জনসংঘ-র পররাষ্ট্র নীতি
মার্কিন প্রেসিডেন্ট মিঃ নিক্সনের চীন সফরের কথা শুনে জনসংঘর্ষ উল্লসিত। কেবল জনসংঘ নয়, বিভিন্ন দেশের মার্কিনপ্রেমী ও মার্কিন অনুগত রাষ্ট্রনায়কেরা সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। বিশ্বের রাজনৈতিক পরিস্থিতি পরিবর্তনের অনুকূলে এক যুগান্তকারী ঘটনা বলে অভিহিত করেছেন মার্কিন অনুগামীরা। কেউ কেউ আবার একে বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় নব অধ্যায় বলেও মত প্রকাশ করেছেন। বিশ্ব শান্তির চরম শত্রু মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে জনসংঘ ভারতের পরম বন্ধু মনে করে।
জনসংঘের নেতা বলেছেন যে, চীন ও আমেরিকার মধ্যে সমঝােতা হলে পাকিস্তানের অবস্থার উন্নতি হবে। আবার জনসংঘরা বাঙলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেবার জন্য ভারত সরকারের কাছে দাবিও করেছেন। চীন-মার্কিন সমঝােতায় পাকিস্তানের উন্নতির অর্থই হচ্ছে বাঙলাদেশ মুক্তিসংগ্রামের সমূলে বিলােপ সাধন এবং বাঙলাদেশকে পাকিস্তানের মধ্যে পদানত করে রাখা। এই কারণে জনসংঘীরা পাকিস্তানকে মার্কিন অস্ত্র সরবরাহ করার বিরুদ্ধে কোন প্রকার প্রতিবাদ করেন নি। একদিকে জনসংঘীরা পাক-মার্কিন ও চীনের সহযােগিতায় পাকিস্তানের সার্বিক উন্নতি কামনা করেন, আবার অন্যদিকে বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য ভারত সরকারের কাছে দাবি উপস্থাপিত করেছেন। জনসংঘদের এই পরস্পর-বিরােধী কৌশল অনুধাবন করা আমাদের পক্ষে মুশকিল। একই সঙ্গে বাঙলাদেশের মুক্তি এবং পাকিস্তানের উন্নতি যে অসম্ভব তা যে কোন ব্যক্তিরই বােঝা আদৌ কঠিন নয়। সম্ভবতঃ মার্কিন-প্রীতির জন্য তারা এই বিরােধকে শীঘ্রই সমাধান করবেন।
জনসংঘের নেতারা বার বার ভারতের পররাষ্ট্র নীতির বিরুদ্ধে আঘাত হেনেছে। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। লােকসভার বিগত নির্বাচনী অভিযানে জনসংঘীরা ভারতের পররাষ্ট্র নীতিকে সােভিয়েত ইউনিয়নের মুখাপেক্ষী বলে আক্রমণ করেছিলেন। সােভিয়েত ইউনিয়ন ও সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করে ভারতকে মার্কিন শিবিরভুক্ত করাই জনসংঘের দাবি। চীনে মিঃ নিক্সনের সফরকে উপলক্ষ করে সেই পুরাতন দাবি নতুন ভাবে আত্মপ্রকাশ করেছে। জনসংঘীরা দাবি করেছেন, ভারতকে পুরান জোট-নিরপেক্ষ নীতি পরিত্যাগ করে মার্কিন শিবিরভুক্তির অনুকূলে নতুনভাবে পররাষ্ট্র নীতি গ্রহণ করতে হবে। নতুবা ভারত নাকি আরও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। অর্থাৎ তারা চান, মার্কিন সাম্রাজ্যাবাদ, চীন ও ভারত একই শিবিরভুক্ত হােক। নতুন পরিস্থিতিতে এটাই হল তাদের মূল নীতি যার বেদীমূলে তারা শীঘই বাঙলাদেশকে বলি দিতে উদ্যত হবেন। সােভিয়েত ও সমাজতান্ত্রিক দেশ থেকে ভারতকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করাই তাদের নীতি। আজ সেই সুযোেগ উপস্থিত হয়েছে। বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলন থেকে চীনের বিচ্ছিন্নতা, সােভিয়েত বিদ্বেষ এবং সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের প্রতি চীনের অনীহা সেই সুবর্ণ সুযােগ উপস্থিত করেছে। সােভিয়েত বিদ্বেষী সমাজতান্ত্রিক চীন ও সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন রাষ্ট্রনেতাদের মিলনের আশায় জনসংঘ ভারতের পররাষ্ট্র নীতিকে সাম্রাজ্যবাদের মুখাপেক্ষী করে তুলতে চায়।
তাঁদের যে নীতি বিগত নির্বাচনে পরাজিত ও প্রত্যাখ্যাত হয়েছে সেই নীতিকেই আবার তারা পুনরুজ্জীবিত করতে চান। জনসংঘের মত প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি পরাজিত হলেও এখনও তারা সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে থেকে নির্মূল হয়নি। এঁদের নীতি ও কার্যকলাপ সম্পর্কে দেশবাসীকে সতর্ক থাকতে হবে। কেবল তারা পররাষ্ট্রনীতিরই পরিবর্তন চায় না, অভ্যন্তরীণ নীতির ক্ষেত্রে তারা প্রতিক্রিয়াশীল পরিবর্তন আনার জন্য সচেষ্ট। অতএব দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি যে মাথা তুলবে তাতে বিস্মিত হবার কিছু নেই।
সূত্র: কালান্তর, ২০.৭.১৯৭১