You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা : ৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৩, শনিবার, ২০শে মাঘ, ১৩৭৯ বঙ্গাব্দ

নির্বাচনের দামামা বেজেছে

বাংলাদেশের সকল অতীত ও বর্তমান রাজনৈতিক আন্দোলনের বীর নেতৃত্বদানকারী সংগঠন আওয়ামী লীগ স্বাধীন বাংলার প্রথম সাধারণ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য তার দলীয় মনোনয়নপ্রাপ্ত কর্মীদের নাম ঘোষণা করেছে। গত পরশুদিন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের পার্লামেন্টারী বোর্ডের সম্পাদক জনাব জিল্লুর রহমান এক সাংবাদিক সম্মেলনে মনোনীত প্রার্থীদের নামের তালিকা প্রকাশ করেছেন। মোট তিনশতটি আসনের মাঝে একটি ছাড়া সবগুলো আসনেই আওয়ামী লীগ প্রতিনিধি দিয়েছেন। বাকী একটিও আজ-কালের মধ্যেই ঘোষণা করা হবে বলে জানা গেছে। আগামী সাধারণ নির্বাচনে দেশের বিভিন্ন দল অংশগ্রহণ করতে চলেছে। অন্যান্য সংগঠনও তাদের প্রার্থীদের দু’একদিনের মধ্যেই মনোনয়ন দেবে। ক্ষমতাসীন সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অন্যান্য দলের প্রতিদ্বন্দ্বিতা খুব একটা জোরদার না হলেও বেশ জমবে বলে অশা করা যাচ্ছে। তবুও অভিজ্ঞ মহলের ধারণা আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় এককভাবে হবে। মোটামুটি আওয়ামী লীগের বিজয় দেশবাসীর সামনে বেশ সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এতদসত্ত্বেও নির্বাচনী তোরজোড় বেশ হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্যান্য সংগঠন দু’এক দিনের মধ্যেই হয়তো তাদের দলীয় মনোনয়ন দেবার কাজ শুরু হবে প্রচারণার কাজ। নির্বাচনে আশা করা যাচ্ছে—ন্যাপ মোজাফফর পন্থীরা সবগুলো আসনেই প্রতিনিধি দেবে। অন্যান্যদের মধ্যে ন্যাপ ভাসানী পন্থী হয়তো সবগুলো আসনে প্রতিনিধি যোগাড় করতে পারবে না যদিও ইতিপূর্বে তারা ঘোষণা করেছিল তিনশ’টি আসনেই তারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। এ ছাড়া জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলও সবগুলো আসনে প্রার্থী দাঁড় করতে সক্ষম হবে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। জাতীয় লীগের দুইটি দলের ব্যাপারেও তেমনি কোন কিছু সুস্পষ্ট নয়। তবু আশা করা যাচ্ছে সবাই কিছু কিছু প্রার্থী সুযোগ-সুবিধা বুঝে দাঁড় করাবে। অভিজ্ঞমহল আশা করছেন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে তেমন কোন চ্যালেঞ্জ আসবে না। বিগত নির্বাচনের কথা এ প্রসঙ্গে আমরা স্মরণ করতে পারি। আওয়ামী লীগের প্রায় প্রতিটি প্রার্থীর কাছেই অন্যান্য সংগঠনের প্রার্থীকে জামানত বাজেয়াপ্ত করে পরাজয় বরণ করতে হয়েছিল। বাংলার নয়নমণি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গোটা জাতির কাছে এমন একটি বিশ্বস্তপ্রাণ, যাঁর আহ্বানে দেশের আপামর জনগণ নির্দ্বিধায় সাড়া দিতে পারে। বিগত নির্বাচনে তাই গোটা জাতি প্রতিনিধি কে তার বিবেচনা না করেই নৌকায় ভোট দিয়েছিল। আমরা এবারও সুস্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছি বঙ্গবন্ধুর অসাধারণ জনপ্রিয়তা। এবারও জনতা বঙ্গবন্ধুর নৌকায় ভোট দেবে কোন প্রশ্ন বা দ্বিরুক্তি না করেই। পাকিস্তানের জন্মের পর থেকেই মুসলিম লীগ সরকার বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিল। তাঁরা সর্বপ্রথম বাঙালীর মুখে ভাষা কেড়ে নেবার ষড়যন্ত্র করে। সুপরিকল্পিতভাবে এদেশের স্বাধিকারকে, এদেশের বিভিন্ন দাবী দাওয়াকে অস্বীকার করে। এ সকল ষড়যন্ত্রমূলক পরিকল্পনা সুস্পষ্টভাবে লক্ষ্য করেছিলেন বাংলার তৎকালীন কয়েকজন জনপ্রিয় নেতা। সেদিন তাঁরা বাংলার ভবিষ্যত চিন্তা করে মুসলিম লীগের মোকাবেলার জন্য এবং বাংলার ভবিষ্যত সুন্দর কামনা করে আওয়ামী লীগ গঠন করেন সেদিন থেকেই বাংলাদেশের ভাগ্য কি হবে তার চরম পরীক্ষার আন্দোলন শুরু হয়। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের দ্বার উদ্ঘাটন হয় তার আলোকেই জাতীয়তাবোধের সুন্দর ও সুস্পষ্ট বিকাশ ঘটে। এর থেকেই জাতি তার আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। একে একে বাষট্টি, ছেষট্টি ও ঊনসত্তরের আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে দেশে একটি পূর্ণ গণজাগরণ হয়। ইতিহাসের অমোঘ নিয়ম অনুযায়ী শত্রুর পরাজয় হয়। সত্তরের নির্বাচনে সামরিকশক্তির পতন অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। এবং সেই নিশ্চিত পরাজয়কে মেনে নিতে না পারার ফলেই একদিন সামরিক পশুশক্তি তার সকল ক্ষমতা দিয়ে বাঙালীকে নিশ্চিহ্ন করার আক্রমণ চালায়। এরপর শুরু হয় মুক্তি আন্দোলন এবং মুক্তি আন্দোলনের শেষ হয় মুক্তি বাহিনীর বিজয়ের মাধ্যমে। বাংলাদেশর জন্মের মধ্য দিয়ে। অতীতের সকল আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছে আওয়ামী লীগ। আর তার নেতা ছিলেন বাংলার সাত সাড়ে কোটি মানুষের প্রাণপ্রিয় ভাই শেখ মুজিব। আজ সেই স্বাধীন বাংলার মাটিতে প্রথম সাধারণ নির্বাচন হতে চলেছে। আওয়ামী লীগ স্বইচ্ছায় ক্ষমতা ছেড়ে নির্বাচনের সামনে দাঁড়িয়েছে। যারা একদিন বলতেন পাকিস্তানী নির্বাচন দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পরিচালনা চলতে পারেনা তাদের সামনে আজ এসেছে নির্বাচন। আওয়ামী লীগের সুস্পষ্ট বক্তব্য—সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে জয়যুক্ত হয়ে যারা ক্ষমতায় আসবে তারাই দেশ চালাবে। দেশের ভাগ্যনিয়ন্ত্রণ করবে। আমরাও আশা কিরি বিরোধী দলগুলো অযথা বক্তব্য না দিয়ে গণতান্ত্রিক পথে নির্বাচনে অবতীর্ণ হোন এবং নিজেদের জনপ্রিয়তা যাচাই করুন। এদেশর গণতন্ত্রের ইতিহাসে যে নতুন অধ্যায় সংযোজিত হতে চলেছে তাকে নতুন আদর্শ ও নতুন প্রত্যয়ে নির্বাচনমুখী দলগুলো সজীব করে তুলবেন বলেই আমরা আশা রাখি।

পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধাদের মাসিক ভাতা

মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট কর্মহীন পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধাদের এক বছরের জন্য মাসিক পঁচাত্তর টাকা করে ভাতা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। গত বৃহস্পতিবার এক সাংবাদিক সম্মেলনে ট্রাস্টের চেয়ারম্যান ও ত্রাণমন্ত্রী জনাব এ.এইচ.এম. কামরুজ্জামান এ তথ্য প্রকাশ করেন।
জনাব কামরুজ্জামান বলেন, প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণের জন্য বিশেষভাবে আগ্রহী। তিনি নিজে উদ্যোগ নিয়ে এ ট্রাস্ট গঠন করেছেন।
স্বাধীনতা সংগ্রামের সূর্য সৈনিকদের পুনর্বাসনের দায়িত্ব প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এ দায়িত্ব আমাদের জাতীয় দায়িত্ব। কল্যাণ ট্রাস্টের লক্ষ্য হলো মুক্তিযোদ্ধা বিশেষ করে যাঁরা পঙ্গু বা অক্ষম তাঁদেরকে এমনভাবে পুনর্বাসন করা যাতে তাঁরা সমাজের বোঝা হয়ে থাকতে বাধ্য না হন। তাঁদের জীবন যাতে অর্থপূর্ণ হয় সেদিকেই লক্ষ্য রাখা হবে।
তিনি আরো বলেন যে, মুক্তিযোদ্ধারা যাতে আত্মনির্ভরশীল হবার প্রকৃত পথ বেছে নিতে পারেন ট্রাস্ট তারই উপর বিশেষ গুরুত্ব দেবে।
কল্যাণ ট্রাস্টের চেয়ারম্যান ও ত্রাণমন্ত্রী পঙ্গু ও কর্মহীন মুক্তিযোদ্ধাদের মাসিক ভাতা প্রদানের যে সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করেছেন অত্যন্ত সময়োপযোগী। এ ধরনের উদ্যোগ আগেই নেয়া উচিত ছিল। অবশ্য এ ব্যাপারে নানাবিধ অসুবিধা যে ছিল না এমন নয়।
এ কথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে, যাঁরা স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নিয়েছিলেন, যাঁরা মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য সব কিছু ছেড়ে লড়াইয়ের ময়দানে অবতীর্ণ হয়েছিলেন তাঁদের প্রতি জাতি ও সরকারের একটা বিশেষ দায়িত্ব রয়েছে। মুখোমুখি সংগ্রাম করতে গিয়ে যাঁরা পঙ্গু হয়েছেন তাঁদের সমস্যা তো আরো গভীর। স্বাধীনতা লাভের পর একটি বছর অতিবাহিত হয়েছে আর এ সময়ের মধ্যে তাঁদের জীবনে নেমে এসেছে হাজারো সমস্যার পাহাড়। তন্মধ্যে আর্থিক সমস্যা তো রয়েছেই। দেশ স্বাধীন হবার পর হয়তো স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়েই পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছিলেন কিন্তু সময়ের স্রোত প্রবাহিত হবার সঙ্গে সঙ্গে সে উৎসাহেও ভাটা পড়েছে। পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধাদের অভাব-অভিযোগ সম্পর্কিত সংবাদ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। একদিকে পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধাদের সমস্যা অন্যদিকে কর্মহীন মুক্তিযোদ্ধা। কর্মহীন মুক্তিযোদ্ধা যাঁরা দেশের মুক্তির জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করেছিলেন তাদের কর্মসংস্থানের দায়িত্বও সরকারকে নিতে হবে।
অবশ্য মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয়েছে যে, মুক্তিযোদ্ধারা যাতে আত্মনির্ভরশীল হবার প্রকৃত পথ বেছে নিতে পারে ট্রাস্ট তারই উপর গুরুত্ব দেবে। আমরা মনে করি ট্রাস্টের প্রধান ও প্রথম লক্ষ্য হওয়া উচিত এটাই।
কথায় বলে তোলা দুধে পোলা বাঁচে না। মাসিক ভাতা দিয়েও মুক্তিযোদ্ধাদের সমস্যার সমাধান করা যাবে না। তাছাড়া মাসিক পঁচাত্তর টাকা দিয়ে জীবন ধারণ করা সম্ভব নয়। তাই আমরা বলবো, বাংলাদেশ কুটির শিল্পের দিক দিয়ে একটি সম্ভাবনাময় দেশ। এদেশের কুটির শিল্প একদিকে যেমন দেশের আভ্যন্তরীণ পণ্যের চাহিদা মেটাবে অন্যদিকে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সহায়ক হতে পারে। সোহরাওয়ার্দী ময়দানে মুক্তিযোদ্ধাদের সাম্প্রতিক সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের কুটির শিল্পে মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসনের কথা বলেছিলেন। মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট যদি এদিকে দৃষ্টি দেয় তাহলে কর্মহীন মুক্তিযোদ্ধাদের চাকুরীর সংস্থান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশের কুটির শিল্পও সুসংগঠিত এবং সমৃদ্ধ হবে। আমরা আশা করি পরনির্ভরশীল না হয়ে মুক্তিযোদ্ধারা যাতে আত্মনির্ভরশীল হতে পারেন সে উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যকে সামনে রেখেই ট্রাস্ট এগিয়ে যাবেন।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!