You dont have javascript enabled! Please enable it!

সােভিয়েত ভেটো

যারা আক্রান্ত ও আক্রমণকারীকে সমপর্যায়ভুক্ত করতে চেয়েছেন, পাকিস্তান সরকারের দায়দায়িত্বকে ভারতের স্কন্ধে চাপিয়ে অপরাধমূলক ও মানবতাবিরােধী কার্যকলাপ থেকে পাকিস্তানের শাসকচক্রকে রক্ষা করতে চেয়েছেন, সােভিয়েত ইউনিয়ন জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে সেই মার্কিন প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভেটো প্রয়ােগ করেছে। এর অর্থ সুদূর প্রসারী, তাৎপর্য ও আন্তর্জাতিক গুরুত্ব সম্পন্ন। নিরাপত্তা পরিষদে এই ভেটোর অর্থ হচ্ছে, পাক-ভারত যুদ্ধে যদি কোন বহির্শক্তি হস্তক্ষেপ করে তাহলে পাক-ভারত উপমহাদেশে তারাই বিশ্বযুদ্ধের বিপদ সৃষ্টি করবে। অতএব বিশ্বযুদ্ধের সমস্ত দায়দায়িত্ব তাদেরই। সােভিয়েত ইউনিয়ন এই ভেটোর মাধ্যমে পাকিস্তানের দোসরদের সতর্ক করে দিয়েছে। ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানকে রক্ষা করার জন্য নিরাপত্তা পরিষদকে ব্যবহার করার মার্কিনী প্রচেষ্টা ব্যর্থ হল। অতএব এই সম্পূর্ণ নতুন পরিস্থিতিতে যে তাসখন্দ চুক্তির পুনরাবৃত্তি হবে না, পাক-ভারত সীমান্ত থেকে সৈন্য অপসারণ বা অস্ত্র সংবরণ হবে না তা বলাই বাহুল্য মাত্র। ইয়াহিয়া খানের শেষ যুদ্ধের ঘােষণা বাস্তবিক পক্ষে আক্রমণকারীকে নখদন্তহীন করার মধ্যেই পরিসমাপ্তি ঘটবে। মার্কিন অস্ত্র ও চীনের সমর্থন ইয়াহিয়া খানকে রক্ষা করতে পারবে না, বাঙলাদেশে মুক্তি সংগ্রামকে ধ্বংস করতে পারবে না অথবা ভারতের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বকেও বিপন্ন করতে পারবে না। ভারত-সােভিয়েত চুক্তির ফলে পুরাতন ভারতের পরিবর্তে এক নতুন ভারতের অভ্যুদয় হয়েছে। এই সত্যটি যেমন জঙ্গীশাহী ইতিমধ্যে টের পাচ্ছে, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদও হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করছে।
সােভিয়েতের সঙ্গে ভারতের মৈত্রী চুক্তির ধার কত তা যারা পরখ করতে চান তাদের জন্য সুবর্ণ সুযােগ উপস্থিত। ভারত-সােভিয়েত মৈত্রী চুক্তির পূর্বে কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তের বিরুদ্ধে। সােভিয়েত ভেটো প্রয়ােগ করেছিল। কিন্তু এবারকার ভেটোর মৌলিকত্ব আছে। এই ভেটোর সঙ্গে বাঙলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের এবং সাম্রাজ্যবাদী প্ররােচনায় ভারত আক্রমণকারীকে পরাস্ত করার প্রশ্ন। অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। জাতীয় মুক্তি সংগ্রামকে সােভিয়েত বার বার সাহায্য ও সমর্থন করেছে। সদ্য স্বাধীন দেশের নিরাপত্তা বিধানের জন্য সােভিয়েত ইউনিয়ন সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে নিস্বার্থভাবে ও দৃঢ়তার সঙ্গে দণ্ডায়মান হয়েছে। কিউবা, ভিয়েতনাম, আলজেরিয়া, আরব রিপাব্লিক ও ভারত ইত্যাদি তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। আজ একথা ভুলে গেলে চলবে না যে আধুনিক মরণাস্ত্রে সুসজ্জিত সাম্রাজ্যবাদের দানবীয় শক্তি জাতীয় মুক্তিগ্রামকে ধ্বংস করার যুদ্ধ শেষ হয়েছে।
মনে রাখা দরকার যে এই যুগের লড়াই কেবল সৈন্যবাহিনী গড়ে না। বাঙলাদেশের ঘটনাবলী তার একটা অন্যতম দৃষ্টান্ত। ভারতের সৈন্যবাহিনী ও বাঙলাদেশের মুক্তিযােদ্ধারা একই সঙ্গে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের দোসর ও যুদ্ধ জোটের সদস্য পাকিস্তানের জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে যৌথভাবে লড়ছে। আর ভারতের মানুষ দলমত-নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধভাবে পাকিস্তানের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে এবং বাঙলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের পক্ষে দৃঢ়ভাবে সরকারকে সমর্থন করছেন। এই পরিস্থিতিতে নিরাপত্তা পরিষদে সােভিয়েতের ভেটো হল সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী ধর্ম, যুদ্ধবাজদের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তীক্ষ হুসিয়ার।
বাঙলাদেশে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে এবং যাকে কেন্দ্র করে সাম্রাজ্যবাদের ক্রীড়ানক পাকিস্তান ভারত আক্রমণ করেছে সেই ইতিহাসের দেনা নতুন ইতিহাস তৈরি করেই মেটাতে হচ্ছে। পাক-ভারত উপমহাদেশে সেই নতুন ইতিহাস সৃষ্টির প্রক্রিয়া চলেছে। সেই প্রক্রিয়ায় সােভিয়েতের ভূমিকা অপরিসীম। ভারত-সােভিয়েত মৈত্রী চুক্তির মুল্যও অসাধারণ।

সূত্র: কালান্তর, ৬.১২.১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!