You dont have javascript enabled! Please enable it!

ভারত-সােভিয়েত মৈত্রী চুক্তির পরবর্তী পর্যায়ে সি পি এম সি পি এম

ভারত-সােভিয়েত মৈত্রী চুক্তিকে অভিনন্দিত করেছে। বাঙ্গালােরে তাঁদের কেন্দ্রীয় কমিটি বলেছে, “সােভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে এই মৈত্রী চুক্তি এই দুই দেশের মধ্যে গত কয়েক বছরের পারস্পরিক অর্থনৈতিক, প্রযুক্তিগতও বাণিজ্যিক বিনিময়ের উচ্চ : ঘটনাবম্ভ’র পটভূমিতে, যেখানে ইয়াহিয়া খানের সামরিক দস্যুদের অভূতপূর্ব গণহত্যাজনিত বর্বরতার ফলে জনগণ স্বাধীনতা ঘােষণা করতে বাধ্য হয়েছে এবং ইয়াহিয়া খার একনায়কতন্ত্রের সামরিক যন্ত্রের বিরুদ্ধে শৌর্যের সঙ্গে লড়াই করছে।”
শান্তিপূর্ণ প্রতিযােগিতার বিরােধিতা সি পি এম পরিত্যাগ করেছে মনে হচ্ছে, কিন্তু এখনাে ঘােষণা করে নি সেকথা।
বাঙ্গালােরেই তাদের কেন্দ্রীয় কমিটি রাজনৈতিক পরিস্থিতি সংক্রান্ত মূল্যায়ন বলেছে : আমরা আবার সাবধান করে দিচ্ছি যে, যদি এই চুক্তি চীনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়, তাহলে গােটা উদ্দেশ্যই হারিয়ে যাবে।”
কথায় আছে : বাঁশের চেয়ে কঞ্চি বড়াে। চৌ-এন-লাই নিজে এরকম আশঙ্কা করছেন না, অথচ সি, পি, এম, (অবশ্য নক্সাল-পন্থীরাও) এরকম আশঙ্কা করে চতুরভাবে সােভিয়েত-বিরােধিতার ইন্ধন দিচ্ছেন।
কিন্তু সি, পি, এম হঠাৎ ঐ অবস্থান থেকে প্রকাশ্য সােভিয়েত বিরােধী অবস্থানে এসেছে। ক্রুশ্চেভের মৃত্যুর পরে এবং ইন্দিরা গান্ধী—কোসিগিন যুক্ত বিবৃতির পরেই এটা বেড়ে উঠেছে। ভারত-সােভিয়েত বিবৃতিকে সি পি এম এক বিরাট অধঃপতন বলেছেন। ৪ অক্টোবর “কালান্তর” পত্রিকায় সম্পাদকীয় প্রকাশ হবার পর সি পি এম যেন আরাে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে।
সি পি এম পলিটব্যুরাে বলেছে, “যুক্ত বিবৃতিতে রাজনৈতিক সমাধানে পৌছবার জরুরী ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হয়েছে, যার অর্থ জনগণের অচ্ছেদ্য অধিকার লাভের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণে খুনী ইয়াহিয়াকে আবেদন করা।” প্রশ্ন হচ্ছে এই যে, ইতিপূর্বে যখন সােভিয়েত ইউনিয়ন থেকে রাজনৈতিক সমাধানের কথা বলা হয়েছিল, তখন সি পি এম অসন্তোষ প্রকাশ করে নি।
কিন্তু সি পি এম ঐখানে থামে নি (এবং আরাে অগ্রসর হবে মনে হয়।) ৭ অক্টোবর তাদের সান্ধ্য দৈনিক “গণশক্তি” “জালিয়াতির দালাল কালান্তর” শীর্ষক একটি রচনা প্রকাশ করেছে। উদ্দেশ্য কালান্তরের ৪ঠা অক্টোবরের সম্পাদকীয়কে গালাগালি করা। অপরাধ কি? কালান্তর বলেছে যে, যুক্ত বিবৃতিতে “পূর্ববাঙলা” শব্দটি ছিল। এটা সকলেরই জানা যে, পূর্ব-পাকিস্তান শব্দটি রুশ বয়ানে লেখা ছিল, কিন্তু ইংরাজী বয়ানে বলা হয়েছে পূর্ব-বাঙলা। কালান্তর বলেছে : “পলিটব্যুরাের সাম্প্রতিক বিবৃতিতে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে এ কথা চেপে যাওয়া হয়েছে যে, সােভিয়েত ইউনিয়ন বর্তমান বিবৃতিতে পূর্ব-পাকিস্তান না বলে পূর্ব বাঙলা’ শব্দ ব্যবহার করেছেন। সি, পি, এম, অতিবুদ্ধিমানের পরিচয় দিতে গিয়ে ঐ লেখাটি গণশক্তিতে প্রকাশ করেছে এবং ৩০ সেপ্টেম্বরের (১৯৭১) প্রাভদা’ পত্রিকার ফটোস্ট্যাট ছাপিয়ে দিয়ে বলতে চেয়েছে যে, প্রাভদা পূর্ব-পাকিস্তান’ লিখেছে। সুতরাং ওটা একটা প্রতারণা—এটাই সি পি এম-এর অঘােষিত বক্তব্য।
“গণশক্তি” লিখেছে :
দেখা যাচ্ছে, ইন্দিরা গান্ধীর আকাশবাণী, দক্ষিণপন্থী কমিউনিস্ট পার্টির “কালান্তর” এবং ভারতে সর্বাধিক প্রচারিত প্রথম শ্রেণীর দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা একযােগে একটি বড়ি আমাদের দেশের লােককে গেলাতে চাইছেন, তাহলাে, বাঙলাদেশ সম্পর্কে সােভিয়েত মনােভাবের পরিবর্তন হয়েছে এবং এই পরিবর্তন সূচিত হয়েছে পূর্ব-পাকিস্তান’ না লিখে যুক্ত বিবৃতিতে পূর্ব বাঙলা’ কথা ব্যবহারের মধ্য দিয়ে। এই কথাটা মিথ্যা কথা।….
বজ্জাতিটা তা হলে বুঝুন, ইন্দিরা গান্ধী মস্কোতে যে বিবৃতিতে সই করে এলেন তার রুশ বয়ানে রইল এক কথা, আর ইংরেজি বয়ানে আর এক।”
সত্যবাদী গণশক্তিকে এবার প্রশ্ন করি : ইংরেজী বয়ানটি কি কোসিগিনের জানা নেই? ইংরেজী বয়ানটাই কি বিদেশী সাংবাদিকদের দেওয়া হয়নি? এর মানে গােটা পৃথিবীর অ-রুশভাষা জনগণ জানলাে না কি যে, কোসিগিন ‘পূর্ব-বাঙলা ব্যবহারে আপত্তি করেন নি? এই কথাটা মিথ্যা কথা-গণশক্তির এই উক্তিটি অর্ধসত্যভাষণ নয় কি? সত্যবাদী গণশক্তি’ এটা ভালাে করেই জানেন এবং জেনেই ঐ কাজটি করেছেন।
কেবল সােভিয়েত বিরােধিতাকে মূলধন হিসেবে ব্যবহার করার জন্য অর্থাৎ কমীদের কিছুটা উন্মত্ততায় ব্যস্ত করে রাখতে।
সি পি এম, কি একথা জানেনা যে, সােভিয়েত ইউনিয়ন শুধু জনগণের ইচ্ছানির্ভর সমাধান নয়, আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের কথা বলেছেন? এটা তারা ইচ্ছে করে তুললেন কেন? এটা যে সােভিয়েতবিরােধিতার সূত্রপাত, তা বুঝতে একটুও কষ্ট হয় না।
স্মরণ থাকতে পারে যে, বাঙলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণার পরেই শহীদ মিনারে সভায় সি পি এম নেতৃবৃন্দ বলেছিলেন, সােভিয়েত ইউনিয়ন ও চীন উভয়েই বাঙলাদেশের জনগণের সংগ্রামে কার্যত বিরােধী ভূমিকা নিয়েছেন। দুজনেই সমান দোষী।
সমদূরত্ব মানে কি ন্যায় বিচার পরিত্যাগ করা? বাঙলাদেশ সম্পর্কে চীন ও সােভিয়েতের বক্তব্য বিচার করা যাক।
রাজনৈতিক সমাধানের ভিত্তিতেই “যে প্রশ্নগুলি পূর্ব-পাকিস্তানে উদ্ভূত হয়েছে, আমাদের স্থির প্রত্যয় যে, এ অঞ্চলের সামগ্রিক চাপ কমতে পারে একমাত্র রাজনৈতিক সমাধানের মাধ্যমে।… এ অঞ্চলের বর্তমান পরিস্থিতিতে তীক্ষ এবং এটা কেবল একটা অভ্যন্তরীণ (domestic) প্রশ্ন নয়।”
Daily Review APN Vol. XVII No. 198.
(রাষ্ট্রপুঞ্জ সাধারণ পরিষদের ২৬ তম প্লেনার অধিবেশনে সােভিয়েত পররাষ্ট্র মন্ত্রী গ্রোমিকোর বক্তৃতা থেকে-বড় হরেফ লেখকের)
“যেখানে সমগ্র জনগণ অধীনতার বিরুদ্ধে উঠে দাঁড়িয়েছে, সেই বাঙলাদেশের সংগ্রামের প্রতি চীনের মনােভাব একটি সাম্প্রতিক উদাহরণ, চীন গণ-সাধারণতন্ত্র মনে করে এটা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার।
(পিপলস ডেমক্র্যাসি, ৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১-সহজ অনুবাদ-বড় হরফ লেখকের)
সি পি এম-এর সাহস নেই যে বলে সােভিয়েত মনােভাব বাঙলাদেশের অনুকূলে আর চীনের মনােভাব প্রতিকূলে। কর্মীদের যে তাহলে বােঝানাে যাবে না। অথচ ভারত সােভিয়েত মৈত্রী চুক্তির পটভূমিতে বাঙলাদেশ একথা বলতে বাধ্য হচ্ছে।

সূত্র: কালান্তর, ১১.১০.১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!