You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাঙলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দানের বিষয় এখনও বিবেচনাধীন বিরােধী নেতাদের কাছে প্রধানমন্ত্রীর ঘােষণা : মন্ত্রিসভাতেও কোন সিদ্ধান্ত হয় নি

নয়াদিল্লী, ৭ মে (ইউ এন আই)-বাঙলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দানের বিষয়টি এখনও বিবেচনাধীন রেখে দেওয়া হলাে।
সংসদের বিরােধী দলনেতাদের সঙ্গে আজ প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী গান্ধী ঐ বিষয়টি সম্পর্কে ৩ ঘণ্টাকালব্যাপী আলােচনার পরেও ঐ মর্মে ঘােষণা করেন।
প্রধানমন্ত্রীর প্রধান যুক্তি ছিল যে, ভারত বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রশ্নে অন্যান্য কয়েকটি বন্ধুভাবাপন্ন দেশের সঙ্গে আলােচনা করেছে; তবে কোন দেশ এখনই বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দিতে রাজি নয়। সেই কারণে ভারতকে স্বীকৃতিদানের প্রশ্নে তাড়াহুড়া না করে অপেক্ষা করতে হবে।
শ্রীমতী গান্ধী বিরােধী নেতাদের সঙ্গে আলােচনার পর খুব অল্প সময়ের মধ্যে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার এক বিশেষ সভা আহ্বান করেন। সভায় বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতিদানের বিষয়টি সম্পর্কে নানা দিক দিয়ে আলােচনা হলেও কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছুনাে সম্ভব হয়নি বলে জানা গেছে।
বিরােধী নেতারা প্রধানমন্ত্রীর কাছে বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দিয়ে অন্যান্য দেশের সামনে নেতৃত্ব তুলে ধরার দাবি করেন। তাঁরা বলেন, ঐতিহাসিক ও ভৌগলিক কারণে পূর্ববাংলার জনগণের প্রতি ভারতের বিশেষ দায়িত্ব রয়েছে।
আজকের নির্দল সদস্য ছাড়া কমিউনিস্ট পার্টি, ভি এম কে, সি পি এম, পি এস পি, আর এস পি ও জনসংঘের নেতারা অবিলম্বে স্বীকৃতিদানের দাবি করেন।
প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতিদান সম্পর্কে আজই প্রথম তার মতামত প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, পাকিস্তানের যুদ্ধের হুমকি অথবা চীনের ভয়ে ভারত স্বীকৃতি দেওয়ার প্রশ্নে বিলম্বের নীতি গ্রহণ করছে বলে মনে করার কোন কারণ নেই। বরঞ্চ আরাে জোরালাে যুক্তিতেই ঐ মর্মে সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
তিনি বলেন, স্বীকৃতিদানের প্রশ্নে পাকিস্তান যদি ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ বাধাতে চায় তাতেও ভারত ভীত নয়। তবে উপযুক্তভাবে সব কিছু যাচাই না করে স্বীকৃতি দান সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা উচিত নয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্বীকৃতিদানের প্রশ্ন ছাড়াও পূর্ববঙ্গের জনগণের মুক্তিযুদ্ধকে ভারত সর্বতােভাবে সাহায্য করবে। তবে এ ব্যাপারেও আন্তর্জাতিক রীতিনীতিকে অনুসরণ করতে হবে।
তিনি পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক জিগির প্রচারের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি জানান।
প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও সরকারের পক্ষে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সর্বশ্রী জগজীবন রাম, ওয়াই বি চ্যবন, ফকরুদ্দীন আলী আহমেদ, রাজবাহাদুর, খাদিলকার, ওম মেহতা প্রমুখ সভায় উপস্থিত ছিলেন।
সাম্প্রদায়িকতাকে প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে। মুসলীম সদস্যদের প্রতি কটাক্ষ করে তিনি বলেন, “এমন কি মন্ত্রী থাকার জন্যও যদি তাঁরা সমর্থন করেন তা হলেও কিছুটা লাভ হবে।”
কংগ্রেসের আন্তরিকতা সম্পর্কে প্রশ্ন তুলে বলেন যে, বাংলা দেশে ইয়াহিয়া ফৌজ পাঠানাের এক দিকে আপত্তি করা হচ্ছে, অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গে পুলিস সি, আর পি ও শেষ পর্যন্ত প্রায় ৫০ হাজার বা চার ডিভিশন সৈন্য মােতায়েন করে অত্যাচার চালানাে হচ্ছে। “যেটুকু গণতন্ত্র ছিল, তা আজ এ রাজ্যে শেষ হতে বসেছে।” সেইজন্যই কেন্দ্রের উপর চাপ দেবার যে কথা প্রস্তাবে বলা হয়েছে, তার উপরে তিনি বিশেষ গুরুত্ব আরােপ করেন। তিনি বলেন, এই সরকারের সঙ্গে কোনাে বিষয়ে তাদের মিল নেই, “যতাে তাড়াতাড়ি এর পতন হয় তার জন্য চেষ্টা করব।” তবু এই একটি বিষয়ে একমত হয়ে তারা প্রস্তাব নিচ্ছেন কারণ, বাংলাদেশের সংগ্রাম এই দেশের সংগ্রামের অগ্রগতিকে সাহায্য করবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশকে অস্ত্র-গােলাগুলি না দিলে আমরা ওদের সগ্রামে সাহায্য করতে পারবাে না।” তিনি প্রস্তাব করেন যে, এই প্রস্তাব নিয়ে কয়েকজন প্রতিনিধির দিল্লীতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আরােচনা করা উচিত যাতে বােঝা যায়। যে, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি ও সাহায্য দিতে সত্যিই কিছু অসুবিধা আছে কি-না।
শ্রীআবদুস সত্তার (ইং কং) বলেন, যে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান হয়েছিল, ২৩ বছর পরে তা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। হিন্দু মুসলমানকে আলাদা করে দেখা কোনও গণতন্ত্র-বিশ্বাসী মানুষ মেনে নিতে পারেন না। ইয়াহিয়ার সৈন্য ইসলামের নামে যে গণহত্যা চালাচ্ছে তার চাইতে ইসলাম বিরােধী কাজ আর কিছু হতে পারে না। তিনি বলেন, ভারতের স্বীকৃতি ও সাহায্য দেবার ব্যাপারে একমাত্র বাধা হচ্ছে চীন, যে ইয়াহিয়ার জঙ্গী শাসনকে সমর্থন করছে। শ্রীজ্যোতি বসুকে তিনি প্রশ্ন করেন, “আপনি কি প্রস্তাব আন্তরিকভাবে সমর্থন করছেন, না রাজনীতি করছেন।”
শ্রীসুবােধ বন্দ্যোপাধ্যায় (এসইউসি) প্রস্তাব সমর্থন করে বলেন যে, চীনের সমালােচনা করার আগে ইন্দিরা সরকারের সমালােচনা করা দরকার। বাংলাদেশ সরকার গঠিত হবার পর তাকে স্বীকৃতি দেবার ক্ষেত্রে কোনও আন্তর্জাতিক আইনগত বাধা নেই। সামরিক সাহায্য দেবার সমর্থনে তিনি বলেন, স্পেনের গৃহযুদ্ধের সময় আন্তর্জাতিক ব্রিগেড পাঠাননা হয়েছিল, আমাদের দেশের মানুষের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে স্বেচ্ছা সৈন্য হবার জন্য ডাক দিলে বাংলাদেশে লড়াই করার জন্য হাজার হাজার সৈনিক পাওয়া যাবে।
তিনি ভারত সরকার সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করে বলেন, যে সরকার সিংহলে বিদ্রোহ দমনের জন্য সামরিক সাহায্য পাঠাচ্ছে, দক্ষিণ ভিয়েতনামের ‘পিঠ-ই সরকারকে’ ট্রাক ও ওষুধ-পত্র পাঠাচ্ছে, দেশের মধ্যে “ফ্যাসিবাদ কায়েম করতে চায়” পররাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে তার প্রতিফলন স্বাভাবিক।” ভারত সরকার বাংলাদেশের প্রতি এ যাবৎ শুধু “মৌখিক সমর্থন জানিয়ে এসেছে”, এখন দরকার জিনিষপত্র দিয়ে, বৈষয়িক সাহায্য করা। তার জন্য ভারত সরকারকে বাধ্য করতে হবে।

সূত্র: কালান্তর, ৮.৫.১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!