অন্ধ সােভিয়েত-বিরােধিতার আড়ালে
প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলি সম্পর্কে কমরেড লেনিন উক্তি করেছিলেন, “ওরা যখন আমাদের আক্রমণ করে, বুঝতে হবে, আমরা ঠিক পথেই চলেছি।” ভারত-সােভিয়েত যুক্ত বিবৃতির বিরােধিতায় যখন সমাজতন্ত্রবিরােধী সব কটি চক্র এক হয়ে গলা মেলায়, তখন লেনিনের কথাটি আমাদের আর একবার মনে পড়ে যায়।
ভারতের মার্কিনি পােষ্যরা অবশ্য বাঙলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে একটু নতুন পােশাক পরে এসেছে। বাঙলাদেশের জন্য তাদের দরদ ও চোখের জল গঙ্গা থেকে বুড়িগঙ্গা পর্যন্ত প্রবাহিত হচ্ছে। কিন্তু তাদের ভাবভঙ্গি একটু তলিয়ে লক্ষ্য করলেই বােঝা যায় যে, তাদের আসল মতলব কি।
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর তিনদিনব্যাপী সােভিয়েত সফর শেষে যে ভারত-সােভিয়েত যুক্ত বিবৃতি প্রকাশিত হয়েছে, তাতে কালিমালেপন করার জন্য এ দেশের মেকি বামপন্থী ও দক্ষিণপন্থী চক্রগুলি মরিয়া হয়ে উঠেছে। সােশালিস্ট এম পি মধু দণ্ডভাতে তাে বলেই বসেছেন যে এই বিবৃতি আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের পক্ষে বিপদ সৃষ্টি করবে। তিনি এ কথাও বলেছেন যে, এর ফলে ভারত মহাসাগরে সােভিয়েত ইউনিয়ন ঘাঁটি তৈরি করবে। কিন্তু উদ্দেশ্যমূলকভাবে ঐ এম পি মহাশয় চেপে গেছেন যে ভারত মহাসাগরে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ যে ঘাঁটি বিস্তার করতে চলেছে এবং যার উদ্দেশ্য এশিয়া ভূখণ্ডে সাম্রাজ্যবাদী প্রভাবকে বিস্তৃত করা ও ভারতের নিরাপত্তাকে বিঘ্নিত করা, রুশ-ভারত বিবৃতির ফলে সেই দুরাশার মুলে কুঠারঘাত পড়বে।
বিভিন্ন একচেটিয়া পত্র-পত্রিকার বিবৃতি রিপাের্টে ও সম্পাদকীয় স্তম্ভে বাঙলাদেশ প্রশ্নে সােভিয়েতের নীতিকে আক্রমণ করে প্রচুর বিষােদার করা হচ্ছে। একটি পত্রিকার বলা হচ্ছে, “সােভিয়েত নেতাদের বিবৃতি পড়ে ইয়াহিয়া খানের দিবানিদ্রা ব্যাহত হল না।” অথচ একই দিনে পাক সরকার নিয়ন্ত্রিত পাকিস্তান ‘টাইমস্ ক্ষিপ্ত হয়ে সম্পাদকীয়তে উক্তি করেছে, “সােভিয়েত প্রধানমন্ত্রী আলেক্সি কোসিগিন পূর্ব পাকিস্তান সমস্যা সম্পর্কে ভারতীয়দের সমর্থনে অন্ধ পক্ষপাতিত্ব দেখিয়েছেন। আশা করি, পাঠকরা এই দুটি মন্তব্যকে পাশাপাশি মিলিয়ে নেবেন।
সােভিয়েত-বিরােধী শিবির উল্টোপাল্টা অনেক কথাবার্তা বলছেন কিন্তু ভুলেও সােভিয়েত প্রধানমন্ত্রী কোসিগনের এই উক্তিটির কথা তুলছেন না, “অত্যাচারীদের প্রতি আমাদের কোনাে সহানুভূতি নেই। আমরা গণতান্ত্রিক সাধারণ মানুষেরই দিকে। এখানে গণতান্ত্রিক সাধারণ মানুষ বলতে নিশ্চয়ই ইয়াহিয়া-চক্র ও অত্যাচারী বলতে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের বোঝাচ্ছে না! ভারত-সোভিয়েত বিবৃতির অত্যন্ত পরিষ্কার ভাষায় বলা হয়েছে যে, পাক সরকারকে পাকিস্তানের বিগত নির্বাচনে সংখ্যাগুরু দলের নেতা মুজিবর রহমানের সঙ্গে কথাবার্তা চালাতে হবে এবং পুর্ববাঙলার জনগণের ইচ্ছা, অবিচ্ছেদ্য অধিকার ও আইনসঙ্গত স্বার্থসম্মত রাজনৈতিক সমাধানের মাধ্যমেই ঐ দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ন্ত্রিত হবে। বিবৃতিতে শরণার্থী-সদস্য দূরীকরণের জন্য এই একটি মাত্র পথকেই নির্দিষ্ট করা হয়েছে।
পথিবীর যে কোনাে দেশের মুক্তি সংগ্রামের রক্ষা কবচ সােভিয়েত ইউনিয়ন ও সমাজতান্ত্রিক দুনিয়া। সাম্রাজ্যবাদ ও কায়েমী স্বার্থের সেবাদাসরা যে কথা ভালােভাবেই জানে। সমাজতান্ত্রিক শিবিরের সঙ্গে ভারতের ক্রমবর্ধমান ঘনিষ্ঠতা তাদের চোখের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। সাম্রজ্যবাদ-বিরােধী ও সমাজতান্ত্রিক পৃথিবীর সঙ্গে বন্ধু ভাবাপন্ন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে ওঠার যে পূর্ণাঙ্গ সম্ভাবনা দ্রুত বাস্তবায়িত হতে চলেছে, সেই পথে ভ্রান্তি ও ভুল বােঝাবুঝি সৃষ্টি করার জন্য এ দেশের প্রতিক্রিয়াচক্র মরীয়া। বাঙলাদেশে কমিউনিস্ট সহ গণতান্ত্রিক শক্তিগুলির ঐক্যবদ্ধ ফ্রন্ট গঠনে উজ্জ্বল সম্ভাবনার সামনে দাঁড়িয়ে তাই এরা মৃগী রােগীর মত হাত-পা ছেড়ে, বাঙলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের সহায়ক ভারত-সােভিয়েত চুক্তি ও বিবৃতি এদের অস্তিত্বে বিষক্রিয়া শুরু করে। কিন্তু নানা টালমাটাল পদযাত্রার ভেতর দিয়েও ইতিহাস পথ ভুল। ভারত ও মুক্তি-সংগ্রামী বাঙলাদেশের মহান জনগণ অভিজ্ঞতার আলােকে ইতােমধ্যেই জেনে গেছে কে তার মিত্র, কে-ই বা শত্রু, বিপর্যয় ও ধ্বংসের মুখােমুখি সে তার পাশে এসে দাঁড়াবে।
সূত্র: কালান্তর, ১.১০.১৯৭১