অন্যেরা-বিপন্নের জন্য
তিব্বত পুরানো পাপ। পূর্ব বাংলা আমাদের দ্বিতীয় বার পাতকী যেন না করে
নিখিল সরকার
ওরা এসেছিলেন পাহাড় ডিঙিয়ে, ক্ষেত খামার পেরিয়ে, নদী নালা গলিপথ বেয়ে; ওরা এসেছিলেন জীবন দান করতে …। সঠিক ছত্রগুলো মনে পড়ছে না, কিন্তু ডব্লিউ এইচ অডেনের সেই কবিতাটি সে ঘটনাকে উপলক্ষ করে লেখা তার কথা অবশ্যই মনে আছে। ইতিহাসে সে-ঘটনার শিরোনাম -স্পেনের গৃহযুদ্ধ। কবি অডেন সেই যুদ্ধে স্বেচ্ছাসেবক, রিপাবলিকানদের অ্যামবুল্যান্স বাহিনীর সদস্য। অনেক কবি, অনেক লেখকের ভিড় এই শিবিরে। মালরো, স্টীফেন স্পেনডার, আরনেস্ট হেমিংওয়ে আরও কত কে! নানা দেশ ঠিকানা তাদের। বাহিনীর নাম ইনটারন্যাশনাল ব্রিগেড। প্যারিসের এক হোটেলে বসে স্বেচ্ছা সৈনিকদের নামে লিখছেন যুগোশ্লাভিয়ার টিটো, ফরাসী লেখক ম্যালরো চেষ্টা করছেন বিমান বাহিনী গড়ে তুলতে, – ব্রিটিশ শ্রমিক নেতা এটলি একজন মেজর, ভারতের জহরলাল নেহেরু আবেগে কম্পমান একজন দর্শক। সাধারণতন্ত্রী স্পেনের জন্য স্বদেশে এক সাহায্য তহবিল গড়ে তুলেছেন তিনি। সে কি উন্মাদনা, সে কি। শিহরণ!
কোথায় লুপ্ত হয়ে গেল স্বাধীনতার জন্য, ন্যায়ের জন্য দেশে দেশে মানুষের এই আকুলতা? স্পেনের গৃহযুদ্ধ রোমের দাস-বিদ্রোহের মত প্রাচীন ঘটনা নয়। বলতে গেলে সেদিনের ব্যাপার। তিন বছর তুমুল লড়াই শেষে শান্তি, নামে মাত্র’৩৯ সনে। অবশ্য কবরের শান্তি, তবু সেদিন ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে সভ্য দুনিয়া যেভাবে সর্বস্ব পণ করে রণাঙ্গনে অবতীর্ণ হয়েছিল তা চিরকালের মানুষের গর্ব। পূর্ব বাংলার বিদ্রোহ উপলক্ষে কোথায় আজ সেদিনের লড়িয়েদের উত্তর পুরুষেরা? সময় হয়তো এখনোও পেরিয়ে যায়নি। কিন্তু “জিরো আওয়ার” নিঃসন্দেহে সমাগত। এবং শুনতে হৃদয়বিদারক হলেও সত্য এই, – লক্ষণ শুভ নয়। পূর্ব বাংলার মুক্তিযোদ্ধাদের হয়ত শেষ পর্যন্ত একাই লড়ে যেতে হবে। কেননা, কোনও আভাস এখনও মিলছেনা। সভা সমিতি, বিক্ষোভ বক্তৃতা, কিছু গদ্য পদ্য বড়জোর দিনেকের জন্য ধর্মঘট,- আমাদের ভ্রাতৃত্ববোধ আপাতত ওই এক। অর্থাৎ – বাষ্পীয়।
দূরের প্রতিবেশীদের মনোভাব আরও লজ্জাকর। হয়তো এর পিছনে একটা কারণ এই যে, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর বিশ্বের রাজনৈতিক চেহারা অন্যরকম হয়ে গেছে। স্প্যানিস গৃহযুদ্ধে অন্যতম ভুমিকা ছিল কমিনটার্ন-এর। সে সংঘ এখন লুপ্ত। চলতি কনভেনসন অন্যের ঘরোয়া ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না-করা। ব্যতিক্রম অবশ্য আছে। এদের প্রকৃতি আলাদা। কোরিয়ায় হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে রাষ্ট্রপুঞ্জের নাম, ভিয়েতনামে “গণতন্ত্র” রক্ষার জন্য। সংক্ষেপে, এই দুই আগুনে বাইরে থেকে হাত দেওয়া হয়েছিল আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক লক্ষ্য পূরণের জন্য। যখন সে জাতীয় কোনও সমূহ লক্ষ্য নেই, কিংবা ঝুঁকি যখন অত্যাধিক তখন অন্যরা স্রেফ দর্শকের ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে তার নজীর- হাঙ্গেরী; চেকোস্লোভাকিয়া এবং সেদিনের বিয়াফ্রা। হাঙ্গেরীতে ওরা নাকি আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। আশা ছিল- সেখান থেকে কিছু ঝরে পড়বে। সে আশা পূর্ণ হয়নি। না চেকোস্লোভাকিয়ায়ও না। বয়ফ্রাও খাদ্য পথ্যের বেশি খুব কিছু পায়নি। বিশেষত দূরের মানুষের কাছ থেকে।
পূর্ব বাংলায় যা হচ্ছে তার সঙ্গে এইসব ঘটনার কোন মিল নেই। এযুদ্ধ গৃহযুদ্ধ নয়, মুক্তিযুদ্ধ। নবীন সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে নবীন জাতীয়তার মরণপণ লড়াই। বরং এই লড়াইয়ের সঙ্গে মিল খুঁজে পাওয়া যায়, আলজিরিয়ার এফ-এল-এনের দুঃসাহসী লড়াইয়ের সঙ্গে। পূর্ব বাংলা আরও ঐক্যবদ্ধ, আরও সংহত এবং অস্ত্রে দীক্ষা তার সবে মাত্র- এই যা। | এই মহান যুদ্ধে কোন বৃহৎ শক্তি পূর্ব বাংলার মানুষের পাশে দাঁড়াবেন- এটা আশা করতে অবশ্যই ভাল লাগে, কিন্তু মনে হয় সেটা দুরাশা। এ সময় অতি প্রাকৃত কোনও কিছুতেই বিশ্বাস না করাই ভাল। আমরা সকলেই জানি ইয়াহিয়া খাঁ যে আইন শৃঙ্খলার প্রশ্ন তুলেছেন, সেটা তোলার কোনও আইনগত অধিকার তার নেই।- কে তিনি? একজন সফল ষড়যন্ত্রকারী ছাড়া আর কিছু নিশ্চয়ই নন। তার তুলনায় মুজিবর রহমানের নৈতিক এবং আইনগত অধিকার অবশ্যই বেশি। বিশেষত, সাম্প্রতিক নির্বাচনের পরে। সঙ্গে সঙ্গে এটাও
মনে রাখতে হবে গণতান্ত্রিক সমাজতান্ত্রিক শক্তি নির্বিশেষে সকলের কছে আয়ুব- ইয়াহিয়া দীর্ঘদিন জলচল। কারণ, এরা তাদের বৃহত্তর স্বার্থের সমর্থক। ইয়াহিয়া ‘সেনটো’, ‘সিয়াটোর’ সদস্য, সুতরাং আমেরিকার মুখ বন্ধ। ব্রিটেন- ‘দুঃখিত’। দুঃখের হেতু আছে বই কি? পাকিস্তান যে তাঁদেরই হাতে গড়া। বিপ্লবী চীনও এখন পর্যন্ত মৌন। কারণ খান সাহেবেরা তাঁদের দোস্ত। শ্যাম রাখি না কূল রাখি- চীন এই দোটানায় পড়েছে বলে মনে হয়না। আপাতত সেও বেড়ার ওপর বসে।
বাকী রইল ভারত। এস এম যোশী অভিযোগ করেছেন- ইন্দিরা তাঁর পিতার মত হতে পারছেন না-কেন? জহরলাল নেহরু স্পেনে ছুটে গিয়েছিলেন, চীনে মেডিক্যাল মিশন পাঠিয়েছিলেন, ইন্দোনেশিয়ার সমর্থনে এশীয় সম্মেলন ডেকেছিলেন। ইন্দিরা গান্ধী কি কিছুই করতে পারবেন না? জানি না। শুধু এটুকু জানি, সমর্থন জানাবার সব পথ গুলো বন্ধ নয়। বিশেষত, ভারতের ঘোষিত নীতি যেখানে উপনিবেশকতার বিলোপ। আমাদের আফ্রো-এশিয়া, আমাদের আন্তর্জাতিক রাজনীতি- সবই যখন ওই লক্ষ্যে, তখন ভারতের কোনও অধিকার নেই বাংলার মুক্তিযুদ্ধে হাত পা গুটিয়ে বসে থাকার। আফরিকার মুক্তি যোদ্ধাদের অন্যভাবে সাহায্যের প্রতিশ্রুতিও কিন্তু ভারতের মুখে শোনা গেছে। |
হোকনা নৈতিক সাহায্য- তারও মূল্য আছে বই কি! স্মরণীয়- সুয়োজ প্রসঙ্গ। মাথা হেঁট করে ঘরে ফিরতে হয়েছিল ইংরাজ ফরাসিকে। ব্রিটিশ সিংহ শেষ পর্যন্ত ভেজা বেড়ালে পরিণত। তবে ইয়াহিয়া খাই বা বিজয়ীর বেশে ঘরে ফিরবেন কেন? তাকে বাধা দিতে হবে। দিল্লিতে তো বটেইঃ এশিয়ায়, আফরিকায়, জাতিপুঞ্জে- সর্বত্র। আমাদের এক পাপ- তিব্বত; পূর্ব বাংলা যেন দ্বিতীয়বারের মত এই জাতিকে পাতকী না করে।
২৮ মার্চ, ১৯৭১
আনন্দবাজার
Compiled by – দেওয়ান মাবুদ আহমেদ