ইয়াহিয়া বিশ্বের দৃষ্টিকে সরিয়ে নেওয়ার জন্য ভারতকে যুদ্ধে জড়াতে চায়- কামরুজ্জামান।
(স্টাফ রিপাের্টার)
মুজিবনগর, ২৩ অক্টোবর- ইয়াহিয়া খাঁ বাঙলাদেশে একটা হারা-যুদ্ধ লড়ছে। সে নিশ্চিতভাবেই জানে যে, বাঙলাদেশ থেকে শীঘ্রই তার দখলদার ফৌজ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে; সে জানে বাঙলাদেশের মানুষের প্রতি তার আচরণের মধ্য দিয়ে তার স্বরূপ পৃথিবীর কাছে উদঘাটিত এবং তার নিজের দেবার মতাে কোনও কৈফিয়ৎ নেই। তাই বাঙলাদেশের মানুষের মরণপণ লড়াই থেকে পৃথিবীর দৃষ্টিকে সরিয়ে নেবার জন্য ইয়াহিয়া খা এখন মরীয়া হয়ে ভারতকে যুদ্ধে জড়িয়ে ফেলতে পারে।”-বাঙলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রী কামরুজ্জামান এখানে এক সাক্ষাৎকারে উপরােক্ত মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, লােকে যা আশা করছে, তার অনেক আগেই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন সফল হবে।
ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের যুদ্ধ প্রস্তুতির সংবাদের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি এই কথা বলেন। বাঙলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাঁর দল আওয়ামী লীগের কর্মনীতির উল্লেখ করে বলেন, “আওয়ামী লীগ গােষ্ঠী নিরপেক্ষ স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করতে এবং সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে প্রতিশ্রুতি বদ্ধ। আওয়ামী লীগ পৃথিবীর প্রতিটি জাতির নিজস্ব অবাধ অধিকারে এবং তাদের স্বাধীন জাতি হিসাবে বাঁচবার অধিকারে বিশ্বাস করে। যে শক্তি এই সব অধিকারকে খর্ব করে সে আওয়ামী লীগেরও বন্ধু হতে পারে না। বাঙলাদেশ ও দখলদার বাহিনীর মধ্যে আজকের লড়াই ঐ নীতিরই ফল যার অপরিহার্য অঙ্গ হল পূর্ণ স্বাধীনতা ও বাঙলাদেশের পূর্ণ সার্বভৌমত্ব।”
“আমাদের মহান বন্ধু ভারত অব্যাহতভাবে সহনশীলতার, গণতন্ত্রের প্রতি মর্যাদার এবং গণতান্ত্রিক নীতি ও মুল্যবােধের জন্য সংগ্রামরত মানুষের প্রতি সমর্থন জানানাের কর্মনীতি অনুসরণ করে আসছে। সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিকতাবাদের বিরুদ্ধে, নিপীড়িত জনগণের পক্ষে সব সময়ে ভারত দাঁড়িয়েছে। বাঙলাদেশের মানুষের আদর্শের প্রতি আমাদের এই মহান বন্ধুর সহানুভূতি উপরােক্ত কর্মনীতির সঙ্গেই সঙ্গতিপূর্ণ। ভারত শান্তিপ্রিয় দেশও বটে। সেই কারণেই অভূতপূর্ব শরণার্থী সমস্যায় সাধ্যাতিরিক্ত বােঝা সত্ত্বেও ভারত পাকিস্তানের প্রতি প্রশংসনীয় সংযম প্রদর্শন করেছে।”
তিনি আরাে জানান যে, বাঙলাদেশের মুক্ত এলাকা আওয়ামী লীগের ইস্তেহারে ঘােষিত নীতি অনুযায়ী জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের উপরে দায়িত্ব দিয়ে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তােলা হয়েছে। একমাত্র সামগ্রিকভাবে জাতীয় প্রশ্নের সঙ্গে জড়িত প্রশ্নগুলি- বাঙলাদেশ সরকার যে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত করবেন-স্থানীয় রাজনৈতিক অর্থনৈতিক প্রশ্নে সিদ্ধান্ত গ্রহণের কর্তৃত্ব এঁদের রয়েছে।
তিনি জানান যে ২৫ বিঘা পর্যন্ত যাদের জমি রয়েছে তাদের খাজনা থেকে অব্যাহতি দেবার প্রতিশ্রুতি মুক্ত এলাকায় পুরােপুরিভাবে কার্যকর করা হয়েছে।
তিনি বলেন, মুক্ত এলাকায় হােক, আর পাকিস্তানী ফৌজের অধিকৃত এলাকায়ই হােক, বাঙলাদেশে মানুষের একমাত্র লক্ষ্য হল: মাতৃভূমিকে মুক্ত করা। “স্বভাবতঃই আমাদের জনগণের সর্বশক্তি শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নিয়ােজিত। আমাদের আয়ত্তে যে শক্তি-মানুষ, অর্থ ও রসদ-রয়েছে, সব কিছুই প্রবাহিত হবে, একটিমাত্র খাতেদখলদার ফৌজকে নির্মূল করার পক্ষে যথেস্ট পরিমাণে সক্ষম এক বাহিনী গড়ে তােলায়। আমরা ইতিমধ্যেই সফলভাবে তাদের মােকাবিলা করার শক্তি অর্জন করেছি এবং আমরা তাদের মােকাবিলা করছি।
“লােকে যা আশা করেছেন তার চাইতে অনেক আগেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর- এর স্বপ্ন বাস্তবে রূপায়িত হবে। আমাদের জনগণ তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করবেন। একটা দৃঢ় প্রতিজ্ঞা জাতিকে কেউ দমন করতে পারে না এবং দৃঢ়তা, ঐক্য ও আত্মত্যাগ-এর কোনও দ্বিতীয় নজির পৃথিবীর ইতিহাসে নেই।”
সূত্র: কালান্তর, ২৪.১০.১৯৭১