You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.07 | আবার সােভিয়েতের ভেটোয় বাঙলাদেশ বিরােধী চক্রান্ত ব্যর্থ- নিরাপত্তা পরিষদে চীনের ভারত ও সােভিয়েত বিরােধী কুৎসা | কালান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

আবার সােভিয়েতের ভেটোয় বাঙলাদেশ বিরােধী চক্রান্ত ব্যর্থ
নিরাপত্তা পরিষদে চীনের ভারত ও সােভিয়েত বিরােধী কুৎসা

জাতিসংঘ, ৬ ডিসেম্বর-২৪ ঘণ্টার মধ্যে দুবার সােভিয়েত ইউনিয়ন নিরাপত্তা পরিষদে তার ক্ষমতা প্রয়ােগ করে আরও একটি বাঙলাদেশ বিরােধী চক্রান্ত ব্যর্থ করে দেয়।
এ, পি জানিয়েছে মার্কিন প্রস্তাবের মতাে এই প্রস্তাবে ভারত ও পাকিস্তানকে যুদ্ধ বন্ধ করার ও সৈন্য সরিয়ে আনার দাবি করা হয়েছিল।
ইতিপূর্বে নিরাপত্তা পরিষদ বাঙলাদেশ রাজনৈতিক সমাধানের দাবি করে সােভিয়েত ইউনিয়নের প্রস্তাবটি নাকচ করে দিয়েছিল। চীন ঐ প্রস্তাবের বিপক্ষে ভােট দেয় এবং অন্য ১২ টি দেশ ভােটদানে বিরত থাকে। প্রস্তাবটি প্রয়ােজনীয় ৯ ভােট লাভ না করায় বাতিল হয়ে যায়।
আটটি রাষ্ট্রের প্রস্তাবে সােভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে পােল্যান্ডও বিরুদ্ধে ভােট দেয়। চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পদাঙ্ক অনুসরণ করে প্রস্তাবটি সমর্থন করে। অপর দুই শক্তি ফ্রান্স এবং বৃটেন এবারও ভােটদানে বিরত থাকে।
চীন ভারতের নিন্দা করে যে প্রস্তাব উত্থাপন করে তা শেষ পর্যন্ত ভােটে দেওয়া হয় না।
তার আগে নিরাপত্তা পরিষদে বাঙলাদেশে রাজনৈতিক সমাধানের জন্য আহ্বান জানিয়ে যে প্রস্তাব পেশ করে এবং ঐ সঙ্গেই বাঙলাদেশের একজন প্রতিনিধিকে পরিষদের বৈঠকে ডাকতে দাবি জানায়। চীনা প্রতিনিধি তার বিরুদ্ধে ভােট দিলে সােভিয়েত রাষ্ট্রদূত মালিক বলেন, চীনা প্রতিনিধি সাম্রাজ্যবাদের একটি ভাড়ের ভূমিকা ভালই পালন করেছেন।
প্রসঙ্গত চীনের সিংকিয়াং প্রদেশে ১৯৬৩ সালে যে বিদ্রোহ আরম্ভ হয়েছিল তাকে “সােভিয়েত প্ররােচিত প্রতিবিপ্লব” বলে আখ্যা দিয়ে হুয়া জানতে চান যে, জাতিসংঘ সিংকিয়াং থেকে যে কয়েক লক্ষ অধিবাসী সসাভিয়েত ইউনিয়নে চলে গিয়েছে তাদের প্রতিনিধিকেও কি ডাকবেন?
তিনি বলেন, আমাদের সামনে যে-প্রস্তাবটি রয়েছে তা একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনকে স্বীকৃতি দেবার উদ্দেশ্যে পাকিস্তানকে খণ্ডিত করার উদ্দেশ্যে আনা হয়েছে। তার মতে “প্রকৃত প্রশ্ন হল তথাকথিত বাঙলা দেশের প্রতিনিধি হচ্ছেন এমন একটি ব্যক্তি যার দেশকে পৃথিবীর কোন রাষ্ট্রই স্বীকার করে না-যিনি “ভারতেরই এক সৃষ্ট জীব।”
মার্কিন প্রতিনিধি বলেন, সভাপতির চীনা প্রতিনিধিকে বকর বকর করতে না দেওয়া উচিত ছিল, কারণ তিনি প্রস্তাবটি সম্পর্কে কিছু না বলে সােভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে জঘন্য কুৎসা প্রচার করেছেন মাত্র। সবচেয়ে লজ্জার কথা চীনা প্রতিনিধি পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত শ্রমিক কৃষকের সর্বপ্রথম রাষ্ট্রটির বিরুদ্ধেই কুৎসা রটনাই শুধু করেন নি, মুক্তিসগ্রামরত বাংলাদেশের জনগণের প্রতিও কটুক্তি করেছেন। বাংলাদেশের জনগণ এবং বাঙলাদেশ থেকে যে প্রায় এক কোটি শরণার্থী ভারতে এসেছে তাদের প্রতিনিধিকে জিজ্ঞাসা না করে নিরাপত্তা পরিষদ বাংলাদেশে কি ঘটেছিল বা ঘটছে ভাল তথ্য কিভাবে কোথা থেকে জানতে পারবে?
পরে নিরাপত্তা পরিষদের সামনে সােভিয়েত ইউনিয়ন যে প্রস্তাব পেশ করেছিল তার উপর ভােটাভুটির সময় চীন ছাড়া অন্য কোন দেশ তার বিরুদ্ধে ভােট দেয় নি। ঐ প্রস্তাবে বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি রাজনৈতিক সমাধান করার জন্য আহ্বান জানানাে হয়েছিল। সােভিয়েত রাষ্ট্রদূত মালিক তখন চীনা প্রতিনিধির ব্যাপারে সাম্রাজ্যবাদের একটি ভাঁড়ের যুক্তি বলে অভিহিত করেন।
সােভিয়েত প্রস্তাবের পক্ষে পােল্যান্ড ভােট দিয়েছিল, পক্ষান্তরে চীন ছাড়া অন্য সমস্ত দেশের প্রতিনিধিই ভােট দানে বিরত থাকেন।
চীনা প্রতিনিধিকে সাম্রাজ্যবাদের ভাড় বলে অভিহিত করতে গিয়ে মালিক আরও বলেন যেসব শক্তি সােভিয়েত-চীন সম্পর্কে খতম করতে বদ্ধপরিকর চীনা প্রতিনিধির বক্তব্য তাদের হাতে চমৎকার একটি সনদ তুলে দিয়েছেন, আর সেসব শক্তি কোন শ্রেণীর তা সবাই জানে।
সােভিয়েত রাষ্ট্রদূত আরও বলেন, পূর্ববঙ্গের ভবিষ্যত কি হওয়া উচিত বা অনুচিত তা স্থির করার অধিকার কেবল তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদেরই আছে। তারা পাকিস্তানের অংশ থাকবেন না পৃথক রাষ্ট্র গঠন করবেন সে সিদ্ধান্ত কেবল তারাই করতে পারেন। কেউই তাদের এই অধিকার অস্বীকার করতে পারে না।
কিন্তু পশ্চিমা ও অন্যান্য মহলগুলির প্রস্তাবগুলিতে বাস্তবের এ দিকটি যেমন উপেক্ষিত-চীনা প্রস্তাবও তেমন ভাবেই সাড়ে সাত কোটি মানুষের ইচ্ছাকে করেছে অবহেলা।

আগ্রাসী ভারত
চীনা প্রতিনিধি কেবল সােভিয়েত প্রস্তাবের বিরােধিতা করেই ক্ষান্ত হন নি। ইতালি প্রভৃতি কয়েকটি দেশ এক প্রস্তাবে যুদ্ধ বন্ধের দাবি জানিয়েছিল—সৈন্য সরাবার দাবি করেনি। চীনা প্রতিনিধি সেই প্রস্তাবেরও বিরােধিতা করে বলেন, এটার সঙ্গে তিনি একমত হতে নারাজ। ভারতের আগ্রাসন অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে, ভারতীয় সৈন্যদের অবিলম্বে বিনা শর্তে সম্পূর্ণরূপে সরিয়ে আনতে হবে।
সােভিয়েত রাষ্ট্রদূত চীনা প্রস্তাবের বিরােধিতা করে বলেন, অন্যান্য মহলগুলি এ ব্যাপারে পাকিস্তান ভারতকে সমান দোষী করার প্রবণতা দেখাচ্ছে, কিন্তু চীনা প্রতিনিধি কেবল ভারতকে দোষী করতে ব্যর্থ। যদি দোষ কাউকে দিতেই হয় তাহলে পাকিস্তান শাসকদেরই দোষী সাব্যস্ত করতে হয়।
ত প্রতিনিধিদল তাই কেবল সােভিয়েত ইউনিয়নের প্রস্তাবকেই সমর্থন করবে। অন্য কোন প্রস্তাবই গ্রহণযােগ্য নয়। কাজেই সেগুলির বিরােধিতা করা হবে।
চীনা প্রতিনিধির মতই পাক-রাষ্ট্রদূত আগাশাহী ও রাষ্ট্রদূত মালেকের বক্তব্যকে “পাকিস্তানের আভ্যন্তরিন ব্যাপারে হস্তক্ষেপ” বলে অভিহিত করে বলেন, তারাও নাকি “একটা রাজনৈতিক সমাধানের সূত্র বের করেছেন, কিন্তু সেটা ভারতের মনঃপুত নয়।
সােভিয়েত-ভারত চুক্তি স্বাক্ষরিত হবার পর পাকিস্তান জানতে চেয়েছিল তার সামরিক লক্ষ্য আছে কিনা এই মন্তব্য করে তিনি বলেন, “এখন আমরা জবাব পেয়ে গিয়েছি।” সােভিয়েত ভেটো নাকি সেই জবাব স্পষ্ট করে দিয়েছে। তার আগে চীনা প্রতিনিধি চীন সােভিয়েত পারস্পরিক সহযােগিতার চুক্তির কথা উল্লেখ করে বলেছিলেন, এটা কার্যত “একটা সামরিক চুক্তি।”
প্রসঙ্গত মনে করিয়ে দেওয়া যেতে পারে চীন কিন্তু এখনও পর্যন্ত চীন সােভিয়েত চুক্তি নাকচ করে নি। আগাশাহীর অভিযােগ এবং চীনা বক্তব্য যেন একই তারে বাঁধা ছিল বলেই শােনায়।
সমর সেন
এক যুক্তিনিষ্ঠ অথচ দৃঢ় ভাষণে ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি সমর সেন চীনা প্রতিনিধি ও পাক প্রতিনিধি প্রত্যেকটি বক্তব্যকে খণ্ডন করে বলেন, “পাকিস্তানকে খণ্ড-বিখণ্ড করার” ভারতীয় প্ল্যান সংক্রান্ত সমস্ত বক্তব্যকে বস্তাপচা বাজে কথা বলেই উড়িয়ে দেওয়া উচিত।
চীনা প্রতিনিধি ছয় মাস আগে পিকিং এ লেখা বিবৃতির তিলিপি ছাড়া অন্য কিছুই নয়। তিনি বলেন, এখানে বাংলাদেশ প্রতিনিধিকে ডাকলেই যদি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া বােঝায় তাহলে জাতিসংঘ সদস্য নয় এমন বহু দেশকে অতীতে এখানে ডেকে আনার নজিরগুলিকে কি বলা যায়?
মার্কিন প্রতিনিধির যুক্তি হচ্ছে, কোন মানুষের হাত কেটে গেলে তাকে ব্যান্ডেজ বাঁধার ব্যবস্থা দিতে হয়-ব্যায়াম করতে বলা হয় না।
ভারত-পাকিস্তান পরিস্থিতিকে তার সমতুল্য বলে অভিহিত করে জর্জ বুশ বলেন, কাজেই যুদ্ধ বন্ধ ও সৈন্য প্রত্যাহারের ব্যবস্থা করতে হবে। এই সংস্থাকে যুদ্ধ বন্ধ করতেই হবে কারণ “পূর্ববঙ্গে পুরুমে আক্রমণাভিযান আরম্ভ হযেছে…আর যেখানে যেখানে পাকিস্তানী সৈন্য ভারতে প্রবেশ করেছে তাদেরও ফিরে যেতে হবে।
আর্জেন্টিনার প্রতিনিধি তখন মার্কিন প্রস্তাবেরই অনুরূপ তথাকথিত আটটি দেশের প্রস্তাবটি পেশ করেন।
তখন ভােটাভুটি বলে সােভিয়েত ও পােলিশ প্রতিনিধি তার বিরােধিতা করেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীন সমেত ১১টি দেশ তাকে সমর্থন করে। বৃটেন ও ফ্রান্স ভােটদানে বিরত থাকে।
সােভিয়েত ইউনিটকে অভিনন্দন
জাতিসংঘে নিরাপত্তা পরিষদে চীন মার্কিন অক্ষশক্তি যে স্বাধীনতা বিরােধী জনবিরােধী নীতি গ্রহণ করেছে তার তীব্র নিন্দা করে এবং সােভিয়েত ইউনিয়নের জনস্বার্থ রক্ষাকারী ভূমিকাকে অভিনন্দন জানিয়ে বাঙলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রী খন্দকার মােস্তাক আমেদ আজ এক বিবৃতি দিয়েছেন। ভারতস্থ বাঙলাদেশ হাই কমিশন প্রচারিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এই সংবাদ জানানাে হয়। বিবৃতিতে বলা হয়েছে যে, গণতন্ত্রও স্বাধীনতাকে ধ্বংস করার জন্য গণহত্যাকারীর অংশীদার তথাকথিত মুক্তিকামী জগতের প্রতিভূ ওয়াশিংটনের নেতৃবৃন্দের ঘৃণ্য ও ন্যাক্কারজনক ভূমিকা পৃথিবীর ইতিহাসে অক্ষয় হয়ে থাকবে। অপরদিকে ইসলামাবাদের জঙ্গীশাহী কর্তৃক জনতার সংগ্রামকে নৃশংসভাবে হত্যা করার পরিকল্পনাকে সবচেয়ে বেশী সমর্থন করেছে মার্কসবাদ লেনিনবাদের অন্যতম ধারক ও জনগণতন্ত্রের বাহক পিকিং এর নেতৃবৃন্দ।
এই দুইটি বৃহৎ শক্তির এইরকম অশুভ অতীত অতীব নিন্দনীয়। পৃথিবীর কোন দেশেই মুক্তির বৃহৎ শক্তিবর্গের ভূমিকা নিয়ে মাথা ঘামায়নি তা আজ সকলের উপলব্ধি করতে হবে।

সূত্র: কালান্তর, ৭.১২.১৯৭১