মুক্তিবাহিনী দুর্বার গতিতে একের পর এক অঞ্চল মুক্ত করে এগিয়ে চলেছে
(নিজস্ব পতিনিধি)
গত এক সপ্তাহে বাঙলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে গুণগত পরিবর্তন ঘটে গেছে। নিজেদের নতুন ভাবে সংগঠিত করে মুক্তিবাহিনী বাঙলাদেশের রণাঙ্গনের সমস্ত অংশে প্রচণ্ড পাল্টা আক্রমণ শুরু করেছেন ; দুর্ধর্ষ বেগে তারা একরে পর এক অঞ্চল পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর হাত থেকে ছিনিয়ে নিচ্ছেন। মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের মুখে নাজেহাল পাকিস্তানি বাহিনী সর্বত্রই পিছু হটছে।
নানাসূত্র থেকে মুক্তিবাহিনীর সাফল্যের যে বিবরণ পাওয়া গেছে তাতে দেখা যায়:
রংপুর-দিনাজপুর সেকটর : মুক্তিবাহিনী ৪০ হাজার বর্গ মাইল এলাকা সম্পূর্ণ শত্রু কবল মুক্ত করেছেন। এখানে বাঙলাদেশ সরকারের অসামরিক শাসন চালু হয়েছে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এখানে নিশ্চিহ্ন। ১২ জন পাকিস্তানি সৈন্য বন্দি হয়েছে মুক্তিবাহিনীর হাতে—এদের মধ্যে ২৫তম পাঞ্জাব রেজিমেন্টের লে. নেওয়াজ খা আছেন। এর আগের খবর ছিল হিলি-বালুরঘাট অঞ্চলে জোর লড়াই চলছিল। পাকিস্তানি হামলার জবাবে মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় ফৌজের কামানের গােলায় বেশ কয়েকটা পাক ট্যাঙ্ক ঘায়েল হয়েছিল। মুক্তিবাহিনী তিন দিক থেকে হিলি স্টেশন আক্রমণ করেছিলেন। পরে হিলি স্টেশন থেকে পাকবাহিনী পালায়। মুক্তিবাহিনীর দখলে এসেছে জয়পুরহাট। ৪৫০ পাকসেনা নিহত হয়েছে।
কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, নােয়াখালী, সেকটরে : মুক্তিবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণে চাঁদিনা দখল করেছে। ঢাকা আর কুমিল্লার মধ্যে যােগাযােগের একটা গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র এটি। এছাড়া ফুলগাজি, আনন্দপুর, চাদগাজি বাজার মুক্তিবাহিনীর দখলে। বিলােনিয়া থেকে ফুলগাজির রাস্তায় ২১ শাে মাইল মুক্তিবাহিনীর উদ্ধার করেছে। ১৫তম বালুচ রেজিমেন্টের অর্ধেক নিহত হয়েছে লড়াই-এ। ৫০০ বর্গমাইল এলাকা মুক্ত হয়েছে। এরপর ফেনীর পালা। তিন দিক থেকে মুক্তিবাহিনীর ফেনীর উপর আক্রমণ চালিয়েছেন। ফেনী শহরতলীতে বিপুল পরিমাণে মার্কিন আর চীনা অস্ত্র মুক্তিবাহিনী দখল করেছেন। এর মধ্যে আছে কামান এবং বড় মেশিনগান। চট্টগ্রাম বন্দরে মুক্তিবাহিনী বােমাবর্ষণ করেছে। একটি গানবােট, দুটি তৈলবাহী জাহাজ, দুটি খাদ্যবাহী জলযান বাঙলাদেশ সরকারের নৌবহরের আক্রমণে ডুবে গেছে।
শ্রীহট্ট-সেকটরে : মুক্তিবাহিনী রহিমপুরের কাছে ছয় শত বর্গমাইল এলাকা মুক্ত করেছেন। ২৩জন পাকি সৈন্য ও ২ জন অফিসার তাদের হাতে বন্দি। মুক্তিবাহিনীর হাতে এ ছাড়া ধরা পড়েছে ১৮৩ জন। রাজাকার ৯০ টা রকেট, ২৫৫ রাইফেল। কোম্পানিগঞ্জ আর সালুটকার থেকে পাকি বাহিনীকে হটিয়ে দেওয়া হয়েছে। চারটি পাকি ঘাটির মধ্যে দুটি গেরিলাদের দখলে। এর মধ্যে আছে রাধানগর। গেরিলা শ্রীহট্টের দিকে এগিয়ে চলেছেন। দক্ষিণ বরসােরা থেকে জগন্নাথপুর পর্যন্ত ১৫০০ বর্গমাইল এলাকা এখন সম্পূর্ণ মুক্ত। সুচনা আর ট্যাংরাটিলা ঘাঁটি গেরিলাদের দ্বারা অবরুদ্ধ। তাহিরপুর থানাও এখন মুক্তিবাহিনীর দখলে। শ্রীহট্ট শহর অবরুদ্ধ।
ময়মনসিংহ সেকটরে : বাহাদুরবাদ ঘাটে একটা রেল ব্রিজ মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা উড়িয়ে দিয়েছেন। এখানে ৩০০ ফুট লম্বা একটা ফেরি নৌকা ধ্বংস করা হয়েছে। কমলপুর ঘাটি এখন গেরিলাদের দ্বারা অবরুদ্ধ। টাঙ্গাইলে জোর লড়াই চলছে। কিশােরগঞ্জ শহর ছাড়া মহকুমার বাকি অংশ মুক্তিবাহিনীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। শ্রীহট্ট ও ময়মনসিংহ সেকটরে লড়াইএ এক সপ্তাহে ১০০-র বেশি পাকি সৈন্য মারা পড়েছে, আহত হয়েছে ২০০।
যশাের, খুলনা, কুষ্টিয়া সেকটরে : সবচেয়ে জোর লড়াই হয়েছে গত সপ্তাহে এই অঞ্চলে। চালনা বন্দরে মুক্তিবাহিনীর ডুবুরিরা একটি গানবােট, দুটো উপকূলরক্ষী জাহাজ ডুবিয়ে দিয়েছে। চালনা বন্দর কার্যত অচল। খুলনার গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি পুষ্পঘাটি এক সপ্তাহ তুমুল লড়াই এর পর মুক্ত করেছেন মুক্তিবাহিনী। খাস যশাের ক্যান্টনমেন্ট এখনও অবরুদ্ধ। ১৫০০ পাকিস্তানি সেনা মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্ম-গেল, বাঙলাদেশের ইতস্তত বিক্ষিপ্ত বাহিনীকে বলা হলাে ঢাকায় গিয়ে ঢাকায় গিয়ে জড় হও প্রতিবাদ করাে। ফলে ঢাকায় সম্ভবত তারা দেশ প্রতিরক্ষা ঘাঁটি গড়ে তুলবে। কিন্তু এক হিসেবে এটা অসম্ভব কাজ। ঢাকার কাছাকাছি কুর্মিটোলা বিমানঘাঁটিকে আগেআগেই ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে, ভারতীয় বিমানবাহিনী আগেই জয়ের অনেকখানি কাজ সেরে রেখেছেন।
ভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গি
যুদ্ধের প্রথম দিকেই পূর্বাঞ্চল কমান্ডের জি ও সি-ইন লে. জেনারেল জে এস আরােরা ভারতের বক্তব্য পরিষ্কার বুঝিয়ে বলেন। সেগুলাে (১) বাঙলাদেশে পশ্চিম পাকিস্তানি বাহিনীকে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণে বাধ্য করা: (২) যথাসম্ভব রক্তক্ষয় এড়ানোে; (৩) অবশ্যই মূল লক্ষ্য হবে ঢাকা; (৪) বাঙলাদেশের মূল অর্থনৈতিক কেন্দ্রগুলােতে কোন রকম আঘাত না দেওয়া, এবং (৫) পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর যারা আত্মসমর্পণ করবেন তাদের সঙ্গে জেনেভা চুক্তির শর্ত অনুযায়ী যথাবিহিত ব্যবহার করা।
লে. জেনারেল আরােরা বলেন, বিজয়ী সৈন্যের মতন আচরণ বাঙলাদেশে করা হবে না। বাঙলাদেশের সাড়ে সাত কোটি অধিবাসীর যারা নির্বাচিত বৈধ প্রতিনিধিদের হাতেই অধিকৃত অঞ্চলের ক্ষমতা অর্পণ করা হবে। ভারতীয় বাহিনী শহরাঞ্চল আক্রমণ করবে না, কেবলমাত্র সামরিক ঘাঁটিগুলাের দিকেই নজর রেখে আক্রমণ চালিয়ে যাবে। তাছাড়া যেসব ঘাঁটি থেকে ভারতের ওপর পাকিফৌজ আক্রমণ চালাতাে সেইসব অঞ্চল, যেমন আগরতলা, বালুরঘাট, বয়ড়া ইত্যাদিতে যে আক্রমণ চালানাে হচ্ছিল তাকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য গরিবপুরে আমাদের বাহিনী পাকিফৌজের ১৩ টি আমেরিকান ট্যাংক ও ৩ টি স্যাবর জেট ধ্বংস করে দেয়। আখাউড়াতে ও হিলিতে সে কারণেই পাকিফৌজকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করা হয়েছে প্রথমেই। লাকসাম, ফেনী, ঠাকুরগাঁও, লালমনিরহাট, কমলাপুর, দর্শনা, মিয়াবাজার এবং কোটচাঁদপুরের গুরুত্বপূর্ণ যােগাযােগ ঘটিগুলাে পরিকল্পিতভাবে নষ্ট করে দিয়ে পশ্চিম পাকিফৌজকে দিশেহারা কার ফেলা হয়েছে। তারা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে এবং বাঙলাদেশের গত কয়েকদিনেই দেখা যাচ্ছে পাকিফৌজের পালাবার সমস্ত পথগুলাে বন্ধ, এমনকি ক্যান্টনমন্টেগুলােও কোনও কাজে আসছে না।
ভৌগলিক পরিস্থিতি
মনে রাখতে হবে বাঙলাদেশের দুরতিক্রম্য ভৌগলিক পরিস্থিতি স্বত্ত্বেও আমাদের বাহিনী একরে পর এক জয়লাভ করছেন। চারদিকে নরম মাটি, ধানক্ষেত, উত্তর থেকে দক্ষিণে বিস্তৃত দীর্ঘতর নদীগুলাে, বহু ছােট ছােট নদী, উপনদী এবং দক্ষিণ বঙ্গে যােগাযােগ ব্যবস্থার চরম দৈন্য, এসবের মধ্যেও আমাদের জয়লাভ গৌরবের। কি করে সেই গৌরব এল আমাদের?
প্রথমত, আমাদের সেনাবাহিনী আজকের মতন কতিতুপূর্ণ যুদ্ধ আগে কোনদিন করেননি। দ্বিতীয়ত, এই প্রথম সম্ভবত সেনাবাহিনীর তিনটি শাখা নৌ, বিমান ও পদাতিক বাহিনী একত্রে যুদ্ধে নেমেছে। এই তিনটি একত্র সহযােগিতাই শত্রুকে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়তে বাধ্য করেছে। তৃতীয়ত আমাদের সেনাবাহিনী ও বাঙলাদেশের মুক্তিবাহিনীর মধ্যে অভূতপূর্ব সহযােগিতা ঘটেছে। বাঙলাদেশের মুক্তিযােদ্ধারাই আমাদের বাহিনীকে এই অপরিচিত ভৌগলিক পরিস্থিতিতে পথ দেখিয়ে নিয়ে যান। তারা স্থানীয় জনগণ ও আমাদের বাহিনীর মধ্যে সুসম্পর্ক স্থাপনে সাহায্য করছেন এবং আমাদের বাহিনীকে সম্ভাব্য পার্শ্ববর্তী আক্রমণগুলাে সম্বন্ধে সজাগ করে দিচ্ছেন। চতুর্থত, বাঙলাদেশের জনগণ আমাদের বাহিনীকে অভিনন্দিত করছেন এবং স্বাগত জানাচ্ছেন সর্বত্র। বেয়নেটের আগায় যারা সাধারণ মানুষকে দমিয়ে রেখেছিল তাদের দমন করার জন্যই ভারতীয় বাহিনীর প্রতি এই আন্তরিক অভিনন্দনের স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ ঘটছে। নৈতিকতার মূল্য বিচারেই এমন ঘটনা সম্ভব হয়েছে। এক পক্ষ ছিল অত্যন্ত নিচু স্তরের জীব, আজকে যারা মুক্তি নিয়ে আসছেন তারা চরিত্রের দিক থেকে অনেক উঁচুতে।
সমর্পণ করেছে। যশাের শহর ও ক্যান্টনমেন্ট থেকে নগদ টাকা, নােট ও সােনা পাকিস্তান সরিয়ে ফেলছে। যশাের, খুলনা, কুষ্টিয়া ও ফরিদপুরের শতকরা ৮০ ভাগ এলাকাই এখন মুক্তিবাহিনীর দখলে। যশাের খুলনার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বাঙলাদেশের পতাকা উড়ছে, অসামরিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। চুয়াডাঙ্গার জীবন নগর মুক্তিবাহিনী মুক্ত করেছে, থানায় ও সি আর কনস্টেবলরা বন্দি হয়েছে। মেহেরপুর অবরুদ্ধ। পাক সেনারা দর্শনা স্টেশনে জমায়েত হয়েছে পালানাের জন্য। সাতক্ষীরা দখল করে মুক্তিবাহিনী এগিয়ে চলেছে। খুলনা শহরের দিকে।
সূত্র: সপ্তাহ, ৩ ডিসেম্বর ১৯৭১