You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.10.04 | পাক সরকারের প্রতিহিংসামূলক কার্যকলাপ বন্ধের দাবিতে সােভিয়েত শান্তি কমিটি ও ট্রেড ইউনিয়নের বিবৃতি | কালান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

পাক সরকারের প্রতিহিংসামূলক কার্যকলাপ বন্ধের দাবিতে
সােভিয়েত শান্তি কমিটি ও ট্রেড ইউনিয়নের বিবৃতি

মস্কো, ১ অক্টোবর (ইউ এন আই)-বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান এবং পূৰ্ব্ববঙ্গের অন্যান্য জনপ্রিয় নেতাদের বিরুদ্ধে পাক সরকার যে প্রতিহিংসামূলক আচরণ করছে তা অবিলম্বে বন্ধ করার জন্য সােভিয়েত শান্তি কমিটি ও ট্রেড ইউনিয়ন পাক সরকারের কাছে দাবি করেছে।
শান্তি কমিটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে পাক সরকারের এই প্রতিহিংসামূলক কার্যকলাপ বন্ধ হলেই এই অঞ্চলে শান্তি রক্ষার কাজকে শক্তিশালী করার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব।
‘তাস’ এ সংবাদ দিয়ে বলেছে, গত সাধারণ নির্বাচনে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে যে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সেই আওয়ামী লীগের নেতাকেই মামলায় অভিযুক্ত করায় গতকাল এখানে প্রচারিত সােভিয়েত শান্তি কমিটির এক বিবৃতিতে গভীর দুঃখ প্রকাশ করা হয়। এই বিবৃতিতে সেখ মুজিবের জীবন সম্পর্কেও উদ্বেগ জানানাে হয়েছে।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে : পাকিস্তান সরকার তার কার্যকলাপ দ্বারা পূর্ববঙ্গে আইনসঙ্গত মানবিক অধিকার পদদলিত করেছে এবং পাকিস্তানী জনগণের সুস্পষ্ট রায়কেও অগ্রাহ্য করে দিয়েছে।
উপরােক্ত বিবৃতিতে শান্তি কমিটির পক্ষ থেকে আরও জানানাে হয়।
বাঙলাদেশের জনগণের ইচ্ছা, আকাঙ্খ আইনসঙ্গত অধিকার এবং স্বার্থের প্রতি লক্ষ্য রেখেই এশিয়ায় শান্তি রক্ষার জন্য পূর্ববঙ্গ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের উদ্দেশ্যে জরুরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক।

ভারত-সােভিয়েত যুক্তবিবৃতি ও সি পি এম
প্রত্যেকেই জানেন, দুনিয়ার সমাজতান্ত্রিক অগ্রগতির নায়ক সােভিয়েত ইউনিয়নের বিরােধিতা এবং সাম্যবাদ-বিরােধিতা একার্থক। সমাজতান্ত্রিক শিবিরের বিভীষণ চীনের কুমন্ত্রণা থেকে আমাদের দেশে জাত হয়েছিল কমিউনিস্ট নামধেয় একটি দল বা সংক্ষেপে সি পি এম। অবশেষে পৃষ্ঠপােষক মাওবাদী নেতৃত্বও এই ভূঁইফোড় দলটিকে আবর্জনার স্তূপে নিক্ষিপ্ত করেছিল। তারপর থেকে সিপিএম-এর অবস্থা-না ঘর কা না ঘাট কা। পৃথিবীতে এমন আর কোনাে কমিউনিস্ট নামধেয় পার্টি আছে কি না জানি না, আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট সম্মেলনগুলি যাদের চিটে দিয়েও ছোঁয় না, বিশ্ব কমিউনিস্ট শ্রমিক আন্দোলনের ভ্রাতৃত্বমূলক সংহতি থেকে যারা বহু দূরে দাঁড়িয়ে নিছক জাতীয় থেকে ক্রমশঃ একটি প্রাদেশিক দলে রূপান্তরিত হচ্ছে। পেটি-বুর্জোয়া উকট সুবিধাবাদ দ্বারা জন্ম-মুহূর্ত থেকে চালিত এই দলটির চরিত্রের শেষতম নগ্ন প্রকাশ ঘটেছে ভারত-সােভিয়েত যুক্ত বিবৃতিকে নিন্দা করার মাধ্যমে।
ভারত-সােভিয়েত যুক্তবিবৃতি প্রকাশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সি পি এম-এর সমরাধিনায়ক প্রমােদ দাসগুপ্তের গলায় আবার সােভিয়েত সংশােধনবাদী নেতৃত্বের নিন্দায় মুখর তাদের প্রাক্তন প্রভু মাওবাদী নেতৃত্বের কণ্ঠস্বর শােনা গেল। চীন-প্রীতিতে আপুত প্রমােদবাবুর অবস্থা অনেকটা, যে তােমায় ছাড়ে ছাড় ক, আমি তােমায় ছাড়বাে না মা’! ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বাধীন ভারতে সরকারে কয়েকটি ইতিবাচক কাজের প্রশংসা করে ফেলে সােভিয়েত প্রমােদবাবুর সাচ্চা বামপন্থী বিবেককে ক্ষিপ্ত করে তুলেছে। অবশ্য যেহেতু তাঁর কমিউনিস্ট পার্টি একটি প্রাদেশিক দলে পরিণত হতে যাচ্ছে, তাই তাঁর পক্ষে জানা সম্ভব নয় যে, সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগােষ্ঠী সবসময়ই জোট নিরপেক্ষ ও উন্নয়নশীল দেশগুলির ইতিবাচক কর্ম প্রচেষ্টাকে মুক্ত কণ্ঠে স্বাগত জানিয়ে থাকে। তাছাড়া, এখন হঠাৎ প্রমােদবাবুর এতটা আপসহীন বিপ্লবী হয়ে ওঠার কারণ কি? ইতিপূর্বে সােভিয়েত ইউনিয়ন ও চীন যখন বারবার জওহরলাল নেহরু ও তাঁর নেতৃত্বাধীন সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রমের উচ্ছসিত প্রশংসা করেছে, তখন তিনি ভারতীয় শাসক শ্রেণীগুলিকে এটা উপলব্ধি করতে হয়েছে যে, তাদের সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্ল্যাকমেলকে বাধা দিতে হলে সােভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে মৈত্রী-বন্ধন প্রয়ােজন।”
সােভিয়েত ইউনিয়ন সম্পর্কে সি পি এম-এ, এসব কথা আমাদের কানে অনেকটা ভূতের মুখে রামনামের মতে লেগেছিল। তারপর, হঠাৎ মাত্র দেড় মাসের মধ্যে এমনকি ঘটে গেল, যাতে প্রথমে ঐ পার্টিরই এক নেতা এবং তার পিছে পিছে সি পি এম এর পলিটব্যুরাে হঠাৎ সােভিয়েতের প্রতি সাময়িক দুর্বলতা কাটিয়ে এবং জনসংঘ, স্বতন্ত্র প্রভৃতি মার্কিন-প্রেমী দলকেও লজ্জা দিয়ে একেবারে সরাসরি সােভিয়েত-বিরােধিতায় নেমে পড়লেন?
সমপ্রতি স্বাক্ষরিত ভারত-সােভিয়েত বিবতিটি সি পি এম এক বিরাট অধঃপতন’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। ইন্দিরা সরকারের কিছু কিছু কাজকে প্রশংসা করার পর থেকেই তারা সােভিয়েতের উপর তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠেছিলেন। ভারত-সােভিয়েত বিবৃতির নিন্দা করে সেই জ্বলুনিকেই সর্বসমক্ষে প্রকাশ করা হয়েছে। সি পি এম পলিটব্যুরাে এখন বলেছেন যে, তারা আশা করেছিলেন যে ভারত সােভিয়েত মৈত্রী-চুক্তি বাঙলাদেশকে স্বীকৃতি দানের প্রশ্নে ভারত সরকারের দোদুল্যমানতা কাটাতে সমর্থ হবে। কিন্তু চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর সি পি এম-সম্পাদক ঘােষিত বিবৃতিতে এই আশার কথাটিকে একবারও ভুলেও প্রকাশ করা হয় নি কেন?
সি পি এম পলিটব্যুরাে এরকম বেসামাল উক্তিও করে ফেলেছেন, “যুক্ত বিবৃতিতে রাজনৈতিক সমাধানে পৌছবার জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হয়েছে, যার অর্থ জনগণের অচ্ছেদ্য অধিকার লাভের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণে খুনী ইয়াহিয়াকে আবেদন কর।” ইতিপূর্বে সােভিয়েত যখন বাঙলাদেশ-সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের কথা বলেছিলেন, তখন কিন্তু সি পি এম নেতা সুরাইয়ার কানে তা মধুরই লেগেছিল। পলিটব্যুরাের সাম্প্রতিক উদ্দেশ্যমূলক বিবৃতিটিতে অত্যন্ত পরিকল্পিত ভাবে একথা চেপে যাওয়া হয়েছে যে সােভিয়েত ইউনিয়ন বর্তমান বিবৃতিটিতে পাকিস্তানের অংশ হিসেবে পূর্ব পাকিস্তান না বলে পূর্ব সিমলার এ আই সি সি অধিবেশনে ভারত-সােভিয়ত চুক্তি সম্পর্কে সম্ভবতঃ নতুন প্রস্তাব পেশ করা হবে নয়াদিল্লী, ৩ অক্টোবর (ইউ এন আই)-সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর মস্কো সফরের পর বাঙলাদেশ সম্পর্কের সােভিয়েতের দৃষ্টিভঙ্গীর একটা বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটেছে বলে ইন্দিরা কংগ্রেস হাই কমান্ড মনে করে এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে ভারত-সােভিয়েত চুক্তি সম্পর্কে একটা নতুন প্রস্তাব আসন্ন এ আই সি সির সিমলা অধিবেশনে সম্ভবতঃ পেশ করা হবে।
চুক্তিকে অনুমােদন করে ইতিপূর্বে ওয়ার্কিং কমিটিতে প্রস্তাব গৃহীত হয় এবং সেই প্রস্তাব এ আই সি সি অধিবেশনে পেশ করার কথা ছিল। কিন্তু বর্তমানে চুক্তি সম্পর্কে একটা নতুন প্রস্তাব অধিবেশনে পেশ করা হবে বলে ইন্দিরা কংগ্রেসের বিশ্বস্ত মহল থেকে আজ বলা হয়েছে।
হাই কমান্ড মনে করে যে বাঙলাদেশের মর্মস্ত ঘটনা সম্পর্কে ভারতের যে মূল্যায়ন সােভিয়েত এখন তার অনেক কাছাকাছি এসেছে।
সােভিয়েত যুক্ত বিবৃতিতে ‘পূর্ব-পাকিস্তানের পরিবর্তে পূর্ব বঙ্গ’ শব্দটি ব্যবহার করেছে। এখানে স্মরণ করা যেতে পারে যে শরণ সিং-গ্রোমিকো যুক্ত বিবৃতি পূর্ব পাকিস্তান’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছিল। এছাড়াও সােভিয়েত বাঙলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান সম্পর্কে আরও সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা উচ্চারণ করেছে।
সােভিয়েত প্রধানমন্ত্রী শ্রী কোসিগিন দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘােষণা করেছেন যে তাঁর দেশের সহানুভূতি পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক শক্তি সমূহের প্রতি গণহত্যার নায়ক সামরিক জুন্টার প্রতি নয়।
ভারত-সােভিয়েত চুক্তি সম্পর্কে নতুন প্রস্তাব প্রচণ্ড সমর্থন পাবে বলে আশা করা যায়। কিন্তু শরণার্থী আগমন সম্পর্কে সদস্যরা যে উদ্বেগ প্রকাশ করবেন তা পর্যবেক্ষক মহল অনুমান করেছেন এবং মনে করেছেন যে এ সমস্যা সমাধানের জন্য প্রতিনিধিরা বাঙলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দানের দাবি জানাবেন।

সূত্র: কালান্তর, ৪.১০.১৯৭১