You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.07 | ভারত গণপ্রজাতন্ত্রী বাঙলাদেশকে স্বীকৃতি দিল- বিশ্বের রাষ্ট্রদরবারে আর একটি নূতন রাষ্ট্র | কালান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

ভারত গণপ্রজাতন্ত্রী বাঙলাদেশকে স্বীকৃতি দিল
বিশ্বের রাষ্ট্রদরবারে আর একটি নূতন রাষ্ট্র
(বিশেষ প্রতিনিধি)

নয়াদিল্লী, ৬ ডিসেম্বর-ভারত বাঙলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দিচ্ছে। আজ কয়েক মিনিটের জন্য লােকসভা ও রাজ্যসভা সদস্যরা সকালে সংসদ কক্ষে সমবেত হয়েছিলেন। ঐ স্বল্প সময়ের মধ্যে তাঁরা ঐ ঐতিহাসিক ঘােষণাটি শুনলেন। বিপুল হর্ষধ্বনি ও অন্তরের আবেগ দিয়ে অনুমােদন করলেন ঐ ঘােষণাকে। অভিনন্দন জানালেন প্রধানমন্ত্রীকেও। জয়ধ্বনি উচ্চারণ করলেন ঐ নতুন রাষ্ট্রটির নামে বিশ্বের দরবারে ভারত যার স্বাধীন অস্তিত্বের কথা প্রথম পরিচয় করিয়ে দিল।
সংসদের কক্ষে ঐ ঘােষণার ধ্বনি বাইরে ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়েছে দেশ জুড়ে স্বতােৎসারিত আনন্দোল্লাস। দল, মত, বর্ণ, নির্বিশেষে ভারতের সর্বত্র এই ঘােষণা বাণী অভিনন্দিত হচ্ছে।
প্রতিক্রিয়া হয়েছে দেশের বাইরে। পশ্চিম পাকিস্তানের জঙ্গীশাহী এই ঘােষণার ৫ ঘণ্টার মধ্যে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। পাকিস্তানের মিত্ররা এখনও হতচকিত। তবে বাঙলাদেশের বন্ধুরা বিশেষ সর্বত্র আনন্দিত।
লােকসভায় প্রধানমন্ত্রী বললেন, ভারত সরকার বাঙলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতিদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।
বাঙলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির লেখা চিঠিগুলির কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বললেন, এই সরকারের রাষ্ট্রনীতির ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র এবং ন্যায়নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত সমাজ গঠন।
প্রধানমন্ত্রী বললেন, এই সরকার ধর্ম, জাতি, বর্ণ এবং সম্প্রদায় নিরপেক্ষভাবে দেশ শাসন করবে। অনুসরণ করবে জোট-নিরপেক্ষ নীতি। তিনি ঘােষণা করলেন এই সরকারের প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন তাঁদের সরকার আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অনুসরণ করবে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের এবং ঔপনিবেশিক হত্যাকাণ্ড ও নৃশংসতা শুরু করার পর ২৬ মার্চ বাঙলাদেশ সরকার গঠিত হয়। ইয়াহিয়া চক্র ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করলে গত ৪ ডিসেম্বর বাঙলাদেশ সরকারের কাছ থেকে শেষ চিঠিখানি পাওয়া যায়। প্রধানমন্ত্রী তাঁর দেশের লােককে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, উপযুক্ত সময় এলেই ভারত সরকার বাঙলাদেশকে স্বীকৃতি দেবে। তিনি তাঁর সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছেন।
এর পরই সংসদের অধিবেশন আজকের মত মুলতবী হয়ে যায়।
প্রধানমন্ত্রী সরকারের সিদ্ধান্ত জানানাের সঙ্গে সঙ্গে লােকসভায় প্রবল উল্লাসের জোয়ার বইতে থাকে। এমনকি স্পীকার জি, এস, ধীলন পর্যন্ত সভার সদস্যদের সঙ্গে একযােগে ডেস্ক চাপড়ে শ্রীমতী গান্ধীকে অভিনন্দন জানাতে থাকেন।
প্রধানমন্ত্রীর ঘােষণা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একজনের পর একজন বিরােধী দলের সদস্য তাঁকে ভারত সরকার ও বাঙলাদেশের বীর জনতার প্রতি অভিনন্দন জানানাে শুরু করেন। এই ঐতিহাসিক ঘটনাকে চিহ্নিত করে রাখার জন্য সভার কার্যক্রম আজকের জন্য স্থগিত রাখা হয়। সভার চারধারে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে ইন্দিরা জিন্দাবাদ’ ‘জয় বাঙলাদেশ।’
অধ্যাপক হীরেন মুখার্জি (সিপিআই) বলেন, আমাদের হৃদয় আজ পূর্ণ হয়েছে। এক ঐতিহাসিক মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রী তাঁর কর্তব্য পালন করেছেন।’ ত্রিদিব চৌধুরী (আরএসপি) দেশকে সঠিক পথে নেতৃত্বদানের জন্য প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানান। ডি এম কে-র এরা সেঝিয়ান বলেন, সামরিক শক্তি ও গণতান্ত্রিক অধিকারের মধ্যে সংগ্রামে যে শেষােক্তটিই বিজয়ী হয়, ইতিহাসে তা প্রমাণিত হয়েছে। সিপিএম নেতা জ্যোতির্ময় বসু বলেন, এই উপমহাদেশের ইতিহাসে আজ একটি ঐতিহাসিক দিবস। এছাড়া এ বি বাজপেয়ী (জনস) এস এন মিশ্র (সিণ্ডিকেট কংগ্রেস), পি কে দেও (স্বতন্ত্র) এবং অধ্যাপক দণ্ডবাতে (এস পি) প্রমুখ সরকারের সিদ্ধান্তকে অভিনন্দন জানান।
রাজ্যসভাতেও এই একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি ঘটে। সদস্যরা দাঁড়িয়ে উঠে উত্তাল কণ্ঠে বাঙলাদেশের স্বীকৃতি ঘােষণার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে সাধুবাদ জানাতে থাকেন।
ভূপেশ গুপ্ত অনুসন্ধান সংক্রান্ত সংশােধন বিলের আলােচনায় বাধা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী রাজ্যসভায় প্রবেশের পূর্বাহ্নেই উত্তেজিত কণ্ঠ বলে উঠেন, “আমরা জানতে পেরেছি বাঙলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।” তাঁর কথা শােনামাত্র চারপাশে প্রবল উল্লাস ধ্বনি ওঠে। সংসদীয় দপ্তরের রাষ্ট্রমন্ত্রী ওম মেহতা বলেন, “একটু অপেক্ষা করুন।” ভূপেশ গুপ্ত বলে ওঠেন “আমরা আর অপেক্ষা করতে পারছি না। এ হচ্ছে আনন্দ ও উৎসব করার সময়।” ঠিক এই সময় প্রধানমন্ত্রী রাজ্যসভায় প্রবেশ করেন ও বাঙলাদেশ সম্পর্কে সরকারের স্বীকৃতি ঘােষণা করেন। সারাকক্ষে ধ্বনি ওঠে “ইন্দিরা গান্ধী জিন্দাবাদ,” “ভারত-বাঙলাদেশ জিন্দাবাদ।” ভূপেশ গুপ্ত বলেন, এক ঐতিহাসিক বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। যারা মানবতায় বিশ্বাসী তাদের সবার অভিনন্দন আজ প্রধানমন্ত্রী ও সরকারের উপর বর্ষিত হচ্ছে।
সিপিএম-এর এস, এস স্যান্যাল চেঁচিয়ে ওঠেন, মুক্তি সগ্রামী জনতা জিন্দাবাদ, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র জিন্দাবাদ। ফরােয়ার্ড ব্লকের চিত্ত বসু ঘােষণাটি শােনার সঙ্গে সঙ্গে ‘জয় বাঙলা’ বলে লাফিয়ে উঠেন।
সভার সদস্যদের অনুভূতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে স্পীকার বলেন, প্রধানমন্ত্রীর এই ঘােষণা গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার সমর্থনে এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ হিসেবে ইতিহাসে গৌরবােজ্জ্বল হয়ে থাকবে।

সূত্র: কালান্তর, ৭.১২.১৯৭১