বাঙলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দানের জন্য ভারত সরকারের উপর সম্মিলিত জনচাপ সৃষ্টির আহ্বান মুক্তিসংগ্রাম সহায়ক সমিতি আহূত মহতী জনসভায় হীরেণ মুখােপাধ্যায়
(স্টাফ রিপাের্টার)
কলকাতা, ১৬ মে-“ইতিহাসের শিক্ষা, ফ্যাসিবাদকে তুষ্ট করতে গিয়ে তার শক্তি বৃদ্ধি করা হয়েছিল। তাই পাকিস্তানের ফ্যাসীবাদী পৈশাচিকতার সামনে মূক থেকে তাকে বাড়তে দেওয়া যায় না। ঐ ফ্যাসীবাদ নির্মূল করার জন্য অবিলম্বে বাঙলাদেশের স্বাধীন সরকারকে স্বীকৃতি দিতে হবে যাতে আমরা প্রকাশ্যে সামরিক সম্ভার সহ সর্বপ্রকারে বাঙলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সহায়তা করতে পারি, যাতে রাষ্ট্রসঙ্ এবং বিশ্বের সর্বত্র বাঙলাদেশের প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবে ভারত ওপার বাঙলায় সংঘটিত বর্বরতার বিবরণ প্রকাশ করার সুযােগ পায়। ঐ স্বীকৃতি ত্বরান্বিত করার জন্য ভারত সরকারের ওপর জনচাপ সৃষ্টি করতে হবে আর এই সম্মিলিত গণ-প্রয়াসে সযত্নে পরিহার করতে হবে বিভেদের যে কোন বীজ।”
আজ বাঙলাদেশ মুক্তি-সংগ্রাম সহায়ক সমিতির মধ্য কলকাতা শাখার উদ্যোগে এন্টালী পদ্মপুকুর পার্কে আহূত এক মহতী জনসভায় কমিউনিস্ট নেতা অধ্যাপক হীরেন মুখখাপাধ্যায় উপরােক্ত আহ্বান জানান।
স্বীকৃতি : লােকসভায় গৃহীত সর্বসম্মত প্রস্তাবের বাস্তবায়ন
মধ্য কলকাতার বিশিষ্ট নব কংগ্রেস নেতা শ্রীধীরেন্দ্র নাথ বসুর পৌরহিত্যে আয়ােজিত ঐ জনসভায় অধ্যাপক মুখােপাধ্যায় জানান, পররাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার স্বরণ সিং লােকসভায় বাঙলাদেশের ঘটনাবলীর উপর যে বিবৃতি দিয়েছিলেন তাতে শুধু কমিউনিস্টরাই নন। বহু ইন্দিরা কংগ্রেস সদস্যও অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন বলেই প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীকে সর্বসম্মত প্রস্তাব পেশ করতে হয়। ঐ প্রস্তাবে সুস্পষ্টভাবে লেখা ছিল, ‘গণহত্যার বিরুদ্ধে পূর্ব বাঙলার, গণসংগ্রাম যেন আমাদের পূর্ণ সমর্থন ও সহানুভূতি লাভ করে। অধ্যাপক মুখােপাধ্যায়ের মতে ঐ প্রস্তাবের সার্থক বাস্তবায়ন একমাত্র বাঙলাদেশ সরকারকে পূর্ণ কূটনৈতিক স্বীকৃতিদানের মাধ্যমেই সম্ভব।
অধ্যাপক মুখােপাধ্যায় ইতিহাসের একাধিক দৃষ্টান্ত তুলে ধরে এই কথা প্রমাণ করেন যে, স্বীকৃতি দানের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক আইনানুযায়ী কোন বাধা নেই। ১৭৭৬ সালের ৪ জুলাই থেকে ১৭৮৩ সাল পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা সংগ্রাম চলেছিল; ১৭৭৮ সালে যুদ্ধরত সেই নতুন যুক্তরাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিয়েছিল ফ্রান্স। স্পেনে প্রজাতান্ত্রিক সরকারের উপর ফ্যাসীবাদী আক্রমণের সময় ভারতের নেতা জওহরলাল নেহরু কি সেখানে ছুটে যাননি আন্তর্জাতিক ব্রিগেড নিয়ে ঐ সরকারের সাহায্যার্থে? ইন্দোনেশিয়ায় ওলন্দাজ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সে দেশের পরাধীন জনগণের মুক্তিসংগ্রাম চলাকালীন সদ্যোজাত স্বাধীন ভারত কি ইন্দোনেশিয়াকে ১৯৪৭ সালেই স্বীকৃতি দেয়নি? আবার ১৯৫৮ সালে কায়রাে টিউনিস ও রাবাত থেকে আলজিরিয়ার অস্থায়ী সরকার কার্য পরিচালনাকালে স্বীকৃতিদানে ভারতের দ্বিধা আলজিরিয়ার জনগণের মনে ক্ষোভ সঞ্চার করেছিল। অধ্যাপক মুখােপাধ্যায় জানতে চান, “বাঙলাদেশের জনমনেও কি আমরা অনুরূপ ক্ষোভ সঞ্চার করব?” মুজিবের অসহযােগ আন্দোলন গান্ধীজীর অহিংস সংগ্রামের চেয়ে ব্যাপকতর বাঙলাদেশের জনগণের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের মূল্যায়ণের সময় অধ্যাপক মুখােপাধ্যায় বলেন।
সূত্র: কালান্তর, ১৭.৫.১৯৭১