উ-থান্টের মধ্যস্থতা প্রস্তাবে আবার জাতিসংঘ পর্যবেক্ষক নিয়ােগের পরামর্শ
জাতিসংঘ, ২৮ অক্টোবর-এ পি’র সংবাদে জানা গেল, ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে উত্তেজনা প্রশমনের জন্য জাতিসংঘের সেক্রেটারী জেনারেল উ-থান্ট মধ্যস্থ করার আবেদন জানিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ও পাকিস্তান প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছে একটি তারবার্তা প্রেরণ করেছিলেন। জাতিসংঘের পক্ষ থেকে আজ একথা স্বীকৃত হয়েছে।
এই তারবার্তায় উ-থান্ট সেই পুরােন কায়দায় পূর্ব-বাঙলা সীমান্তে পর্যবেক্ষকদল প্রেরণের পরামর্শ পুনরুচ্চারিত করেন। আর ভারত পর্যবেক্ষক প্রেরণের প্রস্তাব বহুদিন আগেই বাতিল করে দিয়েছে।
উ-থান্ট তার তারবার্তায় বলেছিলেন, জম্মু-কাশ্মীরের যুদ্ধ বিরতি সীমারেখায় জাতিসংঘের একদল সামরিক পর্যবেক্ষক রয়েছে। কিন্তু পূর্ব বাঙলা সীমারেখায় এবং ভারত ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যবর্তী আন্তর্জাতিক সীমারেখায় কোন পর্যবেক্ষক দল নেই।
উ-থান্ট বলেছেন, “এই অতি বিপদজনক অবস্থায় বিপর্যয়ের সম্ভাবনা সৃষ্টিকারী পরিস্থিতি পরিহারের জন্য দুই সরকারকে অবিলম্বে সজাগ করে তােলার জন্য জাতিসংঘের সাধারণ সম্পাদক হিসাবে সবদিক থেকে সহযােগিতা করা আমার কর্তব্য।”
তিনি আরাে বলেন, “আপনারা যদি বিশ্বাস করেন আমার মধ্যস্থতা কোন সময়ে আপনাদের পক্ষে সহায়ক হবে তবে আমি সেই মধ্যস্থতা করার ইচ্ছা ব্যক্ত করছি।”
উ-থান্ট ৩০ অক্টোবর এই তারবার্তা পাঠান। তিনি আরাে বলেছেন, সাম্প্রতিক ঘটনাবলী আমার উদ্বেগ যথেষ্ট বাড়াতে সাহায্য করেছে, কারণ এই পরিস্থিতি দু’দেশের মধ্যে খােলাখুলি বৈরিতা বাড়াতে সাহায্য করবে, যা শুধুমাত্র ঐ দুটি দেশের পক্ষেই বিপর্যয়কর হবে না, ব্যাপক শান্তির পক্ষেও এ একটি বিরাট হুমকি।
উ-থান্টের দপ্তর থেকে জানানাে হয় যে, ২০ অক্টোবর এই তার বার্তাটি নিরাপত্তা পরিষদে সভাপতির কাছে জমা দেওয়া হয়েছিল।
বােঝাপড়া ছিল এই তারবার্তার বক্তব্য গােপন রাখা হবে।
কিন্তু তারবার্তার বক্তব্য সম্পর্কে নানারকম সংবাদ প্রকাশিত হওয়ায় গতকাল এটি জনসমক্ষে প্রচার করা হয়।
জাতিসংঘ কমিটির কাছে সমর সেনের বক্তব্য
এ পি-র আর এক সংবাদে জানা গেল জাতিসংঘের ভারতীয় রাষ্ট্রদূত শ্ৰীসমর সেন বলেছেন, বিশ্বের চোখে ভারতকে হেয় করার উদ্দেশ্যেই পাকিস্তান সৈন্য সরিয়ে নেবার প্রস্তাব করেছে।
গতকাল জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের মুখ্য রাজনৈতিক কমিটিতে ভাষণদানের কালে শ্রীসেন বলেন, পাকিস্তানের সৈন্য সরানােই যদি মূল উদ্দেশ্য হয় তবে তারা কে প্রথমে সীমান্তে সৈন্য এনেছিল।
তিনি আরাে বলেন, এ মাসের ১৪ তারিখের মধ্যে পাকিস্তান সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ শেষ করেছে। তারই পরিপ্রেক্ষিতে এবং আত্মরক্ষার দিকে নজর রেখে আমরাও আমাদের সৈন্য সীমান্তে নিয়ে এসেছি।
এই পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তানের তথাকথিত প্রস্তাবটি তিনি উল্লেখ করেন। পাকিস্তান প্রস্তাব করেছিল, ভারত সৈন্য সরালে অনুপ্রবেশ ও অন্যান্য বৈরী কার্য বন্ধ করলে পাকিস্তান সীমান্ত থেকে সৈন্য সরিয়ে নেবে। শ্রীসেন বলেন, “কমিটি বিষয়টি লক্ষ্য করবেন, তাঁর কোন সন্দেহ নেই।”
শ্রীসেন জানান, ভারত কেন অতিরিক্ত জাতিসংঘে পর্যবেক্ষক নিয়ােগের প্রস্তাব বাতিল করেছে তার কারণ প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ১৯ অক্টোবর সাংবাদিকদের কাছে ব্যক্ত করেছেন। ভারত মনে করে এর কোন দরকার নেই।
উ-থান্টের এসে লাভ কি : প্রধানমন্ত্রী
গতকাল এ পি’র এক সংবাদে জানা গেল প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী গতকাল ভিয়েনায় অস্ট্রিয়া প্রেস এজেন্সির সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বলেন, শরণার্থী আগমন ও ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ থেকে উদ্ভূত পরিস্থিতি প্রত্যক্ষ করার জন্য জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল উ-থান্ট ভারতে আসুন—এ প্রস্তাবকে তিনি খুব যুক্তিযুক্ত মনে করেন না।
শ্ৰীমতী গান্ধী উ-থান্টকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের আমন্ত্রণ সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন। তবে তিনি বলেন, তবে শ্রী উ-থান্ট আসতে চাইলে তিনি আপত্তি করবেন না।
শ্ৰীমতী গান্ধী বলেন, বর্তমান অবস্থা সমাধানের চাবিকাঠি তাে পাকিস্তানের হাতেই রয়েছে। পরিস্থিতি অত্যন্ত গুরুতর এবং ভারতের নিরাপত্তা বিপদের মুখে এসে পড়েছে।
শরণার্থী প্রত্যাবর্তন প্রত্যক্ষ করার জন্য ভারত জাতিসংঘের পর্যবেক্ষককে কেন অনুমতি দেন নি, এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ভারত ও পাকিস্তানকে একই স্তরে ফেলা যায় না। তিনি জানান, পাকিস্তান গণহত্যা সংঘটিত করেছে এবং এর ফলে ১০ লক্ষ লােক ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে।
তিনি বলেন, সাম্প্রতিককালে দুবার পাকিস্তান ভারতীয় সীমান্তে ধাবিত হয়েছে। কিন্তু ভারত কোনদিন অনুপ্রবেশের অপরাধে অভিযুক্ত হয়নি।
সূত্র: কালান্তর, ২৯.১০.১৯৭১