বিজয় নয়, মুক্তির অভিযান
বাঙলাদেশ থেকে পাক হানাদারদের উচ্ছেদ করে ঐ দেশটিকে সম্পূর্ণ স্বাধীন করার দায়িত্ব নিয়ে আমাদের সৈন্যবাহিনী মুক্তিফৌজের পাশাপাশি প্রতিটি শক্ত ঘাঁটিতে আক্রমণ চালাচ্ছেন এবং জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থন ও অভিনন্দন লাভ করছেন। গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার জন্য আমাদের জওয়ানদের এই স্বার্থহীন সংগ্রাম। আন্তর্জাতিক মুক্তি আন্দোলনের ইতিহাসে ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই এক মহান অবদান হিসেবে উচ্চারিত হবে। ভারত ও বাঙলাদেশ এক রণক্ষেত্রে পাশাপাশি সামিল হয়ে সরকারের জন্য রক্তের বন্ধনে বাঁধা পড়েছে। এবং এই মিলিত সংগ্রামের মধ্য দিয়েই বাঙলাদেশের জনগণের সঙ্গে ভারতের ৫৫ কোটি জনগণের মৈত্রী ঐক্য বন্ধন এখন চিরস্থায়ী বুনিয়াদের ওপর স্থাপিত হয়েছে।
এমনই এক ঐতিহাসিক লগ্নে আমাদের পূর্ব কমান্ডের প্রধান সেনানায়ক জেনারেল জগজিৎ সিং অরােরা তার অধীনস্থ সমস্ত সৈনিকদের উদ্দেশ্যে আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, মনে রেখাে, তােমরা বাঙলাদেশ জয় করতে যাচ্ছ না, মুক্ত করতে যাচ্ছে।”
বাস্তবে, ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় সেনাবাহিনীর হাতে শুধু দেশের আঞ্চলিক অখণ্ডতাই রক্ষা করা নয়, হানাদার পাক ফৌজের কবল থেকে বাঙলাদেশকে মুক্ত করার গুরুদায়িত্ব ও এসে পড়েছে। এ সময় বিজয়ােল্লাসে বিহ্বল হয়ে ওঠার প্রশ্ন নেই, আছে সতর্কতা ও দৃঢ়তা অবলম্বনের প্রশ্ন। শুধু বাংলাদেশকে মুক্ত করাই নয়, ছিন্নমূল মানুষদের যদি আবার তাদের স্বদেশে স্থিরভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে হয়, তবে আমাদের সেনাবাহিনীকে সেইসব মানহারা মানুষদের সম্পূর্ণ আস্থা ভালােবাসা ও বিশ্বাস অর্জন করতে হবে। লে, জেনারেল অরােরা তাই খুব সঠিকভাবেই বলেছেন। “সাধারণ নাগরিকের প্রতি তােমাদের ব্যবহার একেবারে নিখুত হতে হবে।” হানাদার পাক ফৌজের নগ্ন বীভৎসতার চূড়ান্ত রূপ বাঙলাদেশ দেখেছে। সেক্ষেত্রে ভারতীয় ফৌজের মানুষদের শুশ্রুষাকারীর ভূমিকা সঠিকভাবে পালন করার উপরই অরােরার বক্তব্যের মূল তাৎপর্য নিহিত আছে। কারণ তাদের ব্যবহারের মাধ্যমেই বাঙলাদেশের জনসাধারণের কাছে প্রতিপন্ন হবে সামরিক হানাদারি শক্তির স্বরূপ ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাকামী সেনাদলের চরিত্রগত তফাৎ কোনখানে।
সূত্র: কালান্তর, ৮.১২.১৯৭১