ধিক নিক্সন
মার্কিন রাষ্ট্রপতি নিক্সনের কাছে গণহত্যা সরকারী অনুমােদন পেল। দক্ষিণ-ভিয়েতনামের মাই-লাই নামক স্থানে মার্কিন বর্বরতা নিরস্ত্র নরনারীকে যেভাবে খুন করে সেই নৃশংসতার কাহিনী শুনে সারা বিশ্বের লােক শিউরে উঠেছিল। সেই গণহত্যার প্রধান পাণ্ডা নরপিশাচ ফার্স্ট লেফটেনান্ট উইলিয়ম ক্যালি। মার্কিন আদালতে তার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। আদালতের রায় নস্যাৎ করে রাষ্ট্রপতি নিক্সন তাকে অবিলম্বে মুক্তিদানের আদেশ দিয়েছেন। তার অর্থ রাষ্ট্রপতি নিজেই মার্কিন আইন পদদলিত করলেন।
ভিয়েতনামে মার্কিন জল্লাদদের গণহত্যা একাধিক ক্ষেত্রেই হয় এবং এখনাে হচ্ছে। কিন্তু মাই-লাই এর ঘটনা মার্কিন সাংবাদিকরা এমনভাবে মার্কিন পত্রিকায়ই প্রকাশ করে দেন যে তা আর চাপা দেয়া সম্ভব হয় না। তখন বাধ্য হয়েই মার্কিন কর্তৃপক্ষ এই জঘন্য হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে একটা তদন্তের ব্যবস্থা করেন। তদন্তের সময় হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একাধিক মার্কিন সেনা স্বীকারােক্তিতে ঘটনার যে বিবরণ দেয় তা ললামহর্ষক। আকস্মাৎ মার্কিন দানবরা মাই-লাই গ্রামে হানা দিয়ে সেখানকার আবালবৃদ্ধবনিতাকে নির্বিচারে হত্যা করে। গ্রামের সবাই ছিল নিরস্ত্র। হত্যার পদ্ধতি অতীব নৃশংস। পুরুষের জননেন্দ্রিয় ছেদন, নারীর লজ্জাস্থানে সঙ্গীন প্রবেশ করানাে ও স্তন কর্তন, শিশুর চক্ষু উৎপাটন, বৃদ্ধের কণ্ঠনালীকে লৌহশলাকা বিদ্ধকরণ ইত্যাদি দুষ্কার্যগুলির কোনটাই বাদ যায়নি। মাতার স্তন কেটে দিয়ে শিশু সন্তানকে তার বুকের ওপর ছেড়ে দেয়া হয়-মায়ের সামনে তার সন্তানকে সঙ্গীন দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়।
সাক্ষ্যসাবুদে প্রমাণিত হয় যে দলনায়ক উইলিয়াম কালির নির্দেশেই নরপশুদের দ্বারা এসব নৃশংস কাজ হয়। আদালত তদনুসারে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে। ৩১ মার্চ এই কারাদণ্ডের আদেশ হয়। নিক্সনের আর তর সয়নি। ১ এপ্রিল রাত্রেই তার মুক্তির আদেশ দেন তিনি। গণহত্যার অপরাধে যে পাষণ্ডের শাস্তি হয়েছে আদালতের বিচারে সেই অপরাধীকে মুক্তি দিয়ে নিজের দেশের আদালতকেই যে তিনি শুধু হেয় করলেন এমন নয়, একটি রাষ্ট্রের কর্ণধার হয়ে গণহত্যার প্রশ্রয়দাতারূপে বিশ্ববাসীর সামনে এক কলঙ্কজনক নজীরও স্থাপন করলেন।
যুদ্ধরত দুটি দেশের কোনাে পক্ষেরই নিরস্ত্র অধিবাসীদের ওপর অস্ত্র প্রয়ােগ করা আন্তর্জাতিক বিধি অনুসারে নিষিদ্ধ। অবশ্য এই বিধি আজকাল পালিত হয় না বিমান আক্রমণের ফলে। বহুক্ষেত্রে বেসামরিক অধিবাসীদের ওপরও বােমা বর্ষিত হয়—এমন কি হাসপাতাল এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিও বাদ যায় না। এ ধরনের বিধিলন আজকাল একরকম গা-সওয়া হয়ে গেছে। কিন্তু সশস্ত্র অবস্থায় দল বেধে গিয়ে কোথাও যদি নির্বিচারে নিরস্ত্র সাধারণ মানুষকে অমানুষিক পীড়ন, নির্যাতন ও খুন করা হয় তবে সেটা আন্তর্জাতিক বিধানে ও মানবতার দরবারে ঘৃণ্যতম অপরাধ বলেই গণ্য হয়ে থাকে। হিটলারের চমুরা একদিন এভাবেই অসংখ্য ইহুদী হত্যা করেছিল। মহাযুদ্ধের অবসানে আন্তর্জাতিক আদালতে তাদের কোনাে কোনাে দুর্বত্তের সাজা হয়। অথচ মার্কিন নরপশুরা ভিয়েতনামে দিনের পর দিন এরূপ জঘন্য অপরাধ করে দিব্যি রেহাই পাচ্ছে। হাতেকলমে ধরা পড়ে যাও বা একজনের সাজা হলাে, রাষ্ট্রপতি নিক্সন সঙ্গে সঙ্গে তাও নির্লজ্জের মতাে মকুব করে দিলেন। ক্ষমতার মদমত্ততার কাছে মানবতাকে বলি দেয়া হলাে।
আজ ঘরের পাশেই দেখছি এই বর্বরতার উলঙ্গ নৃত্য। ইয়াহিয়া খানের নরপশুরা পূর্ববঙ্গের মাবােনদেরও রেহাই দিচ্ছে না। শিশুরাও সেখানে বলি হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ন’জন বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক বর্বর পাঞ্জাবী সৈন্যদের শিকার হয়েছেন। নারী-ধর্ষণেরও খবর আসছে। দোকান-পাট, গৃহস্থ বাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও হাসপাতাল কামানের গােলা ও বােমায় উড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। বাড়িতে বাড়িতে ঢুকে ঘুমন্ত অবস্থায় নরনারী ও শিশুকে হত্যা করতেও নরপিশাচরা বিন্দুমাত্র কুণ্ঠিত হচ্ছে না। রাষ্ট্রপতি নিক্সনের বিচারে এরাও নিশ্চয়ই নিরপরাধ। কিন্তু বিশ্বমানবতার দরবারে এরা জঘন্যতম অপরাধে অপরাধী। গণহত্যা করে অপরাধীরা যদি সাজা না পায়, রাষ্ট্রের কর্ণধার যদি তাতে প্রশ্রয় দেন, তবে মানবতার চরম দুর্দিন বলতে হবে।
রাষ্ট্রপতি নিক্সন মানবতাকে যেভাবে জঙ্গীবাদের কাছে বলি দিলেন তার বিরুদ্ধে সারা দুনিয়ায় ধিক্কার ধ্বনি উথিত হওয়া উচিত।
সূত্র: কালান্তর, ৪.৪.১৯৭১