You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.16 | মুক্তিসংগ্রাম দমনের হাতিয়ার মার্কিন নৌ বহর -সুকুমার মিত্র | কালান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিসংগ্রাম দমনের হাতিয়ার মার্কিন নৌ বহর
-সুকুমার মিত্র

মার্কিন ৭ম নৌবহর বাঙলাদেশের দিকে এগিয়ে আসছে এই খবরে খুব চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। এই নৌবহরের পরমাণু শক্তিচালিত বিমানবাহী জাহাজ ‘এন্টারপ্রাইজ’ সিঙ্গাপুরের কাছে এসে পৌছিয়েছে। এটি পৃথিবীর বৃহত্তম বিমানবাহী জাহাজ। কয়েকজন মার্কিন নাগরিককে তুলে নেওয়াই নাকি এর কাজ হবে। মশা মারতে কামান দাগার মতই ব্যাপারটা বিস্ময়কর। কিন্তু বিস্ময়ের কিছু নেই, এটা একটা অজুহাত মাত্র। আসলে একটা গােলযােগ পাকানােই উদ্দেশ্য। কারণ, দঃ পূঃ এশিয়া ও দূর প্রাচ্যে আগ্রাসী উদ্দেশ্যেই এই বহরটি ঘােরাফেরা করে থাকে। সরকারীভাবে প্রশান্ত মহাসাগরের পশ্চিমাঞ্চলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা রক্ষা করার জন্য ৭ম নৌবহর নিয়ােজিত।
মার্কিন ৭ম নৌবহর ভারত মহাসাগরের পূর্বাঞ্চল পর্যন্ত পরিক্রমা করে। ভারত মহাসাগরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বিপন্ন করার মত কোন শক্তি আছে বলে জানা নেই, কিন্তু সারা দুনিয়ায় শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষার গুরু দায়িত্ব যারা নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছেন এবং একমাত্র সেই কারণেই যারা ভিয়েতনাম, লাওস ও কাম্বােডিয়ার লক্ষ লক্ষ মানুষের উপর আধুনিক মারণাস্ত্র প্রয়ােগ করেছেন তাঁদের পক্ষে এটা একান্তই স্বাভাবিক।
৭ম নৌ-বহরে পরিক্রমার পথ লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে কয়টি লক্ষ্য ভারত সেগুলির অন্যতম। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ ও পূর্ববঙ্গ তাক করেই ৭ম নৌ-বহরের আনাগােনা চলছে অনেকদিন থেকে। সিংহলকে বেড় দিয়ে ৭ম নৌ-বাহিনীর ঘােরাফেরা চলে একদিকে সুয়েজ খাল অর্থাৎ আরব দেশগুলির প্রতি এবং অপরদিকে আফ্রিকার প্রতি তাক করে। এছাড়া মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়াও বাদ যায় না।
প্রশান্ত মহাসাগরের পশ্চিমাঞ্চল এখন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের নতুন ভূগােলে চীন সাগর পেরিয়ে ভারত মহাসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। অবশ্য, এখন একটা অজুহাতও দেখানাে হচ্ছে। কমিউনিজমের কবল থেকে দুনিয়াকে রক্ষার পবিত্র দায়িত্ব নিয়েছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা। সােভিয়েত বাণিজ্য জাহাজগুলি এখন ভারত, সিংহল, পাকিস্তান ও এশীয় দেশে যাতায়াত করছে। কথাটা ভাল নয়, কমিউনিজমের বিষতাে এইভাবেই ছড়ায়। তা ছাড়া সােভিয়েত নৌবহরও মাঝে মাঝে ভারত মহাসাগরে পাড়ি দিচ্ছে। এই রকম অবস্থায় মার্কিন সরকার কি করে চুপ করে বসে থাকবেন।
৭ম নৌবহরের একটি কাজ হল তাইওয়ানকে (ফরমােজা) রক্ষা করা। এখন চীনের সংগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হামদরাদ, কাজেই এখানে পাহারা দেওয়া খুব দরকার নেই। মিত্র পাকিস্তানে সামরিক চক্রকে রক্ষা করাই এখন বড় কাজ। এই কারণেই সদ্য-স্বাধীন বাঙলাদেশের উপর ৭ম নৌবহরের শনির দৃষ্টি পড়েছে। আর ইন্দো-চীনের দেশগুলােতে যুদ্ধের আগুন জ্বালিয়ে তাঁবেদারদের শিখণ্ডীরূপে সামনে রেখে যা কিছু করা হচ্ছে তাতে ৭ম নৌবহরের বিশেষ ভূমিকা তাে আছেই। এই বিশেষ ভূমিকা পালনের জন্য ৭ম নৌবহরের যুদ্ধ জাহাজ প্রভৃতির সংখ্যা তাড়িয়ে ১৭৫ করা হয়েছে এবং অফিসার ও নৌ-সেনার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭৫ হাজার। এই নৌবহরের ৭০০ বিমান আছে।
সমগ্র সমাজতান্ত্রিক ও তৃতীয় দুনিয়ার উপর কড়া নজর রাখার এবং প্রয়ােজন মত আগ্রাসী কার্যকলাপে লিপ্ত হওয়ার উদ্দেশ্যে মার্কিন নৌবহরগুলি সুপরিকল্পিত ভাবে বিন্যস্ত হয়েছে। প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের জন্য ৭ম নৌবহর ছাড়াও আছে ১ম নৌবহর। সরকারীভাবে ১ম নৌবহরের উদ্দেশ্য হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম উপকূল রক্ষা করা। ১৯৬৫ সালের হিসাবে দেখা যায় এই নৌবহরের ৯০টি বৃহদাকার রণতরী বিমানবাহী জাহাজ প্রভৃতি, ৪২০ টি বিমান ও ৬০ হাজার অফিসার ও নৌসেনা আছে।
মার্কিন অতলান্তিক নৌ-বাহিনীতে আছে ২য় নৌবহর ও ৬ষ্ঠ নৌবহর। ২য় নৌবহরের প্রধান কাজ লাতিন আমেরিকার দেশগুলির উপর নজর রাখা এবং ৬ষ্ঠ নৌবহরের প্রধান কাজ হল ইয়ােরােপ, আফ্রিকা এবং আরব দেশগুলির উপর নজর রাখা। সরকারিভাবে ২য় নৌবহরের কাজ হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব উপকূল রক্ষা করা এবং ক্যারবিয়ান ও মেকসিকো উপসাগর অঞ্চলে পাহারা দেওয়া। এই নৌবহরে আছে। ৪০টি রণতরী, ৪২০টি বিমান ও প্রায় ২০ হাজার অফিসার ও সৈন্য। (১৯৬৫ সালের হিসাব)।
৬ষ্ঠ নৌবহর ন্যাটের সংগে যুক্ত। ভূমধ্যসাগরে এর ঘাটি। এই নৌবহরে আছে ৫০টি বিভিন্ন শ্রেণীর রণতরী, ২শত বিমান এবং ২৫ হাজার অফিসার ও সৈন্য। (১৯৬৫ সালের হিসাব)
সমগ্র মার্কিন নৌবাহিনীতে বহু পরমাণু অস্ত্র সজ্জিত সাবমেরিন এবং পরমাণু বােমা বহনের উপযােগী বিমান আছে।

সূত্র: কালান্তর, ১৬.১২.১৯৭১