You dont have javascript enabled! Please enable it! ভুট্টোর অবস্থা ‘গরম টিনের ছাদে বিড়ালের মতাে -শংকর ঘােষ | আনন্দ বাজার পত্রিকা - সংগ্রামের নোটবুক

ভুট্টোর অবস্থা ‘গরম টিনের ছাদে বিড়ালের মতাে

 শংকর ঘােষ

অবশিষ্ট পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলি ভুট্টার আচরণ দিন দিন দুর্বোধ্য হয়ে উঠছে। শেখ মুজিবকে বিনাশর্তে মুক্তি দিয়ে তিনি যে রাজনৈতিক বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছিলেন তাতে আশা হয়েছিল, পাকিস্তানের অন্য সমস্যাগুলি সম্পর্কেও তিনি অনুরূপ দূরদর্শিতার পরিচয় দেবেন। কিন্তু সে আশা সফল হয়নি।

অবশ্য পাকিস্তানের আভ্যন্তরিণ অবস্থা কোন দৃঢ় পদক্ষেপের পক্ষে বিশেষ অনুকূল নয়, যদিও পাঞ্জাব ও সিন্ধুতে ভুট্টোর জনপ্রিয়তা সম্বন্ধে কোন সন্দেহ নেই, তবু তিনি জনতার দ্বারা ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত হননি। এবং তার পিছনে পর্যাপ্ত গণসমর্থন না থাকায় তার আসনও নিরঙ্কুশ নয়। প্রেসিডেন্ট আয়ুবের আমল থেকেই তিনি সামরিক শাসনের বিরােধিতা করে এসেছেন এবং ক্ষমতা লাভের পর সামরিক শাসন অবসানের প্রতিশ্রুতিও তিনি দিয়েছিলেন। অথচ ক্ষমতালাভের প্রায় একমাস পরেও তিনি ইয়াহিয়া খান ও আয়ুব খানের মতােই একাধারে প্রেসিডেন্ট ও সামরিক আইনের মুখ্য প্রশাসক রয়েছেন। কবে পাকিস্তানে জঙ্গী শাসনের অবসান হবে তার কোন স্পষ্ট উত্তর তিনি দিতে অপারগ।

 তার কারণ তিনিও পাকিস্তানের জঙ্গীচক্রের ক্রীড়নক। যে সেনানীরা তাকে ক্ষমতায় বসিয়েছেন তারা ইয়াহিয়া খানের উপর বিরক্ত বাংলাদেশে গণহত্যার জন্য নয়, ভারতকে আক্রমণের জন্যও নয়। তারা ইয়াহিয়াকে সরিয়েছেন তার ব্যর্থতার জন্য। সুতরাং ইয়াহিয়ার স্থলাভিষিক্তের কাছে তাদের আশা, তিনি পাকিস্তানের হৃত সামরিক মর্যাদা পুনরুদ্ধার করবেন। রাজনীতিক হিসাবে ভুট্টো যদি বুঝেও থাকেন ভারত ও বাংলাদেশের সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন ছাড়া পাকিস্তানের গত্যন্তর নেই। তাহলেও যতদিন তিনি জঙ্গীচক্রের কবল থেকে নিজেকে মুক্ত করতে না পারছেন ততদিন সেই অনুসারে চলার তার কোন উপায় নেই। বরাবরই তাকে এক পা অগ্রসর হওয়ার পর দু. পা. পিছিয়ে যেতে হবে।

কিছুদিন আগে ভুট্টো ভারত সম্পর্কে বেশ নরম সুরে কথা বলা শুরু করেছিলেন। তিনি স্বীকার করেছিলেন এই উপমহাদেশের শান্তি ও স্থিতির জন্য ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বন্ধুত্ব ও ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের প্রয়ােজন। এই বন্ধুতা ছাড়া দুটি দেশের সাধারণ নাগরিকের বৈষয়িক উন্নতি সম্ভব নয়। এমন কী, একটি বক্তৃতায় তিনি ভারতের কাছে কিছু সময় প্রার্থনা করেছিলেন, বলেছিলেন ভারত একটু ধৈর্য ধরলে তাকে সামান্য সময় দিলে ভারত পাকিস্তান সমস্যার সমাধানের জন্য তিনি যথাযথ ব্যবস্থা অবলম্বন করবেন।

 ভুট্টোর এইসব উক্তিতে ভারতীয় নেতারা স্বভাবতই আনন্দিত হয়েছিলেন। তারা মনে করেছিলেন, এতদিনে হয়ত পাকিস্তানের সঙ্গে স্থায়ী বন্ধুতা সম্ভব হবে। কিন্তু গত কয়েকদিনে সে-আশা নির্মূল হয়েছে । ইথিওপিয়র রাজধানী আদ্দিস আবাবয় রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদের যে বৈঠক শুরু হয়েছে তাতে আবার পাক-ভারত বিরােধী আলােচনার জন্য পাকিস্তান চেষ্টা করছে। এই উদ্দেশ্য ভারতের বিরুদ্ধে গত মাসে যুদ্ধবিরতি রেখা লঙ্ন করার একটি অভিযােগও রাষ্ট্রপুজের সাধারণ সচিবের কাছে পাকিস্তান দায়ের করেছে। অথচ গজস্থান ও কচ্ছে যুদ্ধ বিরতি সীমা লঙ্ঘন করে অতর্কিতে পাকিস্তানী আক্রমণের ফলে অফিসারসহ ভারতীয় সেনাবাহিনীর কয়েকজন নিহত হওয়ার ঘটনা সংবাদপত্র পাঠক মাত্রই জানেন।

ভুট্টোর একথা অজানা নয় যে, মার্কিন কর্তৃত্বধীন সামরিক জোটে পাকিস্তানের যােগ দেওয়ার সময় থেকেই ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের ক্রমাবনতি শুরু। ক্ষমতালাভের পর তিনি ঘােষণা করেছিলেন সামরিক

জোট সম্পর্কে পাকিস্তানের কী নীতি হবে তা নিয়ে নতুন ভাবনা হবে। পাকিস্তান “সেন্ট্রো”-র সদস্য না থাকতে পারে এরকম ইঙ্গিতও তিনি দিয়েছিলেন। তাঁর এই উক্তিতেও ভারত সরকার খুসী হয়েছিলেন, কারণ তাদের মতে পাকিস্তানের ভারত-বৈরিতার পিছনে অন্য রাষ্ট্রের উসকানি আছে। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী একথা পর্যন্ত বলেছেন পাকিস্তানের সব সম্পর্ক ছেদ করার নীতি তিনি সর্বোপরি ঘােষণা করেছিলেন। পূর্ব য়ুরােপের সমাজতন্ত্রী রাষ্ট্রগুলি যখন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া আরম্ভ করল তখন এই নীতি অনুসারে ব্যবস্থাও নেওয়া হল। এই ব্যবস্থায় বিশেষ অসুবিধা ছিল না, কেননা তাদের সঙ্গে পাকিস্তানের নামমাত্র সম্পর্ক ছিল।

কিন্তু ব্রহ্মদেশ স্বীকৃতি দেওয়ায় পাকিস্তানকে নীতি বদল করতে হল। বলা হল, ব্রহ্মদেশ-পাকিস্তান বিশেষ সম্পর্কের কথা স্মরণ করে কূটনৈতিক সম্পর্কে ছেদ করা হল না : তবে সম্পর্ক আর, আমবাসাডরপর্যায়ে রইল না। ভুট্টো রেঙ্গুনের পাকিস্তানী অ্যাম্বেসেডরকে ফিরিয়ে আনলেন। নেপালের বেলাও তাই : যদিও ইতিমধ্যে আরও কয়েকটি দেশের সঙ্গে একই কারণে পাকিস্তান সমস্ত সম্পর্ক ছেদ করেছে। নেপাল ও ব্রহ্ম দুইই চীনের প্রতিবেশী এবং চীনের সঙ্গে তাদের সম্পর্কও স্বাভাবিক। হয়ত সে কারণে ভুট্টো বেশি মর্মাহত এবং হয়ত সে কারণেই আর বেশি দূর এগুনাে তিনি বুদ্ধিমানের কাজ মনে করেননি।

ভুট্টো আরও পিছিয়েছেন যখন সােভিয়েট ইউনিয়ন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিল। এক্ষেত্রে তিনি কূটনৈতিক সম্পর্কের মানও নীচু করেননি। তবে মস্কোয় পাকিস্তান অ্যামবাসাডরকে আলােচনার জন্য ইসলামাবাদে ডেকে পাঠিয়েছেন। নীতি বিসর্জনের আর বাকি আছে অ্যামবাসাডরকেও না ডেকে পাঠানাে । সেটা কি চীনের বেলায় হবে? একটি থাকবে খবরে ঢাকায় চীনা দূতাবাসের কর্মীরা যাওয়ার সময় বলে গেছেন, তারা আবার ফিরে আসবেন। এই উক্তির অবশ্য একাধিক অর্থ হতে পারে। যাই হােক, ভুট্টো হয়ত বুঝেছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কে আছে এমন সব দেশের সঙ্গে পাকিস্তান, সম্পর্ক ছেদ করতে চাইলে অদূর ভবিষ্যতে প্রায় কোন দেশেরই পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক থাকবে না।

আভ্যন্তরিণ নীতিতেও ভুট্টোর এই পশ্চাদপসরণ দিন দিন প্রকট হচ্ছে। ক্ষমতালাভের সঙ্গে সঙ্গে তিনি রাজন্যভাতা বন্ধ করেছিলেন। কয়েকদিন পরে তা আবার চালু হয়েছে। বৃহৎ শিল্পপতিদের বিরুদ্ধে তিনি জেহাদ ঘােষণা করেছিলেন, দুজনকে গৃহবন্দীও করেছিলেন। কিন্তু আবার তাঁদের মুক্তি দেওয়া হয়েছে। পাকিস্তানের বাইরে এই সব শিল্পপতিদের যে-সম্পত্তি আছে তার হিসাব দাখিলের সময় এই মাসের ১৫ তারিখ পর্যন্ত নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছিল। অথচ আনুমানিক ১৫ কোটি ৪০ লক্ষ পাউন্ড সম্পত্তির মধ্যে মাত্র ৭০ লক্ষ পাউন্ড মূল্যের সম্পত্তির হিসাব দাখিল হয়েছে। ২৫ তারিখ পর্যন্ত সময় বাড়ানাে সত্ত্বেও বিশেষ ফল হয়নি। ভুট্টো বলেছিলেন, যারা হিসাব দাখিল করবেন না তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

ভুট্টোর এই দ্বন্দ্ববাদ সবচেয়ে প্রকট বাংলাদেশ নীতিতে। মুজিবকে-মুক্তি দেওয়ায় সঙ্গতভাবেই অনেকে অনুমােদন করেছিলেন, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে কোন সম্পর্ক থাকবে কিনা এবং থাকলে তার প্রকার কী হবে তা স্থির করার ভাব তিনি বাংলাদেশের অবিসংবাদী নেতার উপর ছেড়ে দিয়েছেন। স্বাধীন বাংলায় প্রত্যাবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মুজিব যখন ঘােষণা করলেন, পাকিস্তানের সঙ্গে তাঁর দেশের কোন সম্পর্ক থাকতে পারে না তখনই এই অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি হওয়া উচিত ছিল।

ভুট্টো কিন্তু ছাড়বার পত্র নন। তিনি এখন বলছেন, মুজিবের সঙ্গে এবিষয়ে তার আলােচনা হবে। তবে সে-আলােচনা বাংলাদেশে যতদিন ভারতীয় সেনাবাহিনী আছে ততদিন হতে পারে না। ইঙ্গিতটি খুবই স্পষ্ট; তিনি বলতে চান, ভারতীয় সেনাবাহিনীর উপস্থিতির জন্য মুজিবের কথা ও কাজের কোন স্বাধীনতা নেই। এই ধরনের বক্রোক্তির পরও তিনি আশা করেন তার সঙ্গে মুজিবের বােঝাপড়া সম্ভব। বাংলাদেশের জনসাধারণ সম্পর্কেও তিনি একটি অপমানকর উক্তি করেছেন। তিনি বলেছেন, “মুসলিম বেংগল”-এর সঙ্গে পাকিস্তানের যােগাযােগ স্থাপিত হওয়ার আশা তিনি রাখেন। বাংলাদেশের জনসাধারণ নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষতা প্রমাণিত করেছেন। তার জন্য তারা যে ত্যাগ ও কষ্ট স্বীকার করেছেন তাকে উপেক্ষা করে ভুট্টো আবার ধর্মের নামে তাদের কাছে আবেদন জানাচ্ছেন।

বাংলাদেশ ও মুজিব সম্পর্কে বারবার ভুট্টোর এই সব উক্তির একটি উদ্দেশ্য হতে পারে, তিনি এই ধারণার সৃষ্টি করতে চান, মুক্তির পূর্বে মুজিব তাকে কোন আশ্বাস দিয়েছিলেন। এই ধারণা জন্মালে যেসব দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে উদ্যত তারা স্বীকৃতি স্থগিত রাখতে পারে। দ্বিতীয়ত ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের উপর তার ছায়া পড়তে পারে। মুজিব তার স্বভাবসুলভ উদারতার সঙ্গে ভুট্টোর সম্পর্কে কিছু বলতে অস্বীকার করেছেন। কিন্তু তিনি জানিয়েছেন ব্যক্তিগত সম্পর্ক দিয়ে দুটি দেশের সম্পর্ক স্থির হয় না । ভুট্টো কি এর পরও আশা করবেন, মুজিবকে মুক্তি দেওয়ার প্রতিদানস্বরূপ মুজিব বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তানের অঙ্গরাজ্যে পরিণত করার তাঁর সহায়তা করবেন?

ভুট্টোর কথার ও কাজে এই বৈষম্য, বারবার নীতি পরিবর্তনের একটি ইংরেজী উপমার কথা মনে পড়ে- গরম টিনের ছাদে বিড়ালের মতাে। কোন অবস্থিতিই তার কাছে স্বস্তিকর নয়; তাই তিনি আজ যা করছেন কাল তা রদ করছেন, আজকের কথা কাল গলধঃকরণ করছেন। তিনি যদি মনে করে থাকেন এইভাবে তাঁর রাজনৈতিক অস্তিত্ব বজায় রাখা সম্ভব হবে তাহলে শীঘ্রই তাঁর আশা ভঙ্গ হবে। বাংলাদেশের যে-স্বাধীনতাকে তিনি “সাময়িক বাস্তবী মনে করছেন তাকে চিরকালের সত্য বলে মেনে নিতে যতদিন তার দ্বিধা থাকবে।

বিশ্ব, বিবেক, বাংলাদেশ 

কোথায় থারমাপােলির পুণ্য কাহিনী, কোথায় হলদিঘাটের ধন্য বাহিনী আজ “বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পাশে সব যেন নিপ্রভ হইয়া যায়। এ এক বড়াে বিস্ময়কর, অলৌকিক, অসম, যেন অসম্ভব সংগ্রাম। অসম্ভবকে যাহারা সম্ভব করিতেছেন তাঁহাদের অভিনন্দন। “জয় বাংলার বিক্রয় বৈজয়ন্তী যেখানে যেখানে উড়িয়াছে তাহারা একাই উড়াইয়াছেন। ওই দেশের বহু দ্রুত ও প্রতিনিধি- যাহারা, শােনা যায়, ছড়াইয়া পড়িয়াছেন দেশে দেশে তাঁহাদের উদ্দেশে বলি : ফিরিয়া যান। বিশ্বের বিবেক জাগ্রত করা? জাগিবে না। নিজের মেরুদণ্ডের চারপাশে ঘুরপাক খাইতে খাইতে এই বৃদ্ধা পৃথিবী ঝিমাইয়া পড়িয়াছে। তাহার নাসিকা গর্জনকে জাগরণের চিহ্ন বলিয়া ভুল করিবেন না। 

জাগিলে চেহারাটা অন্যরকম হইত। দিকে দিকে ধিক্কার উঠিত। সহায়তার হাত নানাদিক হইতে আপনা-আপনি প্রসারিত হইয়া আসিত- মানবতাবােধে উদ্বুদ্ধ মিশন, স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী। তাহারা এমন কি আপন আপন দেশের সরকারের মুক্তির তােয়াক্কাও রাখিত না।

আর বিভিন্ন রাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া? সে আরও চমৎকার। গােটা বিশ্বকে সংসদীয় গণতন্ত্র উপহার দিয়াছে যে ব্রিটেন, এবে বুড়া হইয়া সে বুঝি পক্ষকাল প্রায় বােবা ও বধির হইয়াছিল। কিংবা হয়তাে বা অপেক্ষা করিতেছিল “বাংলাদেশের মুক্তিকামী প্রাণ ট্যাংকের তলায় বা বােমার ঘর চূর্ণ হইয়া যায় কি না যায়। তাই বুড়া ব্রিটেন চোখের সামনে তাহার সাধের সংসদীয় গণতন্ত্রের উপর পাশবিক অত্যাচারের দৃশ্য প্রত্যক্ষ করিয়াও রা-টি কাড়ে নাই। ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার অ্যালেক এতদিনে মুখ খােলার ফুরসুৎ পাইয়াছেন। কিন্তু শুধুই তলামি করিয়াছেন। “পূর্ব পাকিস্তানের দুর্দশা লাঘব করিতে ব্রিটেন তার যা করণীয় তা নাকি পালন করিতে চায়। ঈশ্বর জানেন ইংরাজের অভিধানে করণীয়” কথাটার মানে কী। ব্রহ্মচর্য পালন? ধন্যবাদ, স্যার অ্যালেক ডগলাস হিউম, ব্রিটেনের করণীয় বিশেষ কিছু নাই, আজিকার দিনে তাহার উপর “নাই ভুবনের ভার।” 

 ভারত ছাড়া বাহির বিশ্বে সবচেয়ে আগে মুখ খুলিয়াছে সােভিয়েট রাশিয়া। এখানেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গুটি গুটি তাহার পিছনে আসিয়াছে। স্টেট ডিপার্টমেন্টের অফিসারেরা এতদিনে শুধু পরিস্থিতিটা দর্জির মতাে মাপজোক করিতে পারিয়াছেন, জামা বানানাের সময় তাহাদের এখনও হয় নাই। “বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চল মুক্তিফৌজের হাতে”-এই বিলম্বিত সার্টিফিকেট মুক্তিফৌজের বিশেষ কাজে লাগিবে না : মুক্তিফৌজ যাহা করিয়াছে নিজের হিম্মতেই করিয়াছে।

সেইদিক হইতে রুশ বয়ান বরং বেশ কিছু কড়া। একটা হেতু বােধ হয় চীন- কারণ কূটনৈতিক কাণ্ডজ্ঞান ক্রেমলিনের পুরাদস্তুর আছে। এক চোখ পূর্ব বাংলার উপর রাখিয়া, আর একটাতে আড় চোখে চীনের দিকে চাহিয়াই রাশিয়া কথাগুলি উচ্চারণ করিয়াছে। চীনে নিজে অবশ্য এখনও তেমন উচ্চাবাচ্য করে নাই, তবে পিন্ডির সঙ্গে পিকিং এখনও গাঁটছড়ায় বাঁধা। সম্ভবত চীনের চোখে পিন্ডির জঙ্গীচক্র প্রগতিপন্থী নহিলে এমন অসবর্ণ আঁতাত ঘটিবে কেন? তবু সে যে এই ব্যাপারে চুপ করিয়া আছে তাহার একমাত্র সম্ভাব্য কারণ- পূর্ব বাংলার জনমত একেবারে হাতছাড়া হইয়া যাক্ সে তা চায় না। ভারতকে এতখানি সদিচ্ছার জমি ছাড়িয়া দিতে পিকিং স্বভাবতই রাজি নহে।

অনিবার্যভাবে আবার সেই ভারতের প্রশ্নটাই উঠিয়া পড়িতেছে। যে তিনটি বৃহৎ শক্তির হাতিয়ার লইয়া পিন্ডি লড়িতেছে, তাহারা যাহাই করুক, এ দেশ কী করিবে? প্রধানমন্ত্রী বলিয়াছেন, “নীরব দর্শক হইয়া থাকিব না”- কথাটার নিহিতার্থ কী? যদি শ্রীমতী গান্ধী বলেন, যাহা করার তাহা করিতেছি- করিতেছি কিন্তু বলিব না, তাহা হইলেও বলিব প্রমাণ চাই।- অন্তত স্বীকৃতি। প্রাক্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রী এম সি চাগলা স্বরং বলিয়াছেন, সাহসী ও দৃঢ় পদক্ষেপ চাই। স্বীকৃতির দাবি অন্যান্য স্তরেও নানা দায়িত্বশীল মহলেও ধ্বনিত হইয়া উঠিয়াছে। রাজ্য মন্ত্রিসভাগুলির মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের নৃতন মন্ত্রিসভা এই দাবি কেন্দ্রকে জানাইয়া দিয়াছে সর্বপ্রথম।

শ্রীচাগলার মতাে আইনগত পাণ্ডিত্য সকলের না থাকুক, কয়েকটি ঐতিহাসিক নজির অনেকেরই মনে পড়িতে পরে। মনে পড়িবে আলজেরিয়ার এফ-এল-এন তাহাদের সশস্ত্র সংগ্রামে টিউনিসিয়া ও মরক্কোর নিকট নিয়মিত সাহায্য পাইয়াছে। স্বাধীন আলজেরিয়া সরকার গঠিত হইয়াছিল দেশের বাহিরে কায়রােয়, আর তাহার একটি কর্মকেন্দ্র ছিল টিউনিস। এই অস্থায়ী সরকারকে সেদিন স্বীকৃতি দিয়াছিল অনেক দেশঘানা, গিনি, ইন্দোনেশিয়া, ইরাক, জর্ডান, রাশিয়া, চীন, ইউ এ আর ইত্যাদি। টিউনিসিয়ার বর্গিরা এবং তাহার নিও-দস্তুর পার্টির আস্তানা ছিল কায়রাে। আর পূর্ব বাংলার মুক্তিফৌজ তাে তাহার নিজের দেশের জমিতে দাঁড়াইয়াই লড়িতেছে। ফ্রান্সের দ্যগল আশ্রয় লইয়াছিলেন ইংলন্ডে, আর অস্থায়ী সরকারও গঠিত হয় লন্ডনে, ১৯৪৪ সনে। পােলান্ড, বেলজিয়াম ইত্যাদি বহু আক্রান্ত দেশই বিপন্ন মুহূর্তে “প্রবাসী সরকারের মাধ্যমে তাহাদের স্বাধীনতার পতাকাটি উড্ডীন রাখে। “বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার কিন্তু প্রবাসী নন, নিজ ভূমে পরবাসী, বড়জোর এইমাত্র। প্রতিবেশী ভারত কি তাহাকে, স্বগৃহে সর্বতােভাবে সুস্থিত ও সুসিদ্ধ হওয়ায় পথ সুগম করিয়া দিবে না? নৈতিক দায় তাহার । দিকে দিকে উচ্চারিত দাবি হইতে মনে হয় এদেশের জনমত প্রস্তুত হইয়াই আছে, মনঃস্থির করিতে বাকী শুধু এ দেশের সরকারের।

 আনন্দবাজার : তারিখ পাওয়া যায় নি