You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.03.29 | মুজিবরের নেতৃত্বে অস্থায়ী সরকার প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলির কাছে স্বীকৃতিদানের অনুরােধ | কালান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

মুজিবরের নেতৃত্বে অস্থায়ী সরকার প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলির কাছে স্বীকৃতিদানের অনুরােধ

কলকাতা, ২৮ মার্চ-বাঙলাদেশের স্বাধীনতা যােদ্ধারা ক্রমেই জনতার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় দৃঢ়তার সঙ্গে এগিয়ে চলেছেন।
আজ বিশ্ববাসীর কাছে বিশেষ করে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলির কাছে স্বাধীন বাংলা বেতার নতুন অস্থায়ী সরকার গঠনের সংবাদ জানিয়ে সরকারকে স্বীকৃতিদানের আবেদন করেছে। এ খবর ধরা পড়েছে আগরতলায়। ইউ, এন, আই জানিয়েছে, সরকারের সর্বময় নেতা মুজিবর রহমান, অস্থায়ী প্রধান মেজ জিয়া।
ওদিকে ঢাকার জঙ্গীশাহীর কর্তৃপক্ষ করাচিকে জরুরী বার্তা পাঠিয়েছে-সৈন্য, জিনিসপত্র পাঠাও। ওরা (স্বাধীনতা যযাদ্ধারা) আসছে, শেষরক্ষা অসম্ভব। সামরিক বাহিনী শেষ পর্যন্ত নৌ-বাহিনীকে জনতার বিরুদ্ধে নিয়ােগ করেছে।

জনতার প্রতি নির্দেশ
সংগ্রামের সাফল্যের জন্য কি কি করতে হবে-স্বাধীন বেতার কেন্দ্র থেকে তা জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। নির্দেশগুলি হলাে : রাতে বাংলা দেশের সর্বত্র যেন নিপ্রদীপ থাকে, সমস্ত বিমান বন্দর অকেজো করে দাও যেন নতুন সৈন্য নামতে না পারে। সক্ষম ব্যক্তিরা কেউ যেন শহর থেকে গ্রামে না যায়। সামরিক বা বেসামরিক সমস্ত মােটর ড্রাইভার আওয়ামী লীগের নতুন সদর দপ্তর চট্টগ্রামের রেস্টহাউসে সমবেত হয়। পেট্রল পাম্পের মালিকরা বিদেশী সৈন্যদের তেল বিক্রি করবে না। স্বাধীন বাংলা দেশের বিশেষ অনুমতিতেই বিক্রি করা যাবে। রাস্তার সমস্ত যানবাহন মায় মােটরকার স্বেচ্ছাসেবকরা তল্লাসী করবে।

সামরিক বাহিনী সর্বত্র মার খাচ্ছে
আজ রাতে স্বাধীন বাংলা বেতারের দাবি হলাে, পাকিস্তানী সেনাবাহিনী সর্বত্র মার খাচ্ছে এবং বিপর্যস্ত হচ্ছে। বাংলাদেশের মুক্তিযােদ্ধারা সর্বত্র এগােচ্ছে। রংপুর, যশাের এবং কুমিল্লার কর্তৃত্ব এখন বাংলাদেশের যােদ্ধাদের হাতে।
শিলিগুড়ি থেকে ইউএনআই জানাচ্ছে, দিনাজপুর জেলার পচাগড় এবং ঠাকুরগাঁও-এ স্বেচ্ছা সৈনিকদের সঙ্গে পাকিস্তানী সৈন্যদের তুমুল সংঘর্ষ হচ্ছে। এখানের সরকারী মহলের সূত্রে জানা গেছে, গত রাতে স্বেচ্ছাসৈন্যরা দুটি সৈন্য শিবির আক্রমণ করে। রেললাইন উপড়ে ফেলার ফলে নতুন সৈন্য কোন সম্ভাবনা নেই।
পুলিস এবং ই, পি, আর (পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস) রংপুরের এক অস্ত্রাগারের তালা খুলে দিয়েছে এবং এখানে স্বেচ্ছা সৈন্যরা শিক্ষা গ্রহণ করছে। মালদার খবর হলাে, রাজশাহী জেলার ফোরাকানপুর শহরে লড়াই চলছে। গতরাত থেকে কামানের শব্দ ভারতীয় অঞ্চলে শােনা যাচ্ছে। এখানে পূর্ব পাকিস্তানের সৈন্যরা পাকিস্তানী সৈন্যদের সঙ্গে লড়ছে।
কৃষ্ণনগরে পাওয়া খবরে প্রকাশ, শিল্প-শহর নারায়ণগঞ্জ স্বেচ্ছা সৈনিকরা দখল করেছে। ঢাকার নবাবপুর এবং জনসন রােড় অঞ্চলে তীব্র সংগ্রাম হচ্ছে। পাক সৈন্যদের ঢাকা থেকে টাঙ্গাইল যাওয়ার চেষ্টা জনতা ব্যর্থ করেছে। সমগ্র টাঙ্গাইল জেলা স্বাধীনতা যযাদ্ধাদের হাতে। কুষ্টিয়া জেলায় যেসব অস্ত্রসস্ত্র ধরা পড়েছে স্বেচ্ছাসেবকদের মধ্যে তা বিলিয়ে দেওয়া হয়েছে।
জলপাইগুড়ি থেকে জানা গেছে, সৈয়দপুর, নিলফামারি, পার্বতীপুরেও সংঘর্ষ চলছে। সৈয়দপুরে দুদিন আগে থেকে এই সংঘর্ষ শুরু হয়েছে জাতীয় পরিষদের সদস্য আওয়ামী লীগ নেতা রহমান চৌধুরীর আকস্মিক গ্রেপ্তারের পর থেকে।
কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে পিছু হঠে আসা একদল পাক সৈন্যকে গােমতী নদীর উপর ফকিরহাট সেতুর কাছে মুক্তিযােদ্ধারা বাধা দেয়। এদের কাছে গােলা বারুদের ভাণ্ডার ছিল। এগুলি মুক্তিযােদ্ধাদের দখলে গেছে বলে জানা গেছে। খুলনার কাছে এক রেজিমেন্ট পাক-সৈন্য সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে।

যাদের অস্ত্র আছে তারা এসাে
আজ স্বাধীন বাঙলা বেতার থেকে বলা হয়েছে যাদের কাছে অস্ত্র আছে তাদের সকলকেই বাঙলাদেশের সৈন্যবাহিনীর প্রধান মেজর জিয়া, ক্যাপটেন নাসির, ক্যাপটেন ফুইয়ানের কাছে চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে হাজির হওয়ার আবেদন করা হয়েছে।
ঐ বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশে যে কোন ধরনের অনুপ্রবেশকারীদের বাধা দানের আবেদন করা হয়েছে।

একটি রেজিমেন্টের আত্মসমর্পণ
কুষ্টিয়া জেলার চুয়াডাঙ্গায় অবস্থিত পশ্চিম পাঞ্জাবের একটি রেজিমেন্ট ই, পি, আরের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। বিশ্বস্তসূত্রে জানা গেছে ই, পি, আরের সব বেতার কেন্দ্রগুলি মুক্তিযােদ্ধাদের দখলে গেছে।
পদ্মার সেতুর ওপর বােমা
এক অসমর্থিত সংবাদে প্রকাশ পদ্মা নদের ওপর ৫ কিলােমিটার লম্বা হার্ডিঞ্জ সেতুর ওপর বােমা বর্ষিত হয়েছে।
ঢাকা বেতারের ঘােষণা উদ্ধৃত করে ইউ, এন, আই জানাচ্ছে, পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষ সংবাদ ও তথ্য প্রচারের পথ রুদ্ধ করার জন্য অপেশাদার রেডিও ট্রান্সমিটার চালকদের তাদের ট্রান্সমিটারগুলি প্রত্যার্পণের নির্দেশ দিয়েছেন। জঙ্গী আইন অনুযায়ী এই নির্দেশ জারী করা হয়েছে।
আরও সৈন্য আসছে
করাচী থেকে এক নতুন সৈন্যদল আজ চট্টগ্রাম বন্দরে অবতরণ করে রাস্তায় রাস্তায় গড়ে তােলা স্বাধীনতা যােদ্ধাদের ব্যারিকেড ভেদ করে শহরে প্রবেশের চেষ্টা করছে। ঐ সৈন্যরা তাদের চলার পথের আশেপাশের বাড়ি ও অন্যান্য জিনিসপত্রে আগুন লাগিয়ে ভষ্মীভূত করছে বলে শিলংএ প্রাপ্ত সংবাদের উল্লেখ করে ইউ এন আই জানাচ্ছে। স্বাধীনতা যযাদ্ধারা বীরত্বপূর্ণভাবে মেসিনগান সজ্জিত ঐ সৈন্যদলকে প্রতিরােধ করছেন।
ঐ নতুন সৈন্য দলকে ইতিমধ্যেই তিনটি ছাউনীর ৮০ হাজার পাক-সৈন্যের শক্তি বৃদ্ধি করতে পাঠানাে হয়েছে। নতুন দলটি তিনদিন আগেই জাহাজে করে এসে বন্দরে পৌঁছেছিল। কিন্তু স্বাধীনতা যযাদ্ধাদের প্রতিরােধের ফলে বন্দরে নামতে পারছিল না।

জান বাঁচাও
ঢাকার সামরিক কর্তৃপক্ষ আজ করাচীর হেড কোয়ার্টারে এক জান বাঁচাও বার্তায় (এস ও এস) আরাে সৈন্য এবং অন্যান্য জিনিসপত্র পাঠানাের জন্য আকুল আবেদন জানিয়েছেন। শিলং থেকে ইউএনআই এ খবর দিয়ে জানিয়েছে যে, ঐ বার্তাটি এখানে ধরা পড়েছে। ঐ বার্তায় আরাে বলা হয়েছে, ঢাকা রক্ষা অসম্ভব হয়ে উঠেছে। লেফটেন্যান্ট-কর্নেল ওয়াই জাম খার স্বাক্ষরিত ঐ বার্তায় চট্টগ্রাম থেকে ঢাকার দিকে আগত একটি মিছিলের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে মিছিল বলতে ঢাকার দিকে মার্চ করা স্বাধীনতা যযাদ্ধাদের কথা বলা হয়েছে। পরে স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে ঘােষণা করা হয়েছে যে, স্বাধীনতা যযাদ্ধারা ঢাকার দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন।

সূত্র: কালান্তর, ২৯.৩.১৯৭১