক ফৌজ ধ্বংস করতে করতে গেছে। আগুনে পােড়া বাড়ি, লুষ্ঠিত দোকান এবং রূপদিয়ার কাছে একটা মসজিদও চোখে পড়ল, তার গায়ে মেশিনগানের বুলেটের দাগ। বেলা ১-৩০ টায় আমরা যশাের থেকে মাইল দশেক দূরে সিঙ্গিয়াতে পৌছুলাম। এখানে আমাদের সঙ্গে পলায়মান পাক সেনার পশ্চাদ্ধাবমান বীর ভারতীয় বাহিনী দেখা গেল। হঠাৎ আমাদের চৈতন্য হলাে যে আমরা পাক বাহিনীর মাত্র ১০০০ গজের মধ্যে রয়েছি। ভারতীয় সেনাদলের অগ্রগতিতে বাধা দেয়ার জন্য পাক সৈন্যবাহিনী চেঙ্গুটিয়ায় সাময়িক ভাবে ট্রেঞ্চ খুঁড়ে বসেছে। আমাদের পথপদর্শক মেজর আমাদের রাস্তার একাধারে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়তে বললেন। শীগগিরই আমরা অন্য দিক থেকে মেশিনগানের আওয়াজ শুনতে পেলাম। আমরা দেখলাম আমাদের বীর যােদ্ধারা রকেট লঞ্চার, মর্টার ও কামান নিয়ে শত্রুর গােলাবর্ষণের পাল্টা জবাব দেওয়ার জন্য তৈরি। আমাদের জওয়ানরা রাস্তার দুপাশে এবং বড় রাস্তার সমান্তরালে অগ্রসরমান রেল লাইন বরাবর তৈরী হয়ে বসলেন।
মেজর খুব ব্যস্ত। তিনি ওয়াকি টকি মারফৎ সংবাদ নিচ্ছেন ও তাঁর উর্ধ্বতন অফিসারের সঙ্গে কথা বলছেন। আধ ঘন্টাখানেক সত্যিকারের লড়াই চোখে দেখার পর ২-৩০টার সময় আমরা যখন এক মাইল পিছনে রাখা আমাদের গাড়িগুলােতে ফেরার কথা ভাবছি, তখন মেজরের মুখ আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। তিনি আমাদের জানালেন যে, ১৫ মিনিটের মধ্যেই বিমান সাহায্য আসছে। উত্তেজনায় তখন আমরা এত অধীর যে নড়াচড়া না করে স্থির করলাম যে আর কয়েক মিনিট থেকে আমাদের বিমান বাহিনীর আক্রমণ চোখে দেখে যাব। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের জেট বিমানগুলাে মাথার ওপর এসে গেল এবং মুহূর্তের মধ্যে শত্রু ঘাটির ওপর ছোঁ মারল। যুদ্ধ প্রত্যক্ষ করার যে ঝুঁকি নিয়েছিলাম এত কাছ থেকে বিমান আক্রমণ দেখতে পাওয়ার সে ঝুঁকি যথার্থ মনে হলাে।
আমাদের বীর সেনাদের শত্রুদের পশ্চাদপসরণ এক দুর্লভ দৃশ্য। ফেরার পথে আমরা দেখতে পেলাম আমাদের গােলন্দাজ বাহিনীকে তারা সংগ্রামরত পদাতিক বাহিনীর পেছনে দাঁড়াচ্ছেন। অসংখ্য গ্রামবাসী গ্রামের কাছে রাস্তার দু’পাশে স্বাধীনভাবে ঘুরছেন আমাদের জওয়ানদের অগ্রগতি দেখছেন এবং মাঝে মাঝেই জয় বাংলা ধ্বনিতে তাদের উৎসাহিত করছেন। সত্যিই এটা একটা দেখার মতাে দৃশ্য! অত্যাচারের আশঙ্কায় বেশ কমাস ধরে তারা পাক বাহিনী থেকে অনেক দূরে লুকিয়ে ছিলেন। কিন্তু যখন তারা দেখলেন যে জওয়ানরা তাদেরই বাসভূমিতে তাদের পূনর্বাসন করানাের জন্য সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছেন, তখন তারা আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে জওয়ানদের সফল কামনা করলেন। দুপক্ষের গােলাগুলির মধ্যে পড়ে গেলে যে কি সর্বনাশ হবে সে সম্পর্কে ভ্রুক্ষেপ না করে তারা ভারতীয় সৈন্যদের এবং মুক্তিবাহিনীর অন্তর্ভুক্ত তাদের ভাইবন্ধুদের সাধ্যমত সাহায্য করছেন। ফেরার পথে আমরা বেশ কয়েক জায়গায় বেশ লােজন দেখলাম। ফেরার পথে ঝিকরগাছায় মুক্তিবাহিনীর সেই স্বেচ্ছাসেবকদের খুঁজলাম যশােরে পৌছুনাের তাড়ায় আমি যাদের এগিয়ে দেওয়া চায়ের কাপ ফেলে গিয়েছিলাম। তাদের খুঁজে পেলাম না। দোকানদার ভদ্রলােক বললেন যে ওরা ওদের নির্দিষ্ট কর্তব্য পালন করতে চলে গেছেন।
পশ্চিমবঙ্গ : ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১
Reference:
গণমাধ্যমে-বাংলাদেশের-মুক্তিযুদ্ধ – মুনতাসীর মামুন