বারংবার পাকিস্তানী গােলায় সীমান্ত পরিস্থিতির গুরুতর অবনতি
(বিশেষ প্রতিনিধি)
নয়াদিল্লী, ১১ নভেম্বর-ভারতের পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলে পাক-সামরিক জুন্টার সৈন্যদল ক্রমাগত গােলাবর্ষণ, অস্ত্রবিরতি সীমা লঙ্ঘন করে পরিস্থিতি ঘােরালাে ও উদ্বেগজনক করে তুলছে। আজ এখানে জনৈক সরকারী মুখপাত্র ৭, ৮, ৯০ ও ১০ নভেম্বরের ঘটনাগুলি একের পর এক উল্লেখ করে অবস্থার গুরুত্ব বর্ণনা করেন। ত্রিপুরার বেলানিয়া অঞ্চলে পাক সেনাদের গােলাবর্ষণের জবাবে সীমান্ত রক্ষীরা যােগ্য জবাব দিয়েছে। এদিকে বাঙলাদেশের অভ্যন্তরে মুক্তিবাহিনীর কমান্ডো অভিযানে ভীত পাক জুন্টা চারটি বিমানকে মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের উপর মেশিনগানের গুলি বর্ষণের জন্য নিয়ােগ করেছে।
জনৈক সরকারী মুখপাত্র বেলােনিয়া অঞ্চলের ঘটনায় পাক রেডিওর অপপ্রচারের উল্লেখ করে বলেন, মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের ধার যতই বাড়ছে ওরা ততই ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর অনুপ্রবেশের গল্প ছড়াচ্ছে এবং ভারতীয় এলাকায় বে-সামরিক অধিবাসীদের ওপর কামান দাগাচ্ছে।
এই প্রসঙ্গে তিনি অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে ঘােষণা করেন যে, কোন ভারতীয় সৈন্য ভারতীয় এলাকার বেলােনিয়া থেকে পাকিস্তানী বেলােনিয়ায় প্রবেশ করেনি।
ইউ, এন, আই, পরিবেশিত সংবাদে বলা হয়েছে ঐ মুখপাত্র বলেছেন ভারতীয় সৈন্যরা মুক্তিবাহিনীর ছদ্মবেশে পাকিস্তানী বেলােনিয়া অঞ্চলে অভিযান করছে এই প্রচার তাহা অপপ্রচার। মুখপাত্রটি জানিয়েছেন পাক-রেডিওতে রােমহর্ষকভাবে ঐ অঞ্চলের যে সংবাদ পরিবেশন করা হচ্ছে আসলে তা ঘটছে মুক্তিবাহিনী ও পাক সৈন্যদলের মধ্যে ভারতীয় সৈন্যরা এর ধারে কাছেও নেই। তিনি জানান যেহেতু পাক কর্তৃপক্ষ বিশ্ব-জনমতকে বিভ্রান্ত করার জন্য ঐ প্রচার করছে সেজন্য তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় এর প্রতিবাদ করছেন।
এদিকে আরও একজন সরকারী মুখপাত্র ইউ এন আইকে বলেন, পূর্ব ও পশ্চিম দুই অংশেই পাকবাহিনী বারে বারে গােলাবর্ষণ করার পরিস্থিতি ক্রমেই ঘােরালাে হচ্ছে।
এ মুখপাত্রটি জানান ভারতীয় সৈন্যরা সীমান্ত অতিক্রম না করেই পাক-সৈন্যের হামলার ফলদায়ী প্রত্যুত্তর দিচ্ছে।
পশ্চিম সীমান্তে অস্ত্রবিরতি অঞ্চলে পাক-বাহিনী যে সীমান্ত লঙ্ন করেছে সে বিষয়ে ভারতের পক্ষ থেকে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষকদের কাছে প্রতিবাদ পাঠানাে হয়েছে।
নভেম্বরের ৭ ও ৮ তারিখে ত্রিপুরার বেলােনিয়ার দক্ষিণাংশে পাক সৈন্যদের গােলাবর্ষণে ভারতের পক্ষে তিনজন নিহত ও দুজন আহত হয়। এই হামলায় পাকসৈন্যরা কামান এবং মাঝারি ধরনের মেসিনগান ব্যবহার করে। পাকিস্তানের হতাহতের সংখ্যা জানা যায় নি তবে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর পাল্টা গােলায় ওপক্ষের কয়েকটি বিবর ঘাটি নষ্ট হয়ে যায়।
মুখপাত্রটি অভিযােগ করেন, ৯ নভেম্বর ভারতীয় এলাকায় যােগাযােগ ব্যবস্থা বানচালের জন্য পাক গুপ্তচর চক্ররা কয়েকবার চেষ্টা করেন। শিলচরের পশ্চিমে ঐ দিন একটি মালগাড়ি বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
এক প্রশ্নের জবাবে মুখপাত্রটি বলেন অন্তর্ঘাতমূলক প্রত্যেকটি তৎপরতার অনুসন্ধান করা হচ্ছে :
যেমন বােম্বাই-এ বােমা রাখা, তুঘলকাবাদে রেলপথে একটি পেনসিল ডিটানেটর রাখা, শ্রীনগরে ডাকঘর পােড়ানাে প্রভৃতি সব ঘটনারই তদন্ত হচ্ছে। তিনি জানান তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত ঐ কাজে পাকিস্তানী চরদের হাত আছে কি না তা তিনি বলতে পারবেন না।
১০ নভেম্বর উরি দুমেল রাস্তার ওপর অবস্থিত পশ্চিম কম্যাণ্ড চেক পােস্টের ওপর পাক-সেনারা কামান দাগে। এছাড়া ঐ দিন অস্ত্র বিরতি সীমানার এপারে ২০০ মিটার দূরবর্তী ছােট কাজিরাঙ্গ অঞ্চলে একটি পাক-টহলদারি দল অনধিকার প্রবেশ করে। ঐ রাতেই জম্মুর নৌশেরাতে আর একটি পাক-টহলদারি দল ঢুকে পড়ে। এই তিনটি ঘটনাই জাতিসংঘ পর্যবেক্ষককে জানানাে হয়েছে।
মুখপাত্রটি অভিযােগ করেন, কারগিল, পুঞ্চ, তিথওয়ান, উরি, মেন্দার এবং নৌশেরা অঞ্চলে ৯ নভেম্বর সাতবার অস্ত্রবিরতি চুক্তি লঙ্ঘন করে। ৮ নভেম্বর পাক সৈন্যদের কারগিল অঞ্চলে অগভীর পরিখা খুঁড়তে দেখা গেছিল। এ অঞ্চলে অস্ত্রবিরতি সীমা তিনবার পাক-সৈন্যরা লঙ্ঘন করে।
পূর্বাঞ্চলে ত্রিপুরা ও পশ্চিম বাঙলার পাক-কামানগুলি প্রায়ই গােলা ছুঁড়ছে।
৭ নভেম্বর কোচবিহারের পশ্চিম-দক্ষিণ পশ্চিমে গােলা ছুঁড়ে। এখানে সীমান্ত রক্ষীরা পাল্টা জবাব দেয়। ঐ একই দিনে শিলিগুড়িতে মেশিনগান ও মর্টার থেকে গােলা ছোড়া হয়। এর আগের দিনও কোচবিহারে গােলা বর্ষণ করা হয়।
৭ নভেম্বর পশ্চিম বাংলার কৃষ্ণনগরের উত্তর পূর্বে দুটি ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী কামান উদ্ধার করা হয়। গত দু’দিনে আগরতলা থেকে ৬টি ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী কামান উদ্ধার করা হয়।
সূত্র: কালান্তর, ১২.১১.১৯৭১