বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ কি প্রবল দুর্ধর্ষ আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের প্রচণ্ড দাপটে শেষ হয়ে গেল? এ প্রশ্ন আজ সকলেরই মনে। ভেতরের কোন সঠিক খবর আসছে না। দলে দলে শরণার্থী বাংলার সীমান্ত পার হয়ে ভারতে আশ্রয় নিচ্ছে। কারাে মুখে বিশেষ কোন আশার সংবাদ শােনা যাচ্ছে না। অত্যাচার চলেছে। ধ্বংসলীলা তেমনিই নিষ্ঠুরতার সঙ্গে অব্যাহত তবু কথাবার্তা বললে বােঝা যায় যে জয়ের সুনিশ্চিত সম্ভাবনা ঈশ্বরে বিশ্বাসের মত মনের প্রান্তে প্রান্তে লেগে আছে। যে কাউকেই প্রশ্ন করা যায় উত্তর পাওয়া যায়, জিতব আমরা নিশ্চয়ই সেনাপতি ওসমানও বলেছেন, কেউ আমাদের অস্ত্রশস্ত্র দিক বা না দিক যুদ্ধ আমরা মধ্যপথে ছেড়ে দেব না। জিততে আমাদের হবেই এবং জিতব আমরা নিশ্চয়ই।
পৃথিবীর ইতিহাসে দেখা গেছে স্বাধীনতার স্পৃহাকে কিছুদিন পর্যন্ত অস্ত্রের জোরে দাবিয়ে রাখতে পারলেও চিরদিনেরজন্য তা পারা যায় না। তবে প্রকাশ্যে আয়ােজিত সৈন্যে সৈন্যে ঘােষিত যুদ্ধ গুপ্ত গহ্বরে নেমে যায় এবং দীর্ঘ দিন ধরে চোরা পথে হানাহানি চলতে থাকে। যারা কোনরকম নরহত্যাকেই সমর্থন করতে পারে না বা করে না তাদের কাছে এই যুদ্ধ একটি বিরাট সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। সৈন্যে সৈন্যে যুদ্ধের ব্যাপার সভ্য মানুষ অনেক দিন আগেই চুকিয়ে দিয়েছে। অধিকার নিয়ে দ্বন্দ্ব, যুদ্ধের প্রবর্তনা চিরকালই মনুষ্য সমাজে ছিল। কিন্তু হাজার হাজার বছর আগেও যুদ্ধের কতগুলি নিয়ম মানা সভ্যতার অঙ্গ বলে মনে করা হত। ভারতীয় চিন্তায় ধর্মযুদ্ধের মহৎ আদর্শ কুরুক্ষেত্র কাহিনীর ছত্রে ছত্রে আছে। যে ২৩টি নিয়ম লক্ষ্মনের কাহিনী আছে সেগুলি মহা মহারথীদের স্থলন ও পতন বলে চিহ্নিত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত যুদ্ধক্ষেত্রে সভ্যতার নিদর্শনরূপে কতগুলি নিয়ম ছিল। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর থেকে সেই লক্ষণ বর্তমান পৃথিবীর সুসভ্য মানুষ বিসর্জন দিয়েছে। শিশু, নারী, বৃদ্ধ, রুগী- সভ্যতা ও সংস্কৃতির নিদর্শন জনপদ, লাইব্রেরী কিছুই আজ রক্ষা পায় না। হিরােসিমা ও নাগাসাকিতে এই বর্বরতা চূড়ান্ত দেখা গিয়েছিল। অথচ এও ঠিক যে মানুষের প্রতি মানুষের বিশ্বাস কিছুতেই হারাতে চায় না। পূর্ববাংলায় তার দৃষ্টান্ত আমরা দেখতে পেয়েছি।
সেখানকার মানুষরা কি চেয়েছিল? নিজের ভাষায় কথা বলতে, নিজের সুরে গান গাইতে, নিজের অন্ন নিজে খেতে, এতই-কি বেশি চাওয়া যে এভাবে তার উত্তর এল? গত বিশ বছর ধরে পাকিস্তানের মানুষ এই সামান্য প্রার্থনা নিয়ে তাদের আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। বারেবারেই তাদের ওপর নির্যাতন, অত্যাচার ঘটেছে। তা সত্ত্বেও তারা ভাবতে পারেনি শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে এমন ভয়ানক গণহত্যা দিয়ে স্তব্ধ করা হবে। তারা বিশ্বাস করেছিল যে সমস্ত দেশের জনমতকে অগ্রাহ্য করলেও সমগ্র দেশকে তারা এভাবে ধ্বংস করে ফেলবে না। যদি সন্দেহ থাকত তাহলে কিছু অস্ত্রশস্ত্র তারা সংগ্রহ করত। অন্তত ভারত তাদের স্বীকৃতি দেবে কিনা একটুকু তারা আগে খবর নিত। ভারতের সৌভ্রাত্র, মানব প্রেম যা রেডিয়াে মারফৎ প্রতিদিন উচ্ছ্বসিত হচ্ছিল তার গভীরতা হয়তাে তারা পরীক্ষা করে দেখত, অন্তত ভারত তাদের স্বাধীনতা সংগ্রামকে জয়ী করতে ইচ্ছুক কিনা, না কেবল শত শত গৃহহীন লোেক বিড়ম্বনাময় শরণার্থীতে পরিণত করে কর্তব্য শেষ করবে, সেটুকু খবর নিত। যুদ্ধের জন্য যাদের কোন প্রস্তুতি ছিল না যারা শান্তিপূর্ণ উপায়ে আলােচনার মাধ্যমে সম্পূর্ণ ঐক্যবদ্ধ হয়ে সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজছিল এবং যুদ্ধজয়ের কৌশল হিসাবে কোন বৃহৎ শক্তির পক্ষপুটে আশ্রয় নিতেও চেষ্টা করেনি তাদের উপর অতর্কিতে পড়ল এই ভয়ংকর যন্ত্রশক্তির প্রবল আক্রমণ।
পরের কাছে ধার করা অস্ত্র নিয়ে নিজের লােককে মারছে পাকিস্তানীরা। তাদের বর্বরতার উৎস সন্ধান করলে আমরা পৌছাই মহা মহা মানবতাবাদী বড় বড় রাষ্ট্রের মুখােসপরা বর্বর নীতির কাছে। যারা অস্ত্র দিয়ে ছােট রাষ্ট্রকে এভাবে দানব শক্তিতে শক্তিমান করে রাখে তারা মুখে স্বাধীনতা ও মানবপ্রেমের বাণী বললেও তা যে কত ভুয়াে তা বােঝা গেল। একটা দেশকে সমূলে ধ্বংস করা হচ্ছে তারা নীরব দর্শকরূপে কি পাপের ভাগী নয়? এখন বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী মানুষের হাতে একটি মাত্র পথ বাকি আছে সে হচ্ছে- ‘অসতর্ক আক্রমণ বা গেরিলা যুদ্ধ। আধুনিক কালে মারি অরি পারি যে কৌশলে নাতি মাও সে তুং এর প্রবর্তনায় তার কলঙ্ক মােচন করে গেরিলা যুদ্ধ নামে দেশে দেশে প্রবর্তিত হয়ে গেলেও উচ্চতর মানবিক বােধের কাছে তা যে একটি ভ্রষ্টতা তাতে সন্দেহ নেই। বিশেষ করে এই যুদ্ধের সৈনিক হতে হবে প্রত্যেকটি মানুষকে। প্রত্যেক গ্রামবাসী, গৃহস্থ, নারী, পুরুষকে, নরহত্যার সামিল হতে হবে, যুদ্ধ থাকবে না সীমাবদ্ধ সৈনিকে সৈনিকে। ব্যক্তিগত বীরত্বের স্থান থাকলেও, নৈতিকতার স্থান থাকবে
– শিশু নারী নিরস্ত্রের রেহাই নেই। ঘরে ঘরে ঘাতক তৈরী করতে হবে। এই দায় এসে পড়ল সেই বাঙালিদের উপর যারা মারতে চায়নি শুধু বাঁচতে চেয়েছিল।
গেরিলা যুদ্ধ যে তাদের অনেকের কাছে ও প্রত্যেকটি বিবেকবান মানুষের কাছে একটি ভ্রষ্টতা বলে মনে হতে পারে তা অসম্ভব নয়।
তাহলেও বর্তমান পরিস্থিতিতে এ একটি অনিবার্য ভ্রষ্টতা বলে স্বীকার করতে হবে। পৃথিবীর শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলি মারণাস্ত্রের ব্যবসায়ের বন্দোবস্ত করছে ক্ষুদ্রশক্তি দেশগুলাের দুর্বলতার সুযােগ নিয়ে। পাকিস্তানের মত একটা অনুন্নত দেশ যেখানে সামান্য একটা যন্ত্রও তৈরী হয় না তাদের এত স্পর্ধা ও দর্প আসছে কুচক্রী বহু বড় দেশগুলাের সাহায্যপুষ্ট হয়েই যারা এক হাতে মানুষ মারার কৌশল শেখাচ্ছে অন্যহাতে দুগ্ধ বিতরণ করছে। আমাদের প্রশ্ন এই যে বড় বড় রাষ্ট্রগুলি যদি এভাবে পৃথিবীর ছােট ছােট সমস্ত দেশের কায়েমী স্বার্থকে রক্ষা করার পবিত্র দায়িত্ব নিয়ে অস্ত্র ও অর্থ সাহায্য চালিয়ে যায় তাহলে মানুষের স্বাধীনতারস্পৃহা, পরিবর্তনের ইচ্ছা, কোনাে দিনও স্বাভাবিক ভাবে পূর্ণ হবে না।
পাকিস্তানের বর্বর নরঘাতক পর্বের সঙ্গে সঙ্গে সিলােনের বিদ্রোহ দমনের প্রক্রিয়াটাও আমাদের এই আশঙ্কাকেই বাড়িয়ে তােলে। যখন বাঙ্গলাদেশের উপর প্রচণ্ড বর্বরতা চলেছে, মধ্য রাত্রে ঘুমন্ত মানুষের উপর পাকিস্তানের স্বেচ্ছাচারী দস্যু দল যাদের প্রতি জনসাধারণের আস্থা নেই, যারা সাধারণ নির্বাচনের পরে সকল রকমে অনধিকারী, তারা কেবল মাত্র হাতে অস্ত্র থাকায় কামান দাগিয়ে হত্যা করে চলল, তাদের হাত থেকে এই সব নিরীহ প্রাণগুলি রক্ষা করবার জন্য কেউ এগিয়ে এল না। কিন্তু সিলােনে গৃহযুদ্ধে যখন সে দেশের সরকার একটা ক্ষুদ্র স্বদেশীয় অল্পবয়সী অধৈর্য বালকদের সায়েস্তা করবার জন্য চণ্ডমূর্তি ধরল তখন আমাদের সরকারও ছুটলেন সেই শায়েস্তা করার কাজে সহায়ক হতে। আমরা বাঙ্গলাদেশকে বীভৎস আক্রমণ থেকে বাঁচাতে পারলাম না। বীর স্বাধীনতা প্রয়াসী অহিংস নিরস্ত্র সংগ্রামের সহায়ক হতে পারলাম না, কিন্তু পাকিস্তান প্লেনের সঙ্গে এক যােগে আমাদের প্লেন কয়েকটি বালককে ধ্বংস করার কাজে অগ্রসর হতে পারল। এই যদি মানবতাবাদী সমাজসচেতন গণতন্ত্রকামী দেশগুলিরও দৃষ্টিভঙ্গী হয় তাহলে কি করে শান্তিপূর্ণ উপায়ে স্বাধীনতার স্পৃহা, সমাজে পরিবর্তনের চেষ্টা কার্যকরী হতে পারে শান্তি ও অহিংসায় বিশ্বাসী মানুষের কাছে এই এক প্রশ্ন আজ নিরুত্তর হয়ে আছে।
বুদ্ধিজীবীদের প্রতি
বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে ও শরণার্থীদের সেবার কাজে যারাই নিযুক্ত হয়েছেন তারা জানেন যে কি নিরুপায় অবস্থার মধ্যে আজ বহু উচ্চ পদস্থ কর্মচারী লেখক শিল্পী সাংবাদিক কলিকাতায় ও বিভিন্ন স্থানে বিপদগ্রস্ত হয়ে রয়েছেন। আওয়ামী লীগের কর্মীবৃন্দ ও নেতৃবৃন্দ সকলেই বিশেষ শঙ্কটাপন্ন অবস্থায় রয়েছে। মেয়েরাও অনেকে এসেছেন তারাও কষ্ট পাচ্ছেন বিশেষ সুবিধাজনক আশ্রয়ের অভাবে। ওদিকে লক্ষ লক্ষ শরণার্থী। শরণার্থীশিবিরে বহু মানুষের ভীড়ে জীবনের উদ্দেশ্যই ভুলে যাচ্ছেন। শরণার্থী শিবিরে ভারতীয় সরকার ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় তারা খাদ্য পাচ্ছেন চিকিৎসার সুযােগ ও ঔষধ পাচ্ছেন। কোনাে কোনাে শিবিরে দুগ্ধ ও অন্যান্য সুবিধা পাচ্ছেন। ভারতীয় জনগণ তাদের সাধ্যের সীমা অতিক্রম করে সেবা করছে ও তাদের প্রাণ বাঁচিয়ে রাখছে। লক্ষ লক্ষ মানুষ পাকিস্তানের অত্যাচারে গৃহহীন হয়ে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে এসেছেন তাদের প্রাণ বাঁচানাের গুরু দায়িত্ব বর্তেছে ভারতের জনগণের উপরে কিন্তু তাদের ভিতরে আরাে একটি জিনিস বাঁচিয়ে রাখতে হবে যা হচ্ছে মনােবল, প্রতিজ্ঞা ও সংকল্প- সংকল্পে স্থির না থাকতে পারলে এত দুঃখ ভােগ বিফল হবে। কিন্তু এই কাজটির দায়িত্ব ভারতীয় জনগণ ততটা নিতে পারেন না যতটা পারেন বাঙলা দেশের বুদ্ধিজীবীরা।
এই অসহায় মানুষগুলি গুলির মুখে তাড়িত হয়ে এসে পড়েছে। তাদের অসম্পূর্ণ রাজনৈতিক জ্ঞান, অসম্পূর্ণ শিক্ষা তারা জানে না কি কারণে কি দোষে তারা এভাবে আক্রান্ত হল এবং বর্তমান পরিস্থিতিতে তাদের কর্তব্য কি-। গণ্ডগােলের মধ্যে যখন স্থানীয় অসামাজিক ব্যক্তিরা সুযােগ নিয়েছে জিনিষ পত্র কেড়ে নিয়েছে তখন হিন্দু ভেবেছে মুসলমান নিচ্ছে, মুসলমান ভেবেছে হিন্দু নিচ্ছে। দীর্ঘ বিশ বৎসর ধরে এই অসামাজিক ব্যক্তিদের উপদ্রবে বহুলােক সীমান্ত পার হয়েছে। আজ হিন্দু-মুসলমান উভয়েই একই ভাবে আক্রান্ত। আজ উভয়েরই এক অবস্থা এ কারণে তাদের মধ্যে একটি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ একতা গড়ে ওঠার বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে সেই সম্ভাবনাকে যথােপযুক্ত ভাবে সফল করতে পারেন বাঙলা দেশেরই নেতৃবৃন্দ। কেবল রাজনৈতিক নেতা নয় বুদ্ধির ক্ষেত্রে যারা নেতৃত্ব দিতে পারেন আজ তাদেরই দায়িত্ব বেশি। এই উদ্দেশ্য মনে নিয়ে আমরা বারটি শিক্ষিত ছেলেকে বাগদা, হেলেঞ্চা ও মামা-ভাগনে এই তিনটি শিবিরে থাকবার ব্যবস্থা করেছি।
তারা সেখানে সমর্থ যুবকদের স্বাস্থ্য চর্চা করাবেন, বালক বালিকাদের কিছুটা লেখাপড়া করাবেন, জাতীয় সঙ্গীত করাবেন, স্বাস্থ্যর নিয়ম রক্ষা করাবেন। মেয়েদের সেলাইর ব্যবস্থা ফার্স্ট এইড শেখানাের ব্যবস্থা করা হবে। তারা চেষ্টা করবেন এঁদের সর্বদা দেশের কথা স্মরণ করাতে, এঁদের দেশপ্রেম জাগিয়ে রাখতে, একাজ নিরলস চেষ্টায় চালিয়ে যেতে হবে তা না হলে বিনা উপার্জনে পরের অন্ন খেয়ে এঁরা অকর্মন্য হয়ে পড়বেন। আজ শিক্ষিত বাঙালি যারা গৃহহারা কলকাতায় ও অন্যান্য শহরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন তারা যদি সীমান্তের ধারে কাছে Commune স্থাপন করে নিজেরা বাস করেন তাদের মেয়েরাও সেখানে নানাবিধ যুদ্ধের কাজে নিযুক্ত হন এবং শরণার্থী শিবিরে গিয়ে কাজ করেন। পুরুষেরাও তাঁদের জনগণের কাছাকাছি থাকেন, তাহলে সকলের পক্ষেই কর্ম স্পৃহা বজায় রাখা ও স্থির প্রতিজ্ঞা থাকা সম্ভব হবে।
নবজাতক : ৭.৫.১৩৭৭
Reference:
গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – মুনতাসীর মামুন