You dont have javascript enabled! Please enable it! 1941.09.08 | ফজলুল হকের চিঠি - সংগ্রামের নোটবুক

ফজলুল হকের চিঠি

ফজলুল হক লিয়াকত আলীর নিকট লিখিত পত্রে যে দৃঢ় মনােভাব ব্যক্ত করেন তার কিছু অংশ এখানে উদ্ধৃত করা হলাে :

But before I conclude I wish to record a most emphatic protest against the manner in which the interests of the Moslems of Bengal and the Punjab are being imperiled by Muslim leaders of the Provinces where the Muslims are in a minority, popularly known among Muslims as the minority provinces of India. Except in Bengal and the Punjab which together account for nearly 50 millions of Moslem minority dwindling to about 4 or 5 percent of the population. It is evident that these Moslem brethren of ours can never hope to be in the enjoyment of even an effective voice in the administration, leave alone the prospect of their ever being in power. It is conceivable that they cannot realize, nor even imagine, the advantages of the Moslem community being in a dominant position in the administration of Bengal and the Punjab. Nor do they realize the responsibilities of the Moslem Premiers of those provinces. Naturally enough they think that just as all their own political prospects are bleak and barren even so is the case with the Moslems of Bengal and the Punjab. Naturally, enough they do not care for the repercussions on the politics of the Moslems of Bengal and the Punjib of the decision they may take with regard to Moslem India as a whole. I would ask the Moslem leaders of the minority provinces to remember that if they meddle to much with the politics of the majority provinces, they will do so at the peril of much with the politics of the majority provinces, they will do so at the peril of the interest of the entire Moslem community of India. For my part, I will never allow the interest of 33 millions of the Moslems of Bengal to be put under the domination of any outside authority however eminent it may be.’
‘At the present moment I have a feeling that Bengal does not count much in the counsels of political leaders outside our province, although we constitute more than rd of the total Moslem population of India. Even in this controversy, the leaders of the minority provinces never cared to take into consideration my particular responsibilities and difficulties and wanted to drown my voice with meaningless slogans which may suit their own conditions of political helplessness, but which are utterly unsuited to the conditions prevailing in my province. I was condemned before I could put before the President my point of view.’
[8th September 1971, vid, Statesmans, 11 September, 1941 Letter of A. K. Fazlul Haq to the Secretary of All-India Muslim League.]
অর্থাৎ ‘নিখিল ভারত মুসলিম লীগের অত্র অধিবেশনের সুবিবেচিত অভিমত এই যে, এ দেশে কোনাে শাসনতান্ত্রিক পরিকল্পনাই কার্যকর কিংবা মুসলমানদের নিকট গ্রহণযােগ্য হইতে পারে না, যদি না অতঃপর বর্ণিত মূলনীতিসমূহের ভিত্তিতে তাহা পরিকল্পিত হয়। যথা, ভৌগােলিক নৈকট্য সমন্বিত, ইউনিটগুলাে প্রয়ােজন অনুসারে স্থানিক রদবদলপূর্বক সীমানা চিহ্নিত করিয়া অঞ্চল গঠন করিতে হইবে এবং মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল যেমন, ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চল সমন্বয়ে অবশ্যই স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ গঠন করিতে হইবে, যেখানে অন্তর্ভুক্ত ইউনিটগুলাে স্বায়ত্তশাসিত ও সার্বভৌম হইবে।
‘অত্র অধিবেশন ওয়ার্কিং কমিটিকে তানুরূপ অঞ্চলগুলাের যাবতীয় ক্ষমতা যেমন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, বৈদেশিক বিষয়, যােগাযােগ, শুল্ক এবং প্রয়ােজনমতাে অন্যান্য বিষয়ের উপর চূড়ান্ত ক্ষমতা প্রদানের উদ্দেশ্যে উল্লিখিত মূলনীতিগুলাের ভিত্তিতে একটি সাংবিধানিক পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য আরও ক্ষমতা দিতেছে। ভারতবাসীর স্বাধীনতা সংগ্রাম সফল হলাে। ভারত বিভক্ত হলাে। পাঞ্জাব, বঙ্গদেশ দ্বিখণ্ডিত হলাে। আসাম বিভক্ত হলাে।
পরবর্তীকালে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে পাকিস্তানের রূপরেখা প্রস্তাবক তথা লাহাের প্রস্তাবের প্রস্তাবক বঙ্গীয় প্রধানমন্ত্রী এ. কে. ফজলুল হককে মুসলিম লীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়।
১৯৪২ সালে ফজলুল হক হিন্দু মহাসভার বাঙালি নেতা ড. শ্যামা প্রসাদ মুখার্জীর সঙ্গে একত্রে শ্যামা-হক মন্ত্রিসভা গঠন করেন বাংলায়। | ঐ বছরই সেপ্টেম্বর মাসে লাহােরে উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে শ্যামা-হক মন্ত্রিসভার পতন হয় এবং ১৯৪৩ সালের ২৪ এপ্রিল খাজা নাজিমুদ্দিনের নেতৃত্বে বঙ্গে মুসলিম লীগ মন্ত্রিসভা গঠিত হয়।
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস পরিক্রমায় ১৯৪৭ সালের ১৪ এবং ১৫ আগস্ট ভারত বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান এবং হিন্দুস্থান স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হলাে।
স্বাধীন পাকিস্তানে ৮ সদস্য বিশিষ্ট প্রথম কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা গঠিত হলাে। মন্ত্রিসভায় স্থান পেলেন :
১. নওয়াবজাদা লিয়াকত আলী খান প্রধানমন্ত্রী ও দেশরক্ষা মন্ত্রণালয়
২. স্যার জাফরল্লাহ খান (আহম্মদীয়া সম্প্রদায়)—পররাষ্ট্রমন্ত্রী
৩. গােলাম মােহাম্মদ—অর্থমন্ত্রী।
৪. সরদার আবদুর রব নিশতার (সীমান্ত প্রদেশ) যােগাযােগ মন্ত্রী
৫. শ্রী যােগেন্দ্র নাথ মণ্ডল (তফসিলী সম্প্রদায়) (পূর্ব পাকিস্তান)
৬. ফজলুর রহমান (পূর্ব পাকিস্তান)—শিক্ষা ও শিল্পমন্ত্রী
৭. পীরজাদা আবদুস সাত্তার (সিন্ধু প্রদেশ) খাদ্যমন্ত্রী ৮. খাজা শাহাবুদ্দিন (পূর্ব পাকিস্তান)—তথ্যমন্ত্রী
১৯৪০ সালের ফজলুল হকের উত্থাপিত লাহাের প্রস্তাব অনুসারে নয়, পাকিস্তানের জন্ম হয় ১৯৪৬ সালের দিল্লি প্রস্তাব মােতাবেক। ১৯৪৭ সালের ২৭ জুন বঙ্গীয় মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটি ঢাকাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ৫ আগস্ট ১৯৪৭ পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারি পার্টি বৈঠকে ৭৫-৩৬ ভােটে হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীকে পরাজিত করে খাজা নাজিমুদ্দিন পার্লামেন্টারি পার্টির নেতা নির্বাচিত হলেন। পূর্ববাংলার প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন বয়স্ক মানুষ ছিলেন। তৎকালীন ছাত্র নেতা অলি আহাদের মতে তিনি ছিলেন স্থবির ও অত্যন্ত পশ্চাদমুখী চিন্তাধারার নেতা। পূর্ববঙ্গের মতাে স্পর্শকাতর এলাকার শাসনভার চালানাের মতাে মানসিক গঠন ছিল না তার। তিনি নিজে উর্দুভাষী পরিবারের সন্তান। পরিবারের ভাষা ছিল উর্দু। বাংলায় তার কোনাে দখল ছিল না। তার পরিবারের পূর্বপুরুষগণ ভাগ্যান্বেষণে কাশ্মীর থেকে। ঢাকায় পূর্ববঙ্গে এসেছিলেন এবং ইংরেজদের অনুগ্রহে এদেশের সামন্ত প্রভুশ্রেণী ভুক্ত হয়েছিলেন। সুতরাং পূর্ববঙ্গের জলবায়ু অর্থাৎ আলাে-হাওয়া মাটির সন্তানদের সাথে নাড়ির কোনাে সম্পর্ক ছিল না তার। সামাজিকভাবে ভাষায়, সংস্কৃতিতে চলাফেরায় তিনি এদেশকে আপন করে নিতে পারেন নাই বা আপন ভাবতে পারেন নাই। অথবা এদেশের মানুষের আপনজন হয়ে উঠতে পারেন নাই।
সুতরাং শাসক শ্রেণীর মতাে শােষণই ছিল তাঁদের মূল পেশা। পূর্ববঙ্গে বসবাস করলেও বঙ্গবাসীর সঙ্গে আত্মিক সম্পর্ক তাঁর গড়ে ওঠেনি। তাই পূর্ব, পাকিস্তান শাসনের সূচনাতেই তাঁর আমলে উচ্চপদস্থ উর্দুভাষী রাজকর্মকর্তা এবং কর্মচারীরা রাজকীয় আচরণ শুরু করেন। বিভাগপূর্ব ভাষা বিতর্ককে উস্কিয়ে দিয়ে প্রথমেই নাজিমউদ্দিন সরকার কেন্দ্রের আজ্ঞাবহ দাস হিসেবে উর্দুভাষার প্রয়ােগ ও বিস্তারের প্রচেষ্টয় লিপ্ত হন। উর্দুকে বাংলা ভাষাভাষী পূর্ববঙ্গের মানুষের উপর চাপিয়ে দেয়ার অভিলাষে রেডিও এর অনুষ্ঠানে ইচ্ছাকৃতভাবে বাংলা শব্দের বদলে উর্দু শব্দ ব্যবহার করতে থাকে। যেমন, রাষ্ট্রপ্রধানের জায়গায় সদরে রিয়াসাত, স্থিরকৃত স্থলে মােকরার, প্রধানমন্ত্রীর স্থলে উজীরে আজম, মুখ্যমন্ত্রীর স্থলে উজীরে আলা, মন্ত্রীর স্থানে উজীর, প্রতিনিধির স্থানে নােমাযেন্দা, সংবাদের স্থলে এলান, ছবিকে তসবির এমনি উর্দুর যথেচ্ছ ব্যবহার শুরু হয়। ধীরে ধীরে পাকিস্তানের মনিঅর্ডার ফরম টেলিগ্রাম ফরম, ডাক টিকিট ও টাকায় উর্দু ব্যবহার শুরু হতে থাকে।।
স্বাধীনতার পরপরই পশ্চিমা শাসকগােষ্ঠীর এহেন আচরণ স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষিত বাঙালির মধ্যে ক্ষোভ ঘনীভূত হতে থাকে। উর্দুভাষীদের দৌরাত্মাকে মােকাবিলা করার জন্যে পাকিস্তান সৃষ্টির মাত্র এক মাসের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক আবুল কাসেম ও রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক নুরুল হক ভূঁইয়া বাঙালির ধূমায়িত ক্ষোভ আর অসন্তোষকে সাংগঠনিক রূপদানের উদ্দেশ্য এবং বাংলাভাষা প্রতিষ্ঠার দাবিকে জোরদার করার প্রচেষ্টায় ১ সেপ্টেম্বর পাকিস্তান তমদুন মজলিশ নামে একটি সংগঠন গড়ে তােলেন।
তমদুন মজলিশ প্রথমে সাংস্কৃতিক সংগঠন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এতে প্রগতিশীল চিন্তাধারার শিক্ষিতজনেরা এসে যােগ দিতে থাকেন। প্রথম দিকে এ মজলিশে যােগ দেন অধ্যাপক এ, কে, এম আহসান, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, শামসুল আলম, আজিজ আহমদ, সানা উল্লাহ নূরী প্রমুখ।
তমদুল মজলিশ একটি বাঙালি চেতনাকে জাগিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে মাঝে মাঝে সভাসমিতি, আলােচনা সভার আয়ােজন করে চলে। এসব সভা সমিতিতে মজলিশের নেতৃবৃন্দ, প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী এবং শিক্ষাবিদগণ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার স্বপক্ষে বক্তব্য রাখতেন। আস্তে আস্তে বাঙালির ভাষার প্রশ্নে বিশিষ্টজনেরা তমদ্দুন মজলিশের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে থাকেন। তাদের মধ্যে ছিলেন ফজলুল হক হলের প্রভােস্ট ড. মাহমুদ হােসেন, অধ্যাপক রেআয়াৎ খা, সরদার ফজলুল করিম। প্রমুখ। এঁদের ভেতর রেআয়ৎ খাঁ ছিলেন অবাঙালি। কিন্তু বাংলাভাষার প্রতি ছিল তার অগাধ দরদ এবং বাংলাদেশে বসবাস করে তিনি বাংলাদেশের বিরাট জনগােষ্ঠীর জন্য তাদের নিজেদের মুখের ভাষার রাষ্ট্রীয়কাজে ব্যবহারের আবশ্যকতা বুঝেছিলেন। তিনি বলতেন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ সারা পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ। সুতরাং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি ন্যায্য এবং স্বাভাবিক। (ঢাকা ডাইজেস্ট, নভেম্বর ১৯৭৮)
ড. মাহমুদ হােসেন এবং রেআয়ৎ খাঁ এ অবাঙালি দু’জন রাষ্ট্রভাষা বাংলার মুখর সমর্থক ছিলেন।
১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টম্বরে ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু এই নামে তমদ্দুন মজলিশ একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে। তমদ্দুন মজলিশের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবুল কাসেমের সম্পাদনায় ও তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় বলিয়াদি প্রেস হতে বইটি প্রকাশিত হয়। অধ্যাপক কাজী মােতাহার হােসেন, ইত্তেফাক পত্রিকার সম্পাদক আবুল মনসুর আহমদ ও অধ্যাপক আবুল কাসেমের লেখা ভাষা সম্পকীয় প্রবন্ধ ছাপা হয়। প্রবন্ধগুলােতে নানা যুক্তি দিয়ে প্রমাণের চেষ্টা করা হয়— বাংলা ভাষা পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হওয়ার উপযুক্ত। … এ সব লেখায় (প্রবন্ধে) বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার স্বপক্ষে যুক্তি ও জোরালাে বক্তব্য পেশ করা হয়। এরপর রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নটি ছাত্রমহলে জনপ্রিয় আলােচনার বিষয়ে পরিণত হয়। … তখনও এ দাবির পেছনে ছাত্ররাই ছিল নিয়ামক শক্তি।’ (মােহাম্মদ তােয়াহার সাক্ষাৎকার, ঢাকা ডাইজেস্ট, মার্চ -১৯৭৮)
প্রকৃতপক্ষে ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনে তমদুন মজলিশ প্রকাশিত ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু’- এই পুস্তিকা পূর্ববাংলায় জনমত গঠনে সুদূরপ্রসারী অবদান রাখে। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি সম্বলিত এটাই ছিল প্রথম পুস্তিকা বা বই।
বইটির মুখবন্ধে বেশ কিছু প্রস্তাব রাখা হয়। সেগুলাে হচ্ছে:
‘স্বাধীনতা লাভের সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হবে এ নিয়ে যথেষ্ট বাক-বিতণ্ডা শুরু হয়েছে। দৈনিক আজাদ’ ও ‘ইত্তেহাদের আলােচনা, বহু। নামজাদা সাহিত্যিক ও রাজনীতিকের মতামত ইত্যাদি যাচাই করে আমরা নিম্নরূপ প্রস্তাব পূর্ব পাকিস্তানের সুধী সমাজের নিকট পেশ করছি।
১। বাংলা ভাষাই হবে
(ক) পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার বাহন।
(খ) পূর্ব পাকিস্তানের আদালতের ভাষা।
(গ) পূর্ব পাকিস্তানের অফিসাদির ভাষা
২। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের রাষ্ট্রভাষা হবে দু’টি- উর্দু ও বাংলা।
রাষ্ট্রভাষা বাংলার স্বপক্ষে জনমত গড়ে তােলার জন্য তমদুন মজলিশ গণস্বাক্ষর অভিযান শুরু করে। এই মেমােরেন্ডামে স্বাক্ষর করেন পূর্ব পাকিস্তানের বিশিষ্ট সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, রাজনৈতিক নেতাসহ শত শত নাগরিক। নামকরা ব্যক্তিদের স্বাক্ষর সংগ্রহের জন্যে মজলিশের নেতাকর্মীরা প্রচুর পরিশ্রম করতে থাকেন এবং তারা সফলও হন। দু’একটি ব্যতিক্রম ছাড়া এ স্বাক্ষরতা অভিযানে ব্যাপক সাড়া পাওয়া যায়। পুলিশের লােক তৎকালীন ডি-আই জি আবুল হাসনাতসহ বেশ কজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাও স্বাক্ষর করেন। বেশ কর্জন মন্ত্রীর গােপন সমর্থন পাওয়া যায় রাষ্ট্রভাষাকে বাংলার প্রতি। এঁদের মধ্যে জনাব হবীবুল্লাহ বাহার ও সৈয়দ মােহাম্মদ আফজলও রয়েছেন। মেমােরেন্ডামটি বা স্মারকলিপি সরকারের শিক্ষামন্ত্রীর কাছে পেশ করা হয় আর তার কপি তৎকালীন কয়েকটি দৈনিক, সাপ্তাহিক এবং মাসিক পত্রিকায় ছাপা হয়। এ ব্যাপারে কলকাতা থেকে প্রকাশিত এবং জনাব আবুল মনসুর আহমদ সম্পাদিত ইত্তেহাদ পত্রিকা মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিল। ১৮ নভেম্বর ১৯৪৭ সালে দৈনিক আজাদ পত্রিকায় স্বাক্ষরকারীগণের নামসহ স্মারকলিপিটি প্রকাশ হয়। স্বাক্ষরকারীগণের মধ্যে বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির সভাপতি মওলানা মােহাম্মদ আকরম খাঁ, মওলানা আবদুল্লাহহেল বাকী, মওলবি আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ, কবি জসিম উদদীন, আজাদ সম্পাদক মওলবি আবুল কালাম শামসুদ্দিন, অধ্যাপিকা মিসেস শামসুন্নাহার মাহমুদ, আনােয়ারা খাতুন, প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁ, শিল্পী জয়নুল আবেদিন, অধ্যাপক মনসুরউদ্দিন, মি. আবুল হাসানাত (ডিআইজি পুলিশ), অধ্যাপক কাজী মােতাহার হােসেন, সলিমুল্লাহ মােছলেম হলের প্রভােস্ট অধ্যাপক ড. মােয়াজ্জেম হােসেন, প্রিন্সিপাল শরফুদ্দীন আহমদ, প্রিন্সিপাল জহুরুল এছলাম, মি: জাকির হােসেন (আই. জি. পুলিশ) ড: ওসমান গণি, (ডি. এস. সি), অধ্যাপক আব্দুল লতিফ বার- এট- ল, মওলানা মােস্তাফিজুর রহমান, অধ্যাপক অতুল সেন, আল্লামা ডা. মহিউদ্দিন, মওলবি আবুল মুনসুর আহমদ, মিসেস লীলা রায় (এম, এ সম্পাদিকাজয়শ্রী), নিখিল বঙ্গ মােছলেম মহিলা সমিতির সেক্রেটারি মিসেস আনােয়ারা খাতুন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. এস, আর, খাস্তগীর, ডি. এস. সি, গায়ক আব্বাসউদ্দীন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক বিনয়েন্দ্র নাথ রায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক গণেশ বসু, আজাদের বার্তা সম্পাদক মওলবি মাে. মােদাব্বের, নিখিল বঙ্গ মােছলেম ছাত্রলীগের সেক্রেটারি শাহ আজিজুর রহমান, সাহিত্যিক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, শওকত ওসমান, আবু রুশদ, আলী আহসান, সৈয়দ মান্নান বশ, আহসান হাবিব, আবু জাফর শামসুদ্দিন, জহুর হােসেন চৌধুরী আরাে অন্যান্য।
স্মারকলিপিতে অন্যান্য বিষয়ের সাথে আরাে উল্লেখ করা হয়, বাংলা ভারতবর্ষের মধ্যে সর্বাপেক্ষা সম্পদশালী ভাষা, এবং বিশ্বের প্রধান প্রধান ভাষাগুলাের মধ্যে একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করিয়াছে। ভারতের প্রায় ৮ কোটি লােক বাংলা ভাষা ব্যবহার করিয়া থাকে এবং হিন্দু ও মুসলমান উভয়েই ইহার বিকাশ ও সমৃদ্ধিতে সাদৃশ্য করিয়া ইহাকে বর্তমান উন্নত স্তরে উন্নীত করিয়াছে।।
… পশ্চিমবঙ্গ এবং পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নমেন্টদ্বয় উভয়েই যদি বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে গ্রহণ করেন, তাহা হলে ইহার ভবিষ্যৎ আরাে উজ্জ্বলতর হইবে পূর্ব পাকিস্তান গভর্নমেন্টকে ঐকান্তিক আগ্রহের সহিত অনুরােধ করা যাইতেছে যে বাংলাভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা এবং শিক্ষার বাহন বলিয়া যেন অতি সত্তর ঘােষণা করা হয়।
৩। (ক) বাংলাই হবে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষা বিভাগের প্রথম ভাষা। ইহা পূর্ব পাকিস্তানের শতকরা একশ জনই শিক্ষা করবেন।
(খ) উর্দু হবে দ্বিতীয় ভাষা বা আন্তঃপ্রাদেশিক ভাষা। যারা পাকিস্তানের অন্যান্য অংশে চাকরি ইত্যাদি কাজে লিপ্ত হবেন তারাই শুধু ও ভাষা শিক্ষা করবেন। ইহা পূর্ব পাকিস্তানের শতকরা ৫ থেকে ১০ জন শিক্ষা করলেও চলবে। মাধ্যমিক স্কুলের উচ্চতর শ্রেণীতে এই ভাষা দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে শিক্ষা দেয়া যাবে।
(গ) ইংরেজি হবে পাকিস্তানের তৃতীয় ভাষা বা আন্তর্জাতিক ভাষা। পাকিস্তানের কর্মচারী হিসেবে পৃথিবীর অন্যান্য দেশে যারা চাকরি করবেন বা যারা উচ্চতর বিজ্ঞান শিক্ষার নিয়ােজিত হবেন তারাই শুধু ইংরেজি শিক্ষা করবেন। তাঁদের সংখ্যা পূর্ব পাকিস্তানে হাজারে ১ জনের চেয়ে কখনাে বেশি হবে না।
ঠিক একই নীতি হিসেবে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রদেশগুলােতে স্থানীয় ভাষা উর্দু প্রথম ভাষা, বাংলা দ্বিতীয় ভাষা, আর ইংরেজি তৃতীয় ভাষার স্থান অধিকার করবে।
৪। শাসনকাজ ও বিজ্ঞান শিক্ষার সুবিধার জন্য আপতত কয়েক বৎসরের জন্য ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই পূর্ব পাকিস্তানের শাসন কাজ চলবে। ইতিমধ্যে প্রয়ােজনানুযায়ী বাংলা ভাষার সংস্কার সাধন করতে হবে।
সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিকে জনপ্রিয় এবং ছাত্র ছাত্রীদের সােচ্চার করার উদ্দেশ্যে তমদ্দুন মজলিশের সাধারণ কর্মসূচির অংশ হিসেবে ১৯৪৭ সালের অক্টোবর মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে এক সাহিত্যসভার আয়ােজন করা হয়। এই সভায় সভাপতিত্ব করেন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের তৎকালীন মন্ত্রী জনাব হবীবুল্লাহ বাহার চৌধুরী। আরাে ক’জন মন্ত্রী উপস্থিত ছিলেন এবং বক্তৃতা করেছেন তবে মন্ত্রীদের ভেতর হবীবুল্লাহ বাহার চৌধুরী ছিলেন রাষ্ট্রভাষা বাংলার তুমুল সমর্থক।
বুদ্ধিজীবী এবং শিক্ষাবিদদের ভেতর আলােচনায় অংশ নেন কবি জসীমউদদীন, কাজী মােতাহার হােসেন, ডা. এনামুল হক, আবুল হাসনাৎ, কবি গােলাম মােস্তফা, অধ্যাপক আবুল কাসেম আরাে অন্যান্য। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিকে আরাে সােচ্চার করার জন্য ফজলুল হক হলের এই সাহিত্যসভার পরপরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. নুরুল হক ভূঁইয়াকে আহবায়ক করে ঢাকায় প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। সে সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটের কাছে রশিদ বিল্ডিং নামে একটি পুরানাে ভবন ছিল। সেই ভবনের সুরত জামাল মেস নামক একটি কক্ষে প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এই ঘরটি অবশ্য তমদুন মজলিশের অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হতাে।
তমদুন মজলিশের এই অফিস কক্ষেই ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর মাসে তমদুন মজলিশের কিছু কর্মী কর্মকর্তা ও নবগঠিত মুসলিম ছাত্রলীগের অল্প ক’জন কর্মী নিয়ে প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এ প্রসঙ্গে তমদুন মজলিশের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবুল কাসেম বলেন, ফজলুল হক হলে তমদ্দুন মজলিশের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত সাহিত্য সভার পর রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
সংগ্রাম পরিষদের অন্যান্য সদস্য ছিলেন অধ্যাপক আবুল কাসেম, জনাব তােয়াহা, জনাব নঈমুদ্দীন আহমদ, জনাব শওকত আলী, জনাব শাহেদ আলী, ফরিদ আহমদ, আখলাকুর রহমান, আবদুল মতিন, আজিজ আহমদ, শামসুল আলম, আবুল খায়ের, আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী, অলি আহাদ ও অন্যান্য।
১৯৪৭ সালের ৫ ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী উজিরে আজম খাজা নাজিমুদ্দিনের সরকার বাসভবন বর্ধমান হাউসে বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক বসে এবং এতে সিদ্ধান্ত হয় যে, উর্দুকে পূর্ববাংলার সরকারি ভাষা করা হবে না। কমিটির সভাপতি মওলানা আকরম খাঁকে এ বিষয়ে সংবাদপত্রে সংবাদ প্রকাশের ক্ষমতা দেয়া হয়।।
১৯৪৭ সালের ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তানের রাজধানী করাচীতে শুরু হয় স্বাধীন। পাকিস্তানের প্রথম শিক্ষা সম্মেলন। পূর্ব পাকিস্তানের স্বাস্থ্যমন্ত্রী হবীবুল্লাহ বাহার চৌধুরী এবং পাকিস্তানের শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান এই সম্মেলনে যােগ দেন। সম্মেলন শেষে ফিরে এসে ৫ ডিসেম্বর ঢাকা বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের তারা বলেন, শিক্ষা সম্মলনে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার সর্বসম্মতি ক্রমে এক প্রস্তাব পাস হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের মন্ত্রীদ্বয়ের এই দ্বিচারি চরিত্রের এবং কর্মের তীব্র সমালােচনা ও প্রতিবাদ ছাপা হয় পরদিন মর্নিং নিউজসহ বিভিন্ন পত্রিকায়। সেই দিনই অর্থাৎ ৬ ডিসেম্বর বেলা ২টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সামনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা, ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ, জগন্নাথ ইন্টারমিডিয়েট কলেজ এবং অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রদের এক বিরাট প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন তমদুন মজলিশের সেক্রেটারি অধ্যাপক জনাব আবুল কাসেম। ভাষার দাবিতে পূর্ব বাংলায় এটাই। ছিল প্রথম প্রকাশ্য বিক্ষোভ (পাকিস্তান থেকে যে সব মন্ত্রীগণ শিক্ষা সম্মেলনে। যােগ দিয়েছিলেন তাঁরাও উর্দুর পক্ষে নিজেদের সমর্থন জানিয়েছেন।)।
ছাত্রসভা : সভায় বক্তব্য রাখেন অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, আবদুর রহমান। চৌধুরী, কল্যাণ দাসগুপ্ত, এ, কে, এম, আহসান এবং এস আহমদ।
ছাত্র ইউনিয়নের সহ-সভাপতি ফরিদ আহমদ এই সভায় চারটি প্রস্তাব পেশ করেন এবং সকলে তা সমর্থন করেন। প্রস্তাবগুলাে হচ্ছে:
১. বাংলাকে পাকিস্তান ডােমিনিয়নের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা এবং পূর্ব পাকিস্তানের
সরকারি ভাষা ও শিক্ষার মাধ্যম করা হােক।
২. রাষ্ট্রভাষা ও লিংগুয়া ফ্রাঙ্কার যে ক্রান্তি সৃষ্টি করা হচ্ছে তার মূল উদ্দেশ্য
আসল সমস্যাকে ধামাচাপা দেওয়া এবং বাংলা ভাষা ও পূর্ব পাকিস্তানের
জনগণের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করা।
৩. পাকিস্তান সরকারের মন্ত্রী ফজলুর রহমান এবং প্রাদেশিক সরকারের মন্ত্রী
হবীবুল্লাহ বাহার চৌধুরীর উর্দু ভাষার দাবিকে সমর্থন করার জন্য এই সভা
তাঁদের চরিত্রের দ্বিমুখী আচরণের তীব্র নিন্দা করছে।
৪. সভা ‘মর্নিং নিউজ’ এর বাঙালি-বিরােধী প্রচারণার প্রতি নিন্দা জ্ঞাপন করছে এবং জনসাধারণের ইচ্ছার প্রাপ্ত অবস্থা প্রদর্শনের জন্য পত্রিকাটিকে সাবধান করে দিচ্ছে।
সভা শেষে ছাত্ররা মিছিল সহকারে বিভিন্ন রাস্তা প্রদক্ষিণ করে সেক্রেটারিয়েট ভবনে উপস্থিত হয়। সেখানে কৃষিমন্ত্রী মুহম্মদ আফজাল ছাত্রদের সামনে বক্তৃতা দেন এবং বাংলা ভাষার দাবিকে সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দেন। এরপর মিছিলটি প্রাদেশিক মন্ত্রী নুরুল আমীনের বাসভবনে যায়। মন্ত্রী ছাত্রদের প্রতিশ্রুতি দেন যে, তিনি বাংলার প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করবেন এবং এ কাজে ব্যর্থ হলে মন্ত্রীত্বে ইস্তফা দেবেন।
অতপর ছাত্রদের মিছিল বিভিন্ন মন্ত্রীর বাড়ি ঘুরে মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের বাসভবন বর্ধমান হাউসে গেলে মন্ত্রী অসুস্থতার অজুহাত দেখিয়ে ছাত্রদের সাথে দেখা করতে অপারগতা প্রকাশ করেন। ছাত্ররা সেখান থেকে মিছিল করে মর্নিং নিউজ অফিসে এসে ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে মর্নিং নিউজের বিপক্ষ অবস্থান পরিবর্তনের হুমকি দিয়ে আসে। এ সময় ঢাকায় বাঙালি-অবাঙালি উর্দু সমর্থকদের মধ্যে এক সংঘর্ষ বেঁধে যায়। এতে করে রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নটি আরাে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ১২ ডিসেম্বর কয়েকটি বাস এবং ট্রাকে করে ছাত্র নামধারী একদল উচ্ছঙ্খল উর্দুভাষী মুসলিম লীগ সমর্থক ঢাকা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্রদের উপর এবং পলাশী ব্যারাকে বসবাসকারী সরকারি কর্মচারিদের উপর হামলা চালায়। মুসলিম লীগের কর্মীদের এই গুণ্ডামির খবর সারা ঢাকা শহরে বিদ্যুৎ বেগে ছড়িয়ে পড়লে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র পলাশী ব্যারাক ও অন্যান্য এলাকার কর্মচারি সাধারণ জনগণ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ হােস্টেল প্রাঙ্গণে সমবেত হয়। সমবেত জনতা মুসলিম লীগের গুণ্ডাদের শাস্তি এবং এমনতর ঘটনার প্রতিকার দাবি করেন। ছাত্রজনতার বক্তৃতা শেষে এক বিরাট মিছিল করে তারা সেক্রেটারিয়েটে যান। এর : আগে মিছিলটি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে বেরিয়ে মেডিকেল কলেজ পার হয়ে বেলা প্রায় সাড়ে তিনটার দিকে শিক্ষামন্ত্রী আবদুল হামিদের বাসভবনে যায়। শিক্ষামন্ত্রীর সরকারি বাসভবন ছিল সেক্রেটারিয়েটের পাশে আবদুল গনি রােডে। সত্যিকার অর্থে বাংলাভাষার দাবিতে এ জাতীয় বিশাল জঙ্গী মিছিল এটাই প্রথম ঢাকা শহরের বুকে। যে মিছিলে ছাত্র-জনতা সরকারি কর্মচারী অংশ গ্রহণ করেছে।
শিক্ষামন্ত্রী ছাত্রদের আশ্বস্ত করেন এই ঘটনার জোর তদন্ত করাবেন এবং দোষীদের উপযুক্ত শাস্তি প্রদান করবেন। পূর্ববাংলায় বাংলা প্রতিষ্ঠা করবেন। এ কাজে ব্যর্থ হলে মন্ত্রীত্ব থেকে পদত্যাগ করবেন তিনি বলে প্রতিশ্রুতি দেন।
এরপর ছাত্রদের সাথে একান্ত হয়ে কৃষিমন্ত্রী সৈয়দ আফজাল হােসেন মিছিলের সাথে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ হােস্টেলে, পলাশী ব্যারাক পরিদর্শন করেন। এবং মুসলিম লীগের এই গুণ্ডামির তীব্র সমালােচনা করেন। এ ঘটনার বিস্তারিত রিপাের্ট দৈনিক আজাদে প্রকাশিত হয়। রিপাের্টে বলা হয় বাংলা উর্দু লইয়া যে বিরােধ চলিতেছিল তাহা লইয়া দুইদল মুসলমানের মধ্যে আজ একটি সংঘর্ষ হইয়া গিয়াছে। এই সংঘর্ষে কয়েক ব্যক্তি আহত হইয়াছে। অদ্য রাতে বাসে করিয়া কতিপয় মুসলমান যুবক প্রচার করতে থাকে যে, উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করা হউক। এই প্রচার বাহিনী পলাশী ব্যারাকের নিকট পৌছিলে এক সংঘর্ষ বাঁধিয়া যায় এবং লাঠি ও ইটপাটকেল ব্যবহৃত হয়। অন্যান্য কয়েকটি স্থানেও বাঙালি ও উর্দুভাষার সমর্থকদের মধ্যে কয়েকবার সংঘর্ষ হয়। বৈকাল ৩টা পর্যন্ত ২০ জনেরও অধিক লােক আহত হয়। ইহাদের মধ্যে ১৭ জনকে প্রাথমিক চিকিৎসার পর ছাড়িয়া দেওয়া হয়। ইহার পর বাঙালি মুসলমানদের বিরাট একদল জনতা রমনা ও সেক্রেটারিয়েট অঞ্চলে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে এবং অবিলম্বে বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা গ্রহণের দাবি জানায়’ (সংক্ষিপ্ত)।
রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে পূর্ব পাকিস্তানে যে বিতর্ক বিক্ষোভ ও আন্দোলনের প্রস্তুতি চলছিল সেই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৪৭ সালের ১৫ ডিসেম্বর পাকিস্তান কেন্দ্রীয় শিক্ষাদফতরের এক প্রেসনােট প্রকাশ করে। প্রেসনােটে বলা হয়, পাকিস্তানের বিভিন্ন ইউনিয়নের রাষ্ট্রভাষা কিংবা সরকারি ভাষা কি হইবে, সে সম্পর্কে শিক্ষা সম্মেলনে কোনাে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় নাই।
তবে শিক্ষা সম্মেলনে যে সব প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল তাও বাংলার খুব পক্ষে ছিল না। শিক্ষা সম্মেলনে গৃহীত দুটি প্রস্তাব এখানে উল্লেখ করছি। উর্দুকে পাকিস্তানের সাধারণ ভাষারূপে গ্রহণ করিবার জন্য এই সম্মেলন পাকিস্তান। গণপরিষদের নিকট সােপারিশ করিতেছে। এবং এই সম্মেলন মনে করে যে, বিভিন্ন স্কুলসমূহে উর্দুভাষাকে বাধ্যতামূলকভাবে শিক্ষা দিতেই হইবে।’
শিক্ষা সমােলনের গৃহীত এই প্রস্তাব ৫২ এর আন্দোলনে রাষ্ট্রভাষা বাংলাকে স্বীকার করে নেওয়ার পরও পাকিস্তান সরকার গােপনে কার্যকরী রেখেছে। ষাট দশকে রাজশাহী বাের্ডে মাধ্যমিক পর্যায়ের স্কুলে ১০০ নম্বরের উর্দুভাষা শিক্ষা ছিল বাধ্যতামূলক। পূর্ব পাকিস্তানি জনগণের মধ্যে উর্দুর বিস্তারের উদ্দেশ্যে ষাটের দশকে রেডিও পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্র থেকে পুরাে ১ ঘণ্টার একটি উর্দু শিক্ষার আসর প্রচার করা হতাে। ডেইজি আজিজ অনুষ্ঠানের উপস্থাপক ছিলেন।
বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার আন্দোলনের প্রয়ােজনীয়তা ধীরে ধীরে তীব্র হতে থাকল। পূর্ববাংলায় মুসলিম লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক সংগঠন এবং ছাত্র সংগঠন গড়ে তােলার প্রয়ােজনীয়তা তাই তীব্র হতে থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল ছাত্রদের কাছে বাঙালি ছাত্রদের নিজস্ব সংগঠন গড়ার প্রয়ােজনে অনুভব করলেন। কারণ তারা উপলব্ধি করতে শুরু করেছেন যে ঐক্যবদ্ধ সাংগঠনিক শক্তি ছাড়া জাতীয় পর্যায়ে বৃহত্তর ছাত্র আন্দোলন কার্যকরী কোনাে ভূমিকা পালন করতে পারবে না। বৃহত্তর ছাত্র আন্দোলনের স্বার্থে ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি বিকেলে ফজলুল হক হল মিলনায়তনে এক ছাত্র কর্মিসভার মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের সাংগঠনিক কমিটি গঠিত হয়। এই কমিটিতে ফেনী কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক নাজমুল করিম সভাপতিত্ব করেন। ১৪ সদস্যের কমিটিতে ছিলেন ১. নঈমুদ্দীন আহমদ আহবায়ক, (২) আবদুর রহমান চৌধুরী (3) শেখ মুজিবুর রহমান (৪) অলি আহাদ (5) আজিজ আহমদ (৬) আবদুল মতিন (৭) দবিরুল ইসলাম (৮) মফিজুর রহমান (৮) মফিজুর রহমান (৯) শেখ আবদুর আজিজ (১০) নওয়াব আলী (১১) নুরুল কবির (১২) আবদুল আজিজ (১৩) সৈয়দ নূরুল ও (১৪) আবদুল কুদুস চৌধুরী। এমনি করে ভাষার দাবি দিতে দিনে রাজনৈতিক রূপ নিতে থাকে। পলাশী ব্যারাক এবং ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের হােস্টেলের উত্তেজনা আপাতত প্রশমিত হলেও ঐ দিনই বিকেলে থেকে পরিস্থিতির আবার অবনতি ঘটতে থাকে। ঐদিন বিকেলে ঢাকা জেলা জজ কোর্টের উল্টোদিকে অবস্থিত ও, কে রেস্টুরেন্টে চা নাস্তা খাওয়াসহ বর্তমান বিষয় ও পরিস্থিতি নিয়ে আলাপ আলােচনার পর রেস্টুরেন্ট থেকে বের হওয়ার সাথে সাথে পুরােনাে ঢাকার (১৫০ নং মােগলটুলী) তে অবস্থিত পূর্ববঙ্গ মুসলিম লীগ কর্মী শিবিরের অন্যতম নেতা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নঈমুদ্দীন আহমদ ও তার সঙ্গী শামসুদ্দীন আহমদ দুবৃর্তদের দ্বারা আক্রান্ত হন এবং দুবৃত্তদের লাঠির আঘাতে নঈমুদ্দীনের মাথা ফেটে যায়।
বিকেলেই এই ঘটনার প্রতিবাদে ফজলুল হক হলে একটি প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সময়ে রায় সাহেব বাজারে একটি মিটিং চলাকালীন মিডফোর্ড মেডিকেল স্কুলের ৩ জন ছাত্রও দুবৃত্তদের আক্রমণে আহত হয়। পূর্ববাংলার মানুষ এই ঘটনাবলিকে সহজভাবে নিতে পারেন নাই। এই ঘটনার প্রতিবাদে তাদের বিভিন্ন দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সেক্রেটারিয়েটের কর্মচারীগণ তাদের অন্যান্য দাবির ভেতর অন্যতম ছিল বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করতে হবে।
প্রত্যুত্তরে সরকার ঢাকা শহরে এ দিন সন্ধ্যায় ১৪৪ ধারা জারি করে। ১৫ দিনের জন্য সকল প্রকার সভা, মিছিল নিষিদ্ধ ঘােষণা করে।
১৯৪৮ সালের পাকিস্তান গণপরিষদের শীতকালীন অধিবেশন জানুয়ারি মাসে শুরু হয় করাচিতে। ২৫ ফেব্রুয়ারির অধিবেশনে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে সরকারি প্রস্তাব ছিল, “উর্দু এবং ইংরেজী হইবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।’
পূর্বপাকিস্তান হতে নির্বাচিত গণপরিষদ প্রতিনিধি আইনজীবী বাবু ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উর্দু ও ইংরেজির সঙ্গে বাংলাকেও গণপরিষদের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ব্যবহারের স্বপক্ষে দাবি উত্থাপন করেন। সরকারি প্রস্তাবের ওপর একটি সংশােধনী পেশ করে তিনি বলেন :
.. রাষ্ট্রভাষা সেই ভাষাই হওয়া উচিত, রাষ্ট্রের অধিকাংশ মানুষ যে ভাষা ব্যবহার করে। এবং… আমি মনে করি যে, বাংলাভাষাই আমাদের রাষ্ট্রের লিংগুয়া ফ্রাংকা… যদি ২৯ নং বিধিতে ইংরেজি ভাষা সম্মানজনক স্থান পেতে পারে যদি পরিষদের কার্যাবলী উর্দু অথবা ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে চলতে পারে তাহলে বাংলা, যা চার কোটি চল্লিশ লক্ষ লােকের ভাষা কেন সম্মানজনক স্থান পাবে না? কাজেই এ ভাষাকে প্রাদেশিক ভাষা হিসেবে বিবেচনা করা উচিত নয়। এ ভাষাকে রাষ্ট্রের ভাষা রূপে বিবেচনা করা উচিত। সুতরাং,… আমি প্রস্তাব করি যে, ২৯ নং বিধিতে ইংরেজি শব্দটির পরে অথবা বাংলা কথাটি যােগ করা হােক।

পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশনে ১৯৪৮ সালের ২৫শে ফেব্রুয়ারি সংশােধনী প্রস্তাব উত্থাপনের জন্য পরিষদ সভাপতির অনুমােদন নিয়ে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত নিম্নোক্ত বক্তব্য উত্থাপন করেন: Mr. Dhirendra Nath Dutta : May I speak, Sir? Mr. President : Yes speak.
Mr. Dhirendranath Dutta : Sir, In moving this -the motion that stands in my name, I can assure the House that I do not in a spirit of narrow Provincialism, but, Sir in the spirit that this motion receives the fullest consideration at the hands of the members. I know, Sir, that Bengalee is a provincial language, but, so far our state is concerned, it is the language of the majority of the people of the State. So although it is a provincial language, it is a language of the majority of the people of the state and it stands on a different footing therefore. Out of six crores ninety lakhs of people inhabiting this State, 4 crores and 40 lakhs of people speak the Bengali language. So, Sir, what should be the language which is used by the majority of the people of the State, and for that, Sir, I consider that Bengali language is a lingua franca of our State. It may be contended with a certain amount of force that even in our sister dominion the provincial language have not got the status of a lingua franca because in her sister dominion of India the proceedings of the Constituent Assembly is conducted in the Bengali language but so far as the Bengalee is concerned out of 30 crores of people inhabiting, that sister dominion two and a half crores speak the Bengali language. Hindustani, Hindi or Urdu had been given and honored place in the sister dominion because the majority of the people of the Indian dominion speak that language. So we are to consider that in our state it is found that the majority of the people of the State do speak the Bengali language than Bengalee should have an honored place even in the Central Government.
I know, Sir, I voice the sentiments of the vast millions of our State. In the meantime I want to let the House know the feelings of the vastest millions of our State. Even, Sir, in the Eastern Pakistan where the people numbering four crores and forty lakhs speak the Bengalee language the common man even if he goes to a Post Office and wants to have a money order form finds that the money order is printed in Urdu Language and is not printed in Bengalee language or it is printed in English. A poor cultivator, who has got his son Sir, as a student in the Dhaka University and who wants to send money to him, goes to a village Post Office and he asked for a money order form, finds that the money order form is printed in Urdu language. He can not send the money order but shall have to rush to a distant town and have this money order form translated for him and then the money order, Sir that is necessary for his boy can be sent. The poor cultivator, Sir, sells a certain plot of land or a poor cultivator purchases a plot of land and goes to the stamp vendor and pays him money but cannot say whether he has received the value of the money is stamps. The value of the stamp, Sir is written not in Bengalee but is written in Urdu and English. But he cannot say, Sir, whether he has got the real value of the State. The language of the State should be such which can be understood by the common man of our State. The common man of the State numbering four crores and four millions find that the proceedings of this Assembly which is their mother of parliaments is being conduct in a language, Sir, which is unknown to them. Then, Sir English has got an honored place because of the International Character.
But, Sir, if English can have an honored place in Rule 29 that the proceedings of the Assembly should be conducted in Urdu or English why Bengalee, which is spoken by four crores forty lakhs of people should not have honored place. Sir, in Rule 29 of the procedure Rules, So, Sir, I know I am voicing the sentiments of the vast millions of our State and therefore Bengalee should not be treated as a Provincial Language. It should be treated as the language of the State. And therefore, Sir, I suggest that after the word English, the words ‘Bengalee’ be inserted in Rule 29. I do not wish to detain the House but I wish that the members present here should give a consideration to the sentiments of the vast millions of over State, Sir, and should accept the amendment that has been moved by me.
Mr. President : I may read out the amendment again some members might not have it.
Amendment moved : That in sub-rule (1) of rule 29, after the word English in line 2, the words ‘or Bengalee’ be inserted.
Mr. Prem Hari Barma (East Bengal: General): Sir, I wholeheartedly support the amendment moved by my Hon’ble and esteemed friend Mr. Dhirendranath Dutta. Sir, this amendment does not seek to oust English or Urdu altogether but it seeks only to have Bengali as one of the media spoken in the Assembly by the members of the Assembly. So, it is not the intention of the amendment altogether to oust English or Urdu, but to have Bengali also as the lingua franca of the State Sir, as my Honorable friend has told as the lingua franca of the State Sir, as my Honorable friend has told the House, the majority of the people of the State of Pakistan speaks Bengali. Therefore, Bengali must find a place as one of the media in which the members can address the Assembly. Another difficulty will be that if any member speaks in his mother tongue, but if it is not one of the media in which the members can address the House, the true speech will not be recorded, but only a translation of the speech in the proceedings of the House will be recorded. Therefore, it is necessary for the majority of the people of the State that the speeches which will be delivered in Bengali should be recorded in Bengali. With these few words I support the amendment moved by Mr. Dhirendranath Dutta.
The Hon’ble Mr. Liaquat Ali Khan (Prime Minister and Minister for Defense) : Mr. President, Sir, I listened to the speech of the Hon’ble the Mover of the amendment with very great care and attention. I wish the Hon’ble member had not moved his amendment and tried to create friend has waxed eloquent and stated that Bengalee should really be the lingua franca of Pakistan. In other words, he does not want Bengalee only to be used as a medium of expression in this House, but he has indeed raised a very important question. He should realize that Pakistan has been created because of the demand of a hundred million muslims in this sub-continent and the language of hundred million Muslims is Urdu and, therefore, it is wrong for him now to try and create the situation that as the majority of the people of Pakistan belongs to one part of Pakistan, therefore, the language which is spoken there should become the State language of Pakistan. Pakistan is a Muslim State and it must have as its lingua franca the language of the Muslim nation. My Honorable friend is displeased that Urdu should replace English. The intention is that instead of changing English as the State language which it has been so long. Urdu should be the State language, Sir, my Honorable friend never minded it, never praised Bengali as long as English was the State language. I never heard in the Central Assembly for years and years any voice raised by the people of Bengal that Bangalee should be the State language. I want to know why this voice is being raised today and I am sorry that he should feel it necessary to bring in this question. We recognize the importance of Bengalee. There is no intention to oust Bengalee altogether from Bengal. As a matter of fact, it would be wrong for anyone to thrust any other language on the people of a province which is not their mother tongue, but, at the same time, we must have a State language, the language which would be used between the different parts of Pakistan for inter-provincial communications. then, Sir, it is not only the population you have to take into consideration. There are so many other factors. Urdu can be the only language which can keep the people of East Bengal or Eastern Zone and the people of Western Zone joined together. It is necessary for a nation to have one language and that language can only be Urdu and no other language.
Mr. Dhirendranath Dutta : Certainly not that is not the intention.
Mr. Liaquat Ali Khan: My Honorable friend may go on questioning for the rest necessary for the people of Bengal- Bengali Speaking people to have remained united? No, because it was to be a State where Mussalmans were in a majority. Therefore, Bengal must be divided. There was no question of Bengali language or Bengali culture taken into consideration at that time.
The Hon’ble Sardar Abdur Rab Khan Nishtar : (Minister for Communications): The Hon’ble Member voted for division.
Mr. Liaquat Ali Khan : Anyhow I am not concerned with that part of it. I think it is wrong for my Honorable friend to raise that question. It is really the most vital question. But throughout this whole subcontinent I most strongly opposed the amendment which has been moved. I hope the House will not lend its support to such a kind of amendment.
(এই ধীরেন্দ্রনাথ দত্তই ১৯৪৭ সালে বঙ্গীয় প্রাদেশিক ব্যবস্থাপক পরিষদে Sarat Bose-H.S. Suhrawardy-Abul Hashem-Burrows-Kiran Sankar RayJogendranath Mandal-এর অখণ্ড স্বাধীন বঙ্গ প্রতিষ্ঠার প্রয়াসের বিরুদ্ধে-গান্ধীনেহেরু-পেটেল, শ্যামা প্রসাদ মুখার্জীর হিন্দু বাংলা প্রতিষ্ঠার পক্ষে ভােট দিয়েছিলেন। ফলে স্বাধীন অখণ্ড বঙ্গের স্থলে হিন্দু পশ্চিমবঙ্গ প্রতিষ্ঠিত হয়। এটাই তাদের অসাম্প্রদায়িকতা- এটাই তাদের বাংগালীত্ব। একমাত্র বাবু কিরণ শংকর রায় ব্যতীত কমরেড জ্যোতিবােস সহ Bengal Legislative Assembly-এর সব হিন্দু সদস্যই ছিলেন চরম সাম্প্রদায়িক ও হিন্দু পশ্চিমবঙ্গ প্রতিষ্ঠার মূল হােতা। সাম্প্রদায়িক হিন্দু এমএলএ দের কারণে পূর্ববাংলার ৫০/৬০ লক্ষ হিন্দু নিজ ভিটা মাটি ছেড়ে বাস্তহারা পরিচয়ে হিন্দুস্থানে হিজরত করে অমানবিক-অসামাজিক জীবন যাপনে বাধ্য হয়েছে।)
১৮৩৫ সালের ভারত শাসন বিধির ২৯ নং উপধারা সংশােধনের জন্যে ইংরেজি ভাষার সঙ্গে উর্দু ভাষার নামযুক্ত করার সরকারি প্রস্তাবের ওপর। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত এই সংশােধনী আনেন। দৈনিক আজাদ, ২৬ জানুয়ারি ১৯৪৮
ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের সংশােধনী প্রস্তাবটি সরকারি সদস্যদের বিরােধিতার মুখে অগ্রাহ্য তাে হয়ই তার উপর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াবজাদা লিয়াকত আলী খান। ও অন্য বক্তারা তীব্র ভাষায় তাকে আক্রমণ করেন। ঢাকায় ছাত্রদের কাছে বার বার দেওয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে পূর্ববঙ্গের উজীরে আলা অর্থাৎ মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন গণপরিষদে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে ওকালতি করেন।
প্রতিবাদে পূর্ব পাকিস্তানের ৪ কোটি ৪০ লক্ষ বাঙালি মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় জীবন বাজি রাখার শপথে সংকল্পবদ্ধ হয়। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র ছাত্রীরা ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে জমায়েত হয়। অধ্যাপক আবুল কালামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় বাবু ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে অভিনন্দন জানান হয় এবং নাজিমুদ্দিনের এই দাম্ভিক উক্তি ও আচরণের প্রতিবাদে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে আন্দোলনের ডাক দেয়া হয়। ১১ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানে সর্বাত্মক হরতাল আহবান করা হয় এবং সভা মিছিল ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালনের মাধ্যমে সমগ্র দেশব্যাপী ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস’ ঘােষণা করা হয়।
এই কর্মসূচিতে বিপুল সাড়া জাগানোের উদ্দেশ্যে এবং দেশবাসীকে রাষ্ট্রভাষা বাংলা স্বপক্ষে উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্যে ২ মার্চ ১৯৪৮ ফজলুল হক হলে এক প্রস্ততি সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় পাকিস্তান তমদুন মজলিশ, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ, গণআজাদী লীগ, পাকিস্তান ডেমােক্রেটিক ইয়থ লীগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল ছাত্র সংসদ এবং কলেজ প্রতিনিধিরা যােগ দেন।
পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদে সােহরাওয়ার্দী সমর্থক মুসলিম লীগ দলীয় সদস্যদের মধ্য থেকে জনাব তফাজ্জল আলী, জনাব আলী আহমদ খান ও মিসেস আনােয়ারা খাতুন নবগঠিত রাষ্ট্রভাষা কর্ম পরিষদের সঙ্গে একাত্মতা ঘােষণা করেন।
৩ মার্চ এই কর্মপরিষদ ১১ মার্চের ধর্মঘটকে সাফল্য মণ্ডিত করার জন্যে দেশবাসীর উদ্দেশ্যে এক বিবৃতি প্রদান করে। বিবৃতির কিছু অংশ ছিল নিম্নরূপ
(১) বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের প্রশাসনিক ভাষা।
(২) কেন্দ্রীয় পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা ও
(৩) পাকিস্তান গণপরিষদের অন্যতম ভাষা করিবার দাবিতে কিছুকাল যাবৎ ব্যাপক আন্দোলন চলিতেছে।
… বাংলা সমগ্র পাকিস্তানের দুই-তৃতীয়াংশ অধিবাসীর মাতৃভাষা। লজ্জার বিষয় যে, এই ভাষাকেই রাষ্ট্রীয় জীবনে প্রতিষ্ঠিত করিতে আন্দোলনের প্রয়ােজন হইয়া পড়িয়াছে। … ইহার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করিবার জন্যই পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ও তমদ্দুন মজলিশ ১১ মার্চ রােজ বৃহস্পতিবার সাধারণ হরতাল ঘােষণা করিয়াছে। সংযুক্ত রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রাম কমিটির কর্মসূচি অনুযায়ী শান্তিপূর্ণ ভাবে ও শৃঙ্খলার সহিত ধর্মঘট পালন করিবার জন্য আমরা সকল রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও শিক্ষাঙ্গন এবং পূর্ব পাকিস্তানের জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকল ছাত্র ও নাগরিকদের প্রতি আবেদন জানাইয়াছি। … কেন্দ্রীয় পাকিস্তান ও গণপরিষদে আমাদের আন্দোলনকে ভুল বুঝা উচিত হইবে না। এই গণতান্ত্রিক দাবিকে দমন না করিয়া বাংলা ভাষাকে মানিয়া লইলে, আমরা বিশ্বাস করি ইহাই হইবে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের একতার ভিত্তি। ভাষাসৈনিক অলি আহাদের ভাষ্যমতে ‘পত্রিকায় ১১ মার্চের হরতালের কর্মসূচি পাঠ করে শেখ মুজিবুর রহমান আন্দোলনে অংশগ্রহণ করিবার নিমিত্ত ১০ মার্চ গােপালগঞ্জ হইতে ঢাকায় আসেন।
১১ মার্চের কর্মসূচির মধ্যে ছিল প্রদেশব্যাপি সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট, রাষ্ট্রভাষা বাংলার স্বপক্ষে সভা ও সেক্রেটারিয়েটের কর্মচারীদের অফিসে যাওয়া থেকে বিরত রাখার জন্য পিকেটিং।
সকাল দশটা থেকে সংগ্রাম পরিষদের নেতা কর্মী এবং রাষ্ট্রভাষা বাংলার সমর্থকরা গ্রুপে গ্রুপে ভাগ হয়ে পিকেটিং শুরু করে। পিকেটিং এ নেতৃত্ব দেন। শামসুল হক, অলি আহাদ, শেখ মুজিবুর রহমান, আবদুর ওয়াদুদ, গােলাম আযম, খালেক নেওয়াজ, কাজী গােলাম মাহবুব, মাে: বায়তুল্লাহ। নেতা কর্মীরা সেক্রেটারিয়েট ভবনের প্রথম গেট অর্থাৎ সেগুন বাগিচার গেটে পিকেটাররা সেক্রেটারিয়েটের সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীদের অফিসে ঢুকতে নিষেধ করে এবং শান্তিপূর্ণভাবে বাধাদান করতে থাকে।
অপর দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় সলিমুল্লাহ হলের ভিপি আবদুর রহমান চৌধুরীর সভাপতিত্বে একসভা অনুষ্ঠিত হয় রাষ্ট্রভাষা বাংলার সমর্থনে। সভাশেষে সভায় যােগদানকারীরা এক বিক্ষোভ মিছিল বের করে। মিছিলটি শান্তিপূর্ণভাবে ও সুশৃঙ্খলা হাইকোর্টের সামনে গিয়ে সেক্রেটারিয়েটের দিকে এগুতে থাকলে সরকার সমর্থক একদল দুবৃর্ত পিকেটারদের উপর হামলা করে। পুলিশ মারমুখাে হয়ে ওঠে। ছাত্রদের বেদম বেধড়ক পিটাতে থাকে। এতে বহু ছাত্র আহত হয়। এরপর সিটি এসপি, আবদুল গফুরের হুকুমে পুলিশ বেপরােয়া লাঠিচার্জ শুরু করল। জনাব আবদুল ওয়াদুদ ও অলি আহাদ আহত হলেন, আহত অবস্থায় তাদের গ্রেফতার করা হলাে। ইংরেজ ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ মি: চ্যাথামের নির্দেশে শামসুল হক তাঁর গ্রুপের কিছু কর্মী গ্রেফতার হন। কিছুক্ষণ পর শেখ মুজিবুর রহমান তার কর্মীদের নিয়ে গ্রেফতার হন।
সেগুনবাগিচার সেক্রেটারিয়েটের গেটে পুলিশের আই জি, জাকির হােসেনের গাড়িকে রাস্তায় শুয়ে পড়ে ঠেকানাের চেষ্টা করলে কাজী গােলাম মাহবুবকে পুলিশ বেদম প্রহার করে এবং গ্রেফতার করে। পরে কোতােয়ালী থানায় তার নামে সুনির্দিষ্ট মামলা করে পুলিশ।
টিএন্ডটি অফিস অর্থাৎ টেলিফোন একচেঞ্জ ভবনের সামনে পিকেটিং করতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসুর) সাধারণ সম্পাদক (জিএস) গােলাম আযম (মানবতাবিরােধী অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত) তাঁর দশজন কর্মীসহ গ্রেফতার হন। তাদের গ্রেফতার করে তেজগাঁ থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। সভা, শােভাযাত্রা, বিক্ষোভ মিছিল, ছাত্রদের পিকেটিং এবং পুলিশের লাঠিচার্জের ফলে ১১ মার্চ ঢাকা শহর বিক্ষোভের নগরে পরিণত হয়। কারণ সেক্রেটারিয়েটের পিকেটিং এ ছাত্রদের ওপর পুলিশি হামলার খবর ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে, স্কুল, কলেজে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। ঢাকার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মানুষ গ্রেফতার হতে থাকে। বাংলার প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা এ, কে ফজলুল হকসহ প্রায় ৫০-৬০ জন্য ব্যক্তি পুলিশের হামলায় আহত হন।
সরকারের এহেন দমনীতির তীব্র সমালােচনা ও ঘটনার বিবরণ প্রকাশ করে দৈনিক আজাদ পত্রিকা। বিবরণে বলা হয়: বাংলাভাষার রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দাবি করিয়া ছাত্র বিক্ষোভ। ঢাকায় ছাত্রদের উপর লাঠি চার্জ : হক সাহেবসহ ৫০ জন আহত। সরকারি অফিসসমূহে পিকেটিং ও কর্মচারীদের অফিস ত্যাগ। শহরের বিভিন্ন স্থান হতে আহত ব্যক্তিগণকে মেডিকেল হাসপাতালে পাঠানাে হয় এবং জনাব এ, কে, ফজলুল হক ও অন্যান্য কয়েকজনকে প্রাথমিক চিকিৎসার পর ছেড়ে দেয়া হয়।
‘গ্রেফতার ও পুলিশী জুলুম’ এর প্রতিবাদে ১২, ১৩, ও ১৪ মার্চ প্রদেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের আহবায়ক নঈমুদ্দীন আহমদের সভাপতিত্বে এক প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। ১৪ মার্চ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে ফজলুল হক হলে অনুষ্ঠিত সভায় ১৫ মার্চ সারা পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ ধর্মঘট পালনের তারিখ স্থির করা হয়।
১১ মার্চের ভাষা আন্দোলনের তীব্রতা পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ সরকার তথা নাজিমুদ্দিন সরকারকে প্রচণ্ড এক ঝাঁকুনি দেয়। এদিকে পাকিস্তানের জাতির পিতা কায়েদে আজম মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ প্রথমবারের মতাে আসন্ন পূর্ব পাকিস্তান সফরের কর্মসূচির কারণে প্রাদেশিক সরকার অর্থাৎ নাজিমুদ্দিন সরকার আপসমুখী হয়ে ওঠে। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন আলােচনার প্রস্তাব দেন। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা আবুল কাসেমের নিকট লিখিত চিঠি পাঠান। এবং আর এক নেতা কামরুদ্দীন আহমদের কাছে সরকারের প্রতিনিধি পাঠিয়ে রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে আলােচনার প্রস্তাব রাখেন। নিজেদের মধ্যে আলােচনার পর সংগ্রাম পরিষদের নেতারা আলােচনায় বসতে রাজি হন।
রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে আবুল কাসেম, কামরুদ্দীন আহমদ, মােহাম্মদ তােয়াহা, নঈমুদ্দীন আহমদ, নজরুল ইসলাম, আজিজ আহমদ, আবদুর রহমান চৌধুরী প্রমুখ পূর্বনির্ধারিত আলােচনার জন্য সকাল সাড়ে এগারােটায় বর্ধমান হাউসে প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের বাসভবনে উপস্থিত হন। আলােচনা শুরু হলে সংগ্রাম পরিষদের সদস্যদের সঙ্গে খাজা নাজিমুদ্দিনের বাক-বিতণ্ডা শুরু হয়। উভয় পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা চরমে ওঠে। তর্ক বিতর্ক চলে বহুক্ষণ। প্রথমে খাজা নাজিমুদ্দিন সংগ্রাম পরিষদের গৃহীত সকল শর্তকে মেনে নিতে রাজি হন না। সংগ্রাম পরিষদও তাদের দাবি এবং যুক্তির পক্ষে অবিচল থাকে। ভাষাসৈনিক এবং ভাষা আন্দোলন সাতচল্লিশ থেকে বায়ান্ন গ্রন্থের রচয়িতা জনাব মােস্তফা কামাল তাঁর গ্রন্থে আলােচনায় অংশগ্রহণকারী সংগ্রামীদের ভূমিকা সম্পর্কে জনাব কামরুদ্দীন আহমদের বক্তব্যে বলেছেন, তােয়াহা সাহেব আন্দোলন বন্ধ করে আলােচনায় যেতে রাজি ছিলেন না। তাই তিনি আলােচনা ভেঙ্গে দেয়ার জন্য শেষ বাণ নিক্ষেপ করেন। খাজা নাজিমুদ্দিন শেষ পর্যন্ত সংগ্রাম পরিষদের উত্থাপিত সবগুলাে দাবি মেনে নিতে বাধ্য হন। আলােচনা সভা শেষে আবুল কাসেম ও কামরুদ্দীন আহমদ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে গিয়ে ১১ মার্চ আন্দোলনে অংশগ্র স্নকারী বন্দিদের সাথে উভয় পক্ষের আলােচনা বিষয়গুলাে নিয়ে আলােচনা করেন এবং গৃহীত চুক্তির লিখিত শর্তগুলাে দেখান। শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ, শওকত আলী, কাজী গােলাম মাহবুব আন্দোলনকারীদের গৃহীত কাজে এবং শর্তে নিজেদের সমর্থন জানান। এরপর সরকার পক্ষে প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন এবং সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে কামরুদ্দীন আহমদ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। | ভাষা সংগ্রাম পরিষদের দাবিগুলাে ছিল এবং উভয় পক্ষের চুক্তি ও এর ভাষ্য ছিল নিম্নরূপ :
১. ২৯ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৮ হইতে বাংলা ভাষার প্রশ্নে যাহাদিগকে গ্রেফতার করা হইয়াছে তাহাদিগকে অবিলম্বে মুক্তি দান করা হইবে।
২. পুলিশ কর্তৃক অত্যাচারের অভিযােগ সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং তদন্ত করিয়া এক মাসের মধ্যে এ বিষয়ে একটি বিবৃতি প্রদান করিবেন।
৩. ১৯৪৮ এর এপ্রিল প্রথম সপ্তাহে পূর্ববাংলা সরকারের ব্যবস্থাপক সভায় বেসরকারি আলােচনার জন্য যে দিন নির্ধারিত হইয়াছে, সেই দিন বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করিবার এবং তাহাকে পাকিস্তান গণপরিষদে এবং কেন্দ্রীয় সরকারের পরীক্ষা দিতে উর্দুর সমমর্যাদা দানের জন্য একটি বিশেষ প্রস্তাব উপস্থাপন করা হইবে।
৪. এপ্রিল মাসে ব্যবস্থাপক সভায় এই মর্মে একটি প্রস্তাব উপস্থাপন করা। হইবে যে, প্রদেশের সরকারি ভাষা হিসেবে ইংরেজি উঠিয়ে যাওয়ার পরই বাংলা ভাষার স্থলে সরকারি ভাষা রূপে স্বীকৃত হইবে। ইহা ছাড়া শিক্ষার মাধ্যম হইবে বাংলা। তবে সাধারণভাবে স্কুল কলেজগুলােতে অধিকাংশ ছাত্রের মাতৃভাষার মাধ্যমেই শিক্ষাদান করা হইবে।
৫. আন্দোলনে যাহারা অংশগ্রহণ করিয়াছেন তাহাদের কাহারাে বিরুদ্ধে কোনাে ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাইবে না।
৬. সংবাদপত্রের উপর হইতে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হইবে।
৭. ২৯ শে ফেব্রুয়ারি হইতে পূর্ববাংলার যে সকল স্থানে ভাষা আন্দোলনের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করা হইয়াছে সেখান হইতে তথা প্রত্যাহার করা হইবে।
৮. সংগ্রাম পরিষদের সহিত আলােচনার পর ‘আমি (খাজা নাজিমুদ্দিন) এ
ব্যাপারে নিঃসন্দেহ হইয়াছি যে, এই আন্দোলন রাষ্ট্রের দুশমনদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয় নাই। চুক্তি স্বাক্ষরের পর সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ এক বিজয় মিছিল বের করেন। বিজয় মিছিল বর্তমান শহিদ মিনারের কাছে এসে জমায়েত হয়। সেখানে আবুল কাসেম চুক্তির শর্তাবলী পাঠ করে শােনান এবং মিছিলকারীদের সামনে বক্তব্য রাখেন। তিনি বলেন, আমরা আন্দোলনের স্বার্থে আন্দোলন করি না। আমরা যা দাবি করেছিলাম তা মান্য হয়েছে আন্দোলকারীদের এই সাফল্য সংবাদপত্রগুলােতে প্রশংসা এবং অভিনন্দন। জানান হয়। চুক্তির শর্তাবলী বিভিন্ন পত্রিকায় বড় বড় হেড লাইনে ছাপান হয়। আন্দোলনের অন্যতম সমর্থনকারী ‘ইত্তেফাক সম্পাদকীয়তে লেখেন, বিরাট শক্তি ও দুর্জয় বিরােধিতার মধ্যে সংগ্রাম করিয়া বাংলা ভাষা আন্দোলনকারীগণ যে সাফল্য লাভ করিয়াছেন তাহা ইতিহাসে সােনার হরফে লিখিত থাকিবে। চুক্তির পরও আন্দোলন অব্যাহত থাকে। ১৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় এক সাধারণ ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন শেখ মুজিবুর রহমান। সভায় সংগ্রাম পরিষদ কর্তৃক গৃহীত চুক্তির কিছু সংশােধনীর প্রস্তাব রাখা হয়।
(ক) ঢাকা ও অন্যান্য জেলায় পুলিশী বাড়াবাড়ি সম্পর্কে তদন্তের জন্য সংগ্রাম কমিটি কর্তৃক অনুমােদিত এবং সরকারি ও বেসরকারি সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত একটি তদন্ত কমিটি নিয়ােগ করিতে হইবে।
(খ) বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দানের সুপারিশ করিয়া
প্রস্তাব গ্রহণের উদ্দেশ্য আলােচনার জন্য পূর্ববাংলা পরিষদের অধিবেশন চলাকালে একটি বিশেষ দিন নির্ধারণ করিতে হইবে।
(গ) সংবিধান সভা কর্তৃক তাঁহারা উপরােক্ত সংশােধনী প্রস্তাবগুলাে অনুমােদন করাইতে অসমর্থ হইলে সংবিধান সভার এবং পূর্ববাংলা মন্ত্রীসভার সদস্যদিগকে পদত্যাগ করিতে হইবে।
সংশােধনী প্রস্তাবটি অলি আহদের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর নিকট পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
সভা শেষে একটি মিছিল বের করা হয়। মিছিলটির স্লোগান ছিল পাকিস্তান জিন্দাবাদ; রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, উর্দু-বাংলা ভাই ভাই; বাংলা-উর্দু বিরােধ নাই। | এক পর্যায়ে শান্তিপূর্ণ মিছিলটি বিক্ষোভ মিছিলে পরিণত হলে পুলিশ মিছিলকারীদের উপর লাঠিচার্জ করে। কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি বর্ষণ করে।
পুলিশী জুলুমের প্রতিবাদ ১৯৪৮ সালের ১৭ মার্চ সারা বাংলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালন করা হয়। তবে পরদিনই ১৮ মার্চ ফজলুল হক হলে সংগ্রাম পরিষদের বৈঠক বসে। বৈঠকে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদার প্রতিষ্ঠিত করার আন্দোলনের সাথে সাথে আগামীকাল অর্থাৎ পরদিন ১৯ মার্চ জাতির পিতা মােহাম্মদ আলী জিন্নাহর ঢাকা সফরকালীন শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখা এবং জাতির পিতার উপযুক্ত সম্বধনা জ্ঞাপন করার জাতীয় প্রস্তাবটিতে সকল প্রকার সমর্থন ও সহযােগিতা করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
১৯ মার্চ ১৯৪৮ বিকেলে কায়েদে আযম মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকা আগমন করেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাত্র কয়েক মাস অতিবাহিত হয়েছে। পাকিস্তানের জনক জাতির পিতা হিসেবে তাঁর তখন বিপুল জনপ্রিয়তা। সেদিনের কথা ভাষা সংগ্রামী অলি আহাদ পরবর্তীকালে তাঁর স্মৃতিচারণমূলক ‘জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ৭৫ গ্রন্থে এভাবে উল্লেখ করেছেন, ‘১৯ শে মার্চ ঢাকা বিমান বন্দরে অবতরণ করিলে তাহাকে অশ্রুতপূর্ব ও স্বতঃস্ফূর্ত ঐতিহাসিক সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করা হয়। ঢাকা বিমান বন্দর হইতে রেসকোর্স পর্যন্ত লােকে লােকারণ্য ছিল, তিল ধারণের স্থান ছিল না। হর্ষোৎফুল্ল জনতার এই ঢল দেখিয়া কে বলিবে, মাত্র দুই দিন পূর্বেও ঢাকা শহরে সরকার বিরােধী আন্দোলনের উত্তাল তরঙ্গ ঢাকার কর্তা ব্যক্তিদের মসনদকে টলটলায়মান করিয়া তুলিয়াছিল। দেশবাসীর কি অকৃত্রিম ভালােবাসাই না ছিল রাষ্ট্রের জনকের প্রতি। কিন্তু ঢাকা আগমনের পূর্বেই তাঁকে ভাষা আন্দোলনকারীদের সম্পর্কে প্রদেশের ক্ষমতাসীন মহল হতে ভ্রান্ত ধারণা দেয়া হয়েছিল।
২১ মার্চ রেসকোর্সের ময়দানে ঢাকার নাগরিকদের কর্তৃক আয়ােজিত এক বিরাট জনসভা তথা সম্বর্ধনা সভায় মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ দীর্ঘ বক্তৃতা করেন। বক্তৃতায় সদ্য স্বাধীন দেশের বিভিন্ন বিষয়ের সাথে তিনি স্বাধীনদেশের রাষ্ট্রভাষা কি হবে এবং ভাষা নিয়ে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে বিরূপমত প্রকাশ করেন। পাকিস্তানের জনক, জাতির পিতা মােহাম্মদ আলী জিন্নাহর পূর্ব পাকিস্তানিদের উদ্দেশ্যে এটাই প্রথম ভাষণ।
অতি পরিতাপের বিষয়, কায়েদে আযম ২১ শে মার্চ রেসকোর্সে অনুষ্ঠিত জনসমাবেশে ভাষণদানকালে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘােষণা করিলেন যে, উর্দুই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা এবং ভাষা আন্দোলন বিদেশী চক্রান্ত বিশেষ।

Reference: দৈনিক স্টেটসম্যান, অমলেন্দু দে- পাকিস্তান প্রস্তাব ও ফজলুল হক, পৃষ্ঠা ১১৫ ও শিলা সেন, ‘মুসলিম পলিটিক্স ইন বেঙ্গল’।