১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে তিন লক্ষ লােকের সমাবেশে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মােহাম্মদ আলীর জিন্নাহর ভাষণ : (অনুবাদ)
আস্সালামু আলায়কুম।
আমি প্রথমে সম্বর্ধনা আয়ােজন কমিটির চেয়ারম্যানের মাধ্যমে ঢাকাবাসী এবং প্রদেশের সবাইর নিকট, আমাকে এই সম্মান জানানাের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। পূর্ববাংলায় আমার এই সফর, আমার জন্য বড় আনন্দদায়ক মনে হচ্ছে। পূর্ববাংলা পাকিস্তানের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এ অংশে পৃথিবীর এক বিরাট সংখ্যক মুসলমান, একটা নির্দিষ্ট জায়গার ভিতরেই, অবিচ্ছিন্নভাবে বাস করছে। এই অঞ্চল সফর করার প্রচণ্ড আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিলাম। কতগুলাে গুরুত্বপূর্ণ কারণে, আমার সফরের কিছুটা দেরী হয়ে গেছে। | আপনারা অবশ্যই কতগুলাে জরুরি বিষয় জানেন যে, ভারত ভাগের সঙ্গে সঙ্গে পাঞ্জাবে কী ঘটনা ঘটে গেছে। পূর্ব পাঞ্জাব, দিল্লী এবং এর নিকটবর্তী এলাকাগুলাে থেকে, ওখানে বসবাসরত লাখ লাখ মুসলমানদেরকে, তাদের জায়গা-জমি, ঘরবাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এসব ভাগ্যহত মুসলমানদের বাঁচিয়ে রাখা, আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা এবং পুনর্বাসনের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানে আমাদের ব্যবস্থা নিতে হয়েছে। পৃথিবীর ইতিহাসে, এরূপ ঘটনা খুব কমই খুঁজে পাওয়া যাবে যে, একটি নতুন রাষ্ট্রকে এত বড় কঠিন সমস্যার মুখােমুখি হতে হয়েছে। আল্লাহর মেহেরবানীতে, সদ্য প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রের পক্ষে, এই বিরাট এবং কঠিন সমস্যা অত্যন্ত যােগ্যতা ও সাহসের সাথে মােকাবেলা করা সম্ভব হয়েছে। আমাদের দুশমনদের মনের বাসনা ছিল, পাকিস্তান জন্মের সাথে সাথেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাক। শত্রুদের কামনাকে মিথ্যা প্রমাণ করে, তাদের চাপিয়ে দেওয়া কঠিন সমস্যা সমাধানে পাকিস্তান সক্ষম হয়েছে এবং পাকিস্তান দিনের পর দিন শক্তিশালী হয়ে উঠছে। পাকিস্তান টিকে থাকার জন্যই এসেছে এবং যে উদ্দেশ্য নিয়ে এদেশটির জন্ম হয়েছে, আমরা সেই লক্ষ্যপানে কাজ করে যাব।
এই সম্বর্ধনা সভায় যে সব বক্তৃতা হলাে, তাতে আপনারা বলেছেন যে, বিপুল সম্ভাবনাময় এই প্রদেশের কৃষিখাত এবং শিল্পখাতকে জোরদার করে তুলতে হবে। প্রদেশের সকল তরুণ, যুবক এবং নারীদের যােগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তােলার প্রয়ােজনীয় প্রশিক্ষণ দানের ব্যবস্থা করতে হবে। দেশের সশস্ত্রবাহিনীতে এ অঞ্চলবাসী যেন যথাযােগ্য ভূমিকা পালন করতে পারে, সে অবস্থাকে নিশ্চিত করতে হবে। চট্টগ্রাম বন্দর উন্নয়নের কথা বলেছেন। পাকিস্তানের সাথে এই প্রদেশের যােগাযােগ সহজ এবং সুগম করার কথা বলেছেন। শিক্ষা বিস্তারের কথা বলেছেন। সবশেষে আপনারা জোর দিয়ে বলেছেন যে, পাকিস্তানের এই পূর্ব অংশের প্রতিটি নাগরিক তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে যেন, কোনােভাবেই বঞ্চিত হয় এবং সরকারের প্রতিটি স্তরে তাদের ন্যায্য হিস্সা নিশ্চিত করা হয়।
আমি এখনই আপনাদের আশ্বস্ত করতে চাই, আপনাদের উদ্বেগ নিরসন এবং ন্যায্য দাবিসমূহ কিভাবে এবং যত তাড়াতাড়ি পূরণ করা যায়, আমার সরকার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা সহকারে উল্লিখিত আপনাদের দাবিসমূহের অনেকগুলাে বাস্তবায়নের কাজ ইতিমধ্যে হাতে তুলে নিয়েছে এবং কোনাে রকম শিথিলতা ছাড়াই কাজ করে যাচ্ছে। বিষয়গুলাে ভেবে দেখা হবে, এরকমের সময় নষ্ট করারও অবকাশ থাকবে না। পাকিস্তানের এই অংশ, তার ন্যায্য ও পূর্ণ পাওনা যত দ্রুত সম্ভব লাভ করবে। এই অঞ্চলের অতীত ইতিহাস বলে, পূর্ববাংলার মানুষেরা শৌর্যে, বীর্যে, পরিশ্রমে এবং মেধায় অনেক যােগ্যতার স্বাক্ষর রেখেছে। সরকার এ প্রদেশের তরুণ ও যুবাদের জনশক্তিতে রূপান্তরের জন্য তাদেরকে প্রয়ােজনীয় ট্রেনিং প্রদানের কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। সরকার এদেশের যুবকদের তাদের নিজ দেশের সশস্ত্রবাহিনী এবং পাকিস্তান ন্যাশনাল গার্ডে যথাযােগ্য ভূমিকা পালনের পথ খুলে দিয়েছে এবং খােলা থাকবে। আমি একথা জোর দিয়ে বলে যাচ্ছি, দেশের সশস্ত্র বাহিনীতে পূর্ববাংলার তরুণেরা সকল সুযােগ সদ্ব্যবহার করে, নিজ দেশকে দুশমনদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য জীবন বিলিয়ে দেবার অধিকার থেকে তাদেরকে বঞ্চিত করার কোনাে প্রশ্নই উঠতে পারবে না।।
এবার আমি এদেশের অন্য আরাে কিছু নিয়ে কথা বলব। সে কথা বলার আগে আমি পূর্ববাংলার অধিবাসী এবং সরকারকে আরেকবার মােবারকবাদ জানাতে চাই এজন্য যে, গত সাত মাসে আপনারা দেশ গড়ার কাজে বহু কষ্ট এবং ত্যাগ স্বীকার করেছেন। ভারত ভাগ হওয়ার পরপরই যে অব্যবস্থা এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়ে পড়েছিল, তার ঢেউ ঢাকার ওপরেও পড়েছে। সে অব্যবস্থাকে একটি শৃঙ্খলার মধ্যে ফিরিয়ে আনতে এখানকার অনুগত ও ত্যাগী প্রশাসন যে পরিশ্রম দক্ষতা ও মেধার পরিচয় দিয়েছেন, তার জন্য তাদেরকে জানাই আমার শ্রদ্ধা এবং সালাম। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট তারিখে ঢাকার সরকার নিজ দেশের মধ্যে যেন পরবাসী ছিল। ভারত থেকে চলে আসা হাজার হাজার সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের এখানে মাথা গোঁজার মতাে, কোনাে স্থানেরই ব্যবস্থা ছিল না। গত বছরের (১৯৪৭) ১৫ আগস্টের আগে ঢাকা ছিল একটি মফস্বল টাউন মাত্র। সুশৃঙ্খল হয়ে উঠতে পারেনি, এমন একটি নবগঠিত প্রশাসনের নিকট বিরাট মাথা ব্যথার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল, ভারতের রেলওয়েসহ অন্যান্য প্রায় ৭০ হাজার কর্মচারীদের পরিবার পরিজনদের আশ্রয় এবং পুনর্বাসন করা। ভারত বিভক্তির কারণে সৃষ্ট গােলযােগ হুমকি এবং অনেকটা ভয়ের মুখে এসব লােকেরা কলকাতা ও ভারতের বিভিন্ন এলাকা থেকে জীবন বাঁচাবার জন্য এখানে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়।।
একইভাবে এখান থেকে হিন্দুরা পাইকারিভাবে দেশত্যাগ করার ফলে প্রশাসনে হঠাৎ শূন্যতা সৃষ্টি হয়ে যায়। প্রশাসন, যােগাযােগ এবং পরিবহন ব্যবস্থায় ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসে। এই সময়ে প্রশাসনের সবচেয়ে জরুরি কাজ হয়ে দাঁড়ায়, কত দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রশাসন ব্যবস্থাকে সংগঠিত ও সচল করে তুলে প্রদেশকে অকল্পনীয় বিশৃঙ্খলার আশঙ্কা থেকে বাঁচিয়ে তােলা। আমাদের এই নতুন প্রশাসন কঠিন পরীক্ষার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে, সীমাহীন ত্যাগ ও কষ্ট স্বীকার করে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে জাতিকে রক্ষা করেছেন। প্রশাসন সকল বাধা সরিয়ে ফেলে মানুষের জীবন যাত্রাকে স্বাভাবিক এবং সুগম রেখেছেন। আরেকটি মহাগুরুত্বপূর্ণ বিষয়, প্রশাসন কেবল নিজেদের সংগঠিত করে তুলেনি; প্রশাসনের অব্যবস্থার সুযােগে যে দুর্ভিক্ষের আশ দেখা দিয়েছিল, তাকেও মােকাবেলা করা সম্ভব হয়েছে। নতুন প্রশাসন আইন শৃঙ্খলা রক্ষা করার সুমহান দায়িত্ব সুচারুভাবে পালন করেছে।
একই সাথে এসব ব্যাপারগুলাে সমাধানের জন্য জনগণ বিপুল উৎসাহের সঙ্গে এগিয়ে এসেছেন। আপনাদেরকেও ধন্যবাদ জানাই। ধন্যবাদ এ অঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসমষ্টির প্রতি। তারা এ রাষ্ট্র গঠনে এবং পরবর্তীসময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন। উল্ল্যেখ করা প্রয়ােজন যে, ভারত বিভক্তির পরবর্তী কয়েকটি মাসে, লাগাতারভাবে, ভারতের সংখ্যালঘু মুসলমান সম্প্রদায়ের ওপর যে নারকীয় তাণ্ডব, জুলুম এবং হত্যা নেমে এসেছিল, এতসব উস্কানির মুখেও এদেশবাসীর চরম সংযমের পরিচয় দিয়েছেন। এত ভয়াবহ অবস্থা ঘটে যাওয়া সত্ত্বেও পূর্ববাংলায় এবারের পূজার সময় হিন্দু ভাইয়েরা প্রায় ৪০ হাজার মিছিল বের করেছেন। এসব মিছিলে কোনাে অশান্তির ঘটনা ঘটেনি এবং উৎসব পালনে কোনাে নির্যাতনের বা বাধার খবর আমার কাছে আসেনি।
যে কোনাে নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক আমার সাথে একমত হবেন যে, গত কয়েক মাসে সারা ভারতজুড়ে যে মহতণ্ডব যচে গেল, তার প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তানে কিছুই ঘটেনি। বরং পাকিস্তানের সংখ্যালঘুদের জানমাল নিরাপত্তায়, কঠোর নজর রাখা হয়েছিল। আপনারা নিশ্চয়ই একমত হবেন যে, পাকিস্তান আইন শৃঙ্খলা রক্ষা করতে সক্ষম। কেবল ঢাকার সংখ্যালঘুরা নয়। সারা পাকিস্তানের সংখ্যালঘুরা অনেক দেশের চেয়ে এখানে অধিক নিরাপদ এবং জীবনহানি ঘটনার কোনাে শঙ্কায় শঙ্কিত নন। আমরা যে কোনাে মূল্যে, কঠোর হাতে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখব এবং শান্তি বিঘ্নিত হতে দেবাে না। আমার সরকার কোনােরূপ গণরাজত্ব অথবা বন্য গণআদালত সৃষ্টি হতে দেবে না।
আমি আবারও একই কথা উল্লেখ করছি, সদ্য প্রতিষ্ঠিত একটি দেশে, ত্যাগ স্বীকারকারী একটি প্রশাসন গড়ে তােলা, অবশ্যাম্ভাবী দুর্ভিক্ষ এড়ানাের জন্য প্রায় ৪ কোটি মানুষের খাদ্যের সংস্থান এবং শান্তি বজায় রাখা আমার সরকারের জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জ ছিল। অনেকে প্রশাসনের এসব বিষয়কে বিবেচনায় আনতে চান। এগুলাে যে অতি সহজ সাধারণ ব্যাপার, তা ধারণা করাও মােটেই উচিত হবে। সমালােচনা অতি সহজ। দোষ বের করা আরাে সহজ। মানুষের জন্য যেসব ব্যবস্থা নেওয়া হয় জনতা অতি তাড়াতাড়ি সেসব ভুলে যায় এবং যেসব কাজ হাতে নেওয়া হবে এবং বাস্তবায়ন করা হবে তাও ভুলে যাবে। অথচ পাকিস্তানের আজাদীর সংগ্রামে আমাদেরকে কত পরীক্ষা, বিষাদ, মুসিবত এবং খুন ঝরাতে হয়েছে এবং পাকিস্তান লাভের পর গত কয়টি মাসের কঠিন সমস্যাগুলাে সমাধান করতে কী সব দিন কেটে গেছে তা কী জনতার মনে পড়ছে? মনে আছে কী?
প্রশাসনের কথা বার বার এসে যাচ্ছে। আমি জানি, আমরা যা যা আকাঙ্ক্ষা করছি তা পুরােটা বর্তমান প্রশাসন মিটাতে পারছে না অথবা এ শাসন ব্যবস্থায় অনেক খুঁত রয়ে গেছে। আমি বলি না যে, এই অবস্থাকে উন্নত করা সম্ভব নয়। এমনটাও নয় যে, একজন দেশপ্রেমিকের সমালােচনা গ্রহণ করা যাবে না। বরং সৎ সমালােচনাকারীদের প্রতি আমার আহ্বান, আপনারা আমাদের ভুল ধরিয়ে দিতে সাহায্য করুন। কিন্তু আমি যখন দেখি, কিছু কিছু মহল কেবল অভিযােগের পর অভিযােগ করে যাচ্ছেন এবং আমাদের দোষ খুঁজে বেড়াচ্ছেন; যেসব ভালাে কাজ করা হয়েছে তার সামান্য প্রশংসা বা স্বীকৃতি দিতে বড় কুণ্ঠাবোেধ করেন, তখন সরকারে যারা আছেন এবং প্রশাসনের নিবেদিত কর্মকর্তা ও কর্মচারীবৃন্দ যারা দেশের জন্য দিনরাত অক্লান্ত খেটে মরছেন তাদের মাঝে নেমে আসে গভীর হতাশা। আর এজন্য স্বাভাবিকভাবেই আমিই বেশি কষ্ট পাই।
ভাইদের বলব, আমরা যেসব ভালাে কাজ করেছি তার প্রশংসা না করতে পারুন তবে না করুন। অযথা অভিযােগ এবং সমালােচনা করে জনগণকে বিভ্রান্ত করবেন না। একটা দেশের বিরাট প্রশাসনের মধ্যে অবশ্যই ভুলত্রুটি কিছু না কিছু ঘটতে পারে বা ঘটেছে। মানুষের পক্ষে শতকরা একশত ভাগ নির্ভুল ও সুবিচারপূর্ণ প্রশাসন নিশ্চিত করা সত্যি সম্ভব নয়। এতদসত্ত্বেও আমাদের লক্ষ্য থাকবে, পাকিস্তানের প্রশাসনকে যতটা সম্ভব অন্যায় ও ত্রুটিমুক্ত রেখে সৎ, দক্ষ, গতিশীল, উপকারী এবং ন্যায় বিচারবােধ সম্পন্ন একটি কর্মচঞ্চল প্রশাসন হিসেবে গড়ে তােলা।
আপনারা প্রশ্ন করতে পারেন কীভাবে এ অবস্থা অর্জন করা যেতে পারে? হ্যা, সরকারের উদ্দেশ্যকে সামনে এনে সে ব্যবস্থা অর্জনের পথে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব। সেটা হলাে সরকার কিভাবে জনগণের সেবা করতে চায়, সরকার কী কী পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে এবং এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য কী কী কর্মসূচি হাতে নিয়েছে তা জনগণকে স্পষ্টভাবে জানিয়ে রাখতে হবে।
আপনারা জেনে রাখুন, সরকার বদলের ক্ষমতা এখন আপনাদেরই হাতে। আপনাদের যত দিন ইচ্ছা এই সরকারকে ক্ষমতায় রাখতে পারেন এবং যখনই। অপছন্দ হবে এই সরকারকে ক্ষমতা থেকে নামিয়ে দিতে পারবেন। ক্ষমতার এই পরিবর্তন অনিয়মতান্ত্রিক পথ ধরে করা যাবে না। আপনাদের হাতে যে ক্ষমতা এসেছে, সেই অধিকারকে নিয়ম মােতাবেক প্রয়ােগ করার চর্চাকে অনুশীলন করতে হবে। আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালনার এবং পরিবর্তনের নিয়মগুলাে রপ্ত করে নিতে হবে। শাসনতান্ত্রিক নিয়মের ভিত্তিতেই এক সরকারের বদলে অন্য সরকার আসবে এবং যাবে।
অতএব, সরকার বদলের ক্ষমতা এখন আপনাদের হাতে। আমি আপনাদের কাছে আকুল আরজ করবাে, আপনারা আরাে অধিক ধৈর্যের পরিচয় দিন। বর্তমানে যারা সরকারের হাল ধরে আছে তাদেরকে সমর্থন দিন। তাদের সাথী হােন। তারা যে অসুবিধা, সীমাবদ্ধতা এবং দুরবস্থার মধ্য দিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন, তার প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করুন এবং তাদের পক্ষে আপনাদের সকল সমস্যা রাতারাতি পূরণ করা যে অনেকটা অসম্ভব, সেটাও উপলব্ধি করার চেষ্টা করুন। আপনারা সহযােগিতার হাত আরাে বাড়িয়ে দিলে, আমাদের দেশের সমস্যা হবে শুধু একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে উঠার।
আমার সবিনয় প্রশ্ন এই লক্ষ জনতার কাছে, আপনারা কী আপনাদের এবং আপনাদের পূর্বপুরুষদের বহু ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত এই দেশটিকে রক্ষা করবেন নাকি আমাদের বােকামির জন্য দেশটিকে ধ্বংস করে দেবেন? আপনারা কী চান এই দেশটি সমৃদ্ধ হয়ে উঠুক? আমি জানি, আপনারা নিজ দেশের ধ্বংস চাইবেন না বরং জীবনকে বিলিয়ে দিয়ে দেশটিকে রক্ষা করবেন। এর জন্য দরকার একটি কাজের। সেটি হলাে আমাদের সকলের মধ্যে সীসার প্রাচীরের মতাে ঐক্য এবং সংহতি। আপনারা জেনে রাখুন, আমাদের প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত দেশটির মধ্যে গােলাযােগ সৃষ্টি করতে আমাদের দুশমনেরা বসে নেই। আমাদের মধ্য থেকে, আমাদের মানুষকে বেছে নিয়ে, অর্থ দিয়ে আমাদের ভবিষ্যতের সকল স্বপ্নকে ধ্বংস করে দিতে তারা ইতিমধ্যে উদ্যত হয়েছে। আমার আকুল আহবান, আপনারা এসব ষড়যন্ত্র সম্বন্ধে সতর্ক থাকেন। এদের মনভুলানাে এবং আকর্ষণীয় স্লোগানের মায়াজাল থেকে নিজেদেরকে হেফাজত করুন।
এরা বলা শুরু করেছে, পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার এবং পূর্ববাংলার প্রাদেশিক সরকার তাদের মাতৃভাষা বাংলা ধ্বংসের ষড়যন্ত্র হাতে নিয়েছে। এর চেয়ে বড় মিথ্যা আর কিছুই হতে পারে না। আমি সুস্পষ্টভাবে এবং পরিষ্কার ভাষায় বলতে চাই, আমাদের ঐতিহাসিক দুশমনদের এজেন্ট এবং অনেক কমিউনিস্ট আমাদের মাঝে ঢুকে পড়েছে। আপনারা যদি এদের ব্যাপারে সজাগ
থাকেন তবে এরাই আপনাদের ধ্বংস করে দিতে যথেষ্ট। আমি বিশ্বাস করি, ভারত থেকে পূর্ববাংলা বেরিয়ে আসাকে এরা মেনে নিতে পারেনি। এরা পূর্ববাংলাকে ভারতের সাথে মিশিয়ে দেখতে চায়। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ষড়যন্ত্রকারীরা দিবাস্বপ্ন দেখছে। পূর্ববাংলার মুসলমানরা কখনও তাদের দেশকে ভারতে মিশিয়ে নেবে না এবং মিশতে দেবে না। আমাকে জানানাে হয়েছে যে, প্রদেশ থেকে হিন্দু সম্প্রদায়ের বহুলােক দেশ ত্যাগ করেছে। ভারতের পত্রিকাগুলাে দেশত্যাগের সংখ্যাকে দশ লক্ষেরও বেশি বলে মিথ্যা সংবাদ ছাপছে। আমাদের সরকারের হিসাব মতে এই সংখ্যা বেশি করে ধরলেও দুই লাখের উপরে যাবে না। এতে আমি একটা স্বস্তিবােধ করছি এজন্য যে, সংখ্যালঘু যেসব ভাইরা দেশত্যাগ করেছেন তারা কিন্তু মূলত সংখ্যাগরিষ্ঠ সমাজের নির্যাতনের ফলে দেশত্যাগ করছেন না। আমাদের দেশের সংখ্যালঘুরা যে স্বাধীনতা এখানে ভােগ করছেন এবং নিজেদের সহায় সম্পত্তি সংরক্ষণের যে গ্যারান্টি পাচ্ছেন ঠিক একই অধিকার ভারতের সংখ্যালঘুরা পাচ্ছেন না। তাদের দেশত্যাগের কারণগুলাে তালাশ করলে দেখতে পাওয়া যাবে ভারতের সাম্প্রদায়িক ও যুদ্ধবাজ নেতাদের বেফাঁস কথাবার্তা একটি অন্যতম কারণ। তারা গুজব ছড়িয়ে দিচ্ছে পাকিস্তান ভারতের মধ্যে শীঘ্রই যুদ্ধ বেঁধে যাবে। এছাড়া ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে সংখ্যালঘুদের ওপর যে অত্যাচার এবং নির্যাতন চলছে তারা প্রতিক্রিয়া এখানেও দেখা দিবে। অমূলক এই ভয় এবং নির্যাতনের আশংকায় অনেক হিন্দু দেশত্যাগ করছেন। তাছাড়া ভারতের কতিপয় পত্রিকায় হিন্দুদেরকে, পাকিস্তান ছেড়ে আসার জন্য অবিরতভাবে লেখালেখি চলছে। এদের লেখাগুলাের মধ্যে। সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার, নির্যাতনের মনগড়া ও মিথ্যা কাহিনীকে তুলে ধরা হচ্ছে। ভারতের হিন্দু মহাসভা এদের মদদ দিয়ে যাচ্ছে। এতদ মিথ্যা প্রচারণা সত্ত্বেও এদেশে প্রায় সােয়া কোটি সংখ্যালঘু সমাজ শান্তিতে তাদের নিজ জন্মভূমিতে বসবাস করছে এবং অন্যদেশে যাওয়ার চিন্তা প্রত্যাখ্যান করছে। আমি আবার উল্লেখ করতে চাই, আমরা পাকিস্তানে সংখ্যালঘুদের ন্যায্য অধিকার ভােগ করার প্রশ্নে কোনাে শৈথিল্য বা দ্বিধার সুযােগ রাখব না। ভারতের চাইতে পাকিস্তানে সংখ্যালঘুদের জানমালের হেফাজত সুরক্ষিত রাখার প্রশ্নে আমরা কঠিন সংকল্পবদ্ধ। পাকিস্তানের আইন, শৃঙ্খলা, শান্তি এবং প্রতিটি মানুষের পূর্ণ নাগরিক অধিকার রক্ষার প্রশ্নে, আমরা কোনাে সম্প্রদায়, শ্ৰেণী এবং জাতির বিভেদকে বরদাস্ত করব না।
ভালাে বলছি কী মন্দ বলছি জানি না। সবার কাছে প্রীতিকর নাও হতে পারে। আমি কিছু নাজুক কথা এখন বলব। আমাকে জানানাে হয়েছে যে, এখানে আসা অবাঙালি মুসলমানদের বিরুদ্ধে কোনাে কোনাে মহল স্থানীয় মুসলমানদের দিয়ে, জাতিগত বিদ্বেষ ছড়ানাের পথ বেছে নিয়েছে। একই সাথে পাকিস্তান রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় কার্য পরিচালনার জন্য ভবিষ্যৎ সিদ্ধান্তের অপেক্ষাধীন, উর্দু কী বাংলা ভাষা হবে, তা নিয়ে বেশ উত্তেজনা সৃষ্টি প্রয়াস চলছে। আমি এও জানতে পারলাম যে, সুযােগ সন্ধানীরা তাদের দুরভিসন্ধিকে অর্জন করার লক্ষ্যে এবং প্রশাসনকে বিব্রত করে তােলার জন্য ঢাকার ছাত্রসমাজকে ব্যবহার করা শুরু করেছে। এই সভায় উপস্থিত আমার যুবক এবং ছাত্র বন্ধুরা, আমি তােমাদেরই একজন, যে কিনা তােমাদের জাতির ভালােবাসার এবং তােমাদের বিকশিত জীবন গড়ে তােলার আকাঙ্ক্ষায় গত দশটি বছর আরামকে হারাম করে দিয়েছি। ঈমানদারী এবং বিশ্বস্ততাকে বুকের ভিতরে চেপে ধরে জীবনের এ সময়গুলােকে ব্যয় করেছি। এরকমের একটি লােকের মুখ থেকে তােমাদেরকে সাবধান হওয়ার কথা শুনাতে চাই; তােমরা যদি কোনাে রাজনৈতিক দলের কথায় বিভ্রান্ত হয়ে পড়াে, তবে যে ভুল ঘটে যাবে, তা হয়তাে আর কোনাে দিন শােধরানাে সম্ভব হবে না। তােমরা মনে রেখ, যে দেশটি এখন আমাদের, এটি একটি বিপ্লবের ফসল। বর্তমান সরকারতাে আমাদের নিজেদের সরকার। আমরা তাে এখন আর গােলাম জাতি নই। আমরা এখন একটি স্বাধীন এবং সার্বভৌম রাষ্ট্রের মালিক। আমাদের দেশকে আমরা কীভাবে চালাব তা আমরাই ঠিক করে নেব। স্বাধীন দেশের মুক্ত নাগরিকের মতােই আমাদের আচরণ হতে হবে। কারাে রাজত্বের অধীনে বা কোনাে বিদেশী কলােনির মধ্যে আমরা এখন আর বাস করছি না। আমরা গােলামীর শিকল ছিড়ে ফেলেছি, উপড়ে ফেলেছি। আমার যুবক বন্ধুরা, আমার স্বপ্নের পাকিস্তানের তােমরাই নির্মাতা। তােমাদের কাছে আমার আকুল মিনতি, তােমরা বিভ্রান্ত হয়াে না। কারাে চক্রান্তের শিকার হয়াে না। তােমরা নিজেদের মধ্যে সুমহান ঐক্য এবং সংহতি গড়ে তোেল। যুবকরাই সকল কিছু বদলে দিতে পারে এমন নজির গড়ে তােল। তােমাদের আসল কাজ নিজেদের প্রতি সুবিচার করা। অর্থাৎ নিজেদেরকে যােগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তােলা। পিতামাতাকে সম্মান করা আর স্বদেশ, স্বজাতির কল্যাণে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারের জন্য নিজেদের প্রস্তুত করে রাখা। তােমরা যদি শিক্ষায়, গভীরভাবে মনােনিবেশ করতে পার তবে দেশ শিক্ষিত হয়ে উঠবে। শিক্ষিত দেশই কেবল শক্তিশালী দেশ হতে পারে। আমি তােমাদেরকে লেখাপড়ায় মনােযােগ দেওয়ার জন্য আকুল আহ্বান জানিয়ে গেলাম। তােমাদের শক্তি, প্রতিভাকে যদি অপচয় করে ফেলে তাহলে তােমরাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং গভীর মনস্তাপে সারাটা জীবন দুঃখময় হয়ে যাবে। তােমরা কলেজ ইউনিভার্সিটির পড়াশুনা শেষ করে, পূর্ণ বিবেচনা করার শক্তির অধিকারী হয়ে, দেশকে গড়ে তােলার জন্য সত্যিকারের অবদান রাখতে সক্ষম হবে। এতগুলাে কথার মধ্য দিয়ে, আমি তােমাদেরকে পুনরায় হুশিয়ার করে জানিয়ে রাখতেই চাই পাকিস্তান এবং পূর্ববাংলার যে বিপদসমূহের কথা আগে বলেছি, তা আমাদের উপর থেকে এখনও কেটে যায়নি। আমাদের ঐতিহাসিক দুশমনেরা পাকিস্তান সৃষ্টির বিরুদ্ধে শত চেষ্টা করে বিফল হয়েছে। তারা এখনও বসে নেই। এখন তারা তাদের কৌশল বদলিয়েছে। তারা এখন আমাদের দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির পাঁয়তারা খুঁজছে। আর তারা ভালাে করেই জানে, আমাদের মধ্যে প্রাদেশিকতা, আঞ্চলিকতা জাগিয়ে তুলতে পারলে, আমরা বিভক্ত হয়ে যাব এবং তাদের উদ্দেশ্য চরিতার্থ হবে। আর আমরা যতক্ষণ না আঞ্চলিকতা এবং প্রাদেশিকতাকে আমাদের মন থেকে, চিন্তা থেকে এবং রাজনীতি থেকে ছুঁড়ে ফেলতে না পারব, ততদিন পর্যন্ত আমরা একটি শক্তিশালী ও আধুনিক রাষ্ট্রের জন্য নিজেদেরকে প্রস্তুত এবং গড়ে তুলতে পারব না। আমরা কী এই পরিচয়ে পাকিস্তান করেছি যে, আমরা বাঙালি, পাঞ্জাবি, সিন্ধি, বেলুচি, পাঠান, ইত্যাদি, ইত্যাদি। এগুলাে অবশ্যই আমাদের জাতিসত্তার এক একটি ইউনিট। আমি আপনাদের কাছে জিজ্ঞেস করতে চাই তেরশত বছর আগে আমাদের কাছে যে হেদায়েত এসেছে, সে কথা কী আমরা ভুলে গেছি।
– আমি ইতিহাসের সত্য কথাটি বলতে চাই, এই পাকিস্তানে আমরা যে যেখানেই বাস করছি, আমরা সকলেই বহিরাগত। এই বাংলায় যারা বাস করছেন, তারা কেউই এখানের আদি অধিবাসী নন। সুতরাং আমরা বাঙালি, আমরা পাঠান, আমরা পাঞ্জাবি বলে কী লাভ? আমাদের সকলের প্রথম পরিচয় আমরা মুসলমান।
ইসলাম আমাদেরকে এই কথাই শিক্ষা দিয়েছে। আমি মনে করি তােমরা আমার সাথে একমত হবে যে, আগে আমরা কি ছিলাম বা না ছিলাম, কিভাবে এখানে আসলাম, এসবের প্রাসঙ্গিকতার চেয়ে, বর্তমানে আমাদের প্রধান পরিচয় আমরা মুসলিম। প্রিয় ছাত্রবন্ধুরা, তােমাদের একটি স্বাধীন দেশ হয়েছে। এটা ছােট্ট একফালি জমির দেশ নয়। এখন একটি বিরাট ভূখণ্ড তােমাদের হয়েছে, এই ভূখণ্ডটির মালিক কোনাে পাঞ্জাবির, কোনাে সিন্ধির, কোনাে বেলুচির, কোনাে পাঠানের বা কোনাে বাঙালির নয়। এটি আমাদের, তােমাদের সবার। তােমরা একটা কেন্দ্রীয় সরকার পেয়েছ, যেখানে সকল ইউনিটের প্রতিনিধি রয়েছে। তাই বলতে চাই, তােমরা যদি একটি শ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে দুনিয়ার বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে চাও, তবে আল্লাহর কসম দিয়ে তােমাদের কাছে আরজ করছি, তােমরা প্রাদেশিক হিংসা, আঞ্চলিক ক্ষুদ্রতাকে ঝেড়ে ফেলে দাও। আঞ্চলিকতা এবং প্রাদেশিকতা আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় অভিশাপ। বিভেদের আরাে যেসব রয়েছে, শিয়া-সুন্নী দ্বন্দ্ব এসবকেও দূরে সরিয়ে রাখ।
এ ধরনের বিরাজিত অবস্থা নিয়ে, পরাধীন আমলের সরকারগুলাের মাথা ব্যথা ছিল না। তারা এরূপ অবস্থায় অস্বস্তিবােধ করত না। তাদের লক্ষ্য ছিল বাণিজ্যের দিকে। ভারতবর্ষকে যেভাবে এবং যতভাবে শােষণ করা যায় তাকে নিরুপদ্রব রাখতেই আইন-শৃঙ্খলার প্রতি নজর রাখত। এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটে গেছে। আপনাদেরকে একটা উদাহরণ দিচ্ছি, বর্তমান আমেরিকার কথা ধরুন, তারা যখন ব্রিটিশদের তাদের দেশ থেকে বের করে দিয়ে নিজেরা স্বাধীনতা ঘােষণা করল, তখন তাদের দেশে এত জাতি-গােষ্ঠী ছিল যার বর্ণনার শেষ করা যাবে না। স্পেনিশ, ফরাসি, জার্মান, ইতালিয়ান, ইংরেজ, ওলন্দাজ, ইত্যাদি ইত্যাদি। এদের নিজেদের ভিতর জাতিগত সমস্যা ছাড়াও শত সমস্যা নিয়ে তারা সেখানে বাস করত। লক্ষ্য করুন, এতসব নিজেদের সমস্যাকে কাটিয়ে পৃথিবীর একটি শক্তিশালী জাতিতে পরিণত হয়েছে। আর আমাদের ভিতর এ ধরনের কোনাে জটিল সমস্যার অস্তিত্বই নেই। তাছাড়া, আমরা সবেমাত্র পাকিস্তান হাসিল করেছি। মনে করুন, আমেরিকায় ফরাসি বংশােদ্ভূত কেউ একজন যদি বলে, আমি একজন ফরাসীয়। আমি পৃথিবীর অন্যতম এক শ্রেষ্ঠ জাতির সদস্য। আমার এই এই গৌরব রয়েছে। অন্যরাও যদি অনুরূপ কথা বলত, তাহলে পরিস্থিতি বা কী দাঁড়াত? তাদের মধ্যে তাদের নিজেদের সমস্যা উপলব্ধি করার যথেষ্ট শক্তি এবং এর ফলে অতি অল্প সময়ে তারা, তাদের ভিতরকার সমস্যাগুলাে মিটিয়ে ফেলতে সক্ষম হয়েছে এবং স্ব-স্ব জাতি, গােষ্ঠীর বিভেদের দেওয়ালকে সরিয়ে ফেলতে পেরেছে। তারা নিজেদের জার্মান, ফরাসি, ইরেজ, স্পেনিশ পরিচয় মুছে দিয়ে আমেরিকান হিসেবে পরিচয় দিতে কোনাে কুণ্ঠাবােধ করেনি। তাদের ভিতর নিজ দেশের জাতিগত চেতনা, এত শক্তিশালী হয়েছে যে, তারা এখন গর্বভরে বলে থাকে আমি একজন আমেরিকান অথবা আমরা আমেরিকান। সুতরাং এরকম করেই কী আমরা নিজেদের চিন্তা করতে পারি না? আমরা সবাই কী আমাদের দেশ পাকিস্তান, আমি, আপনি এবং আমরা সবাই পাকিস্তানি, এই ধারণাকে আমাদের হৃদয়ের ভিতরে প্রবেশ করিয়ে দিতে পারি না? আমি আবারও আপনাদের কাছে অনুরােধ করে যাচ্ছি আপনারা প্রাদেশিকতা এবং আঞ্চলিকতা থেকে নিজেদের মুক্ত করে ফেলুন। পাকিস্তানের রাষ্ট্র ব্যবস্থা বা রাজনীতিতে যদি প্রাদেশিকতার বিষ ঢুকে যায়, আপনারা কখনও শক্তিশালী জাতিতে পরিণত হবেন না। পাকিস্তানকে একটি সমৃদ্ধ রাষ্ট্রে পরিণত করার যে সংকল্প পােষণ করি, তা অর্জিত হবে না। আপনারা মনে করবেন না, আমি আপনাদের পরিচয়ের অমর্যাদা করছি। এরকম অবস্থার মধ্য দিয়েই ধ্বংসকামী দুষ্টচক্র জন্ম নেওয়ার সুযােগ পেয়ে যায়। এরা এভাবে বলে থাকে পাঞ্জাবিরা বড় অহঙ্কারী আবার অবাঙালি বা পাঞ্জাবিরা বলে থাকবে বাঙালিরা এমন, এমন। এরা আমাদের পছন্দ করে না, তারা আমাদেরকে এদেশ থেকে বের করে দিতে চায়। এরকমের পরিস্থিতি সৃষ্টি করাই দুশমনদের কৌশল এবং চক্রান্তের বিষাক্ত জাল। এ ধরনের অবিশ্বাস ও সন্দেহ আমাদের মধ্যে সৃষ্টি হয়ে গেলে সেটা সমাধান করা কারাে পক্ষে সম্ভব হবে বলে, আমার মনে হয় না। দেশপ্রেমিক ভাইদের প্রতি আহবান জানাই, এসবের প্রতি ভ্রুক্ষেপ করবেন না।
ভাষাকে ইস্যু করে, যা কিনা আমি আগেও বললাম, মুসলমানদের মধ্যে একটা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির পাঁয়তারা চলছে। আপনাদের প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি যে বিবৃতি দিয়েছেন তাতে আমি সন্তুষ্ট। তিনি বলেছেন, এ বিষয়কে ইস্যু করে কোনাে নৈরাজ্যবাদী রাজনৈতিক মহল, দুশমনদের অর্থপুষ্ট কোনাে এজেন্ট যদি প্রদেশের শান্তি-শৃংখলা বা উন্নতিকে ব্যাহত করার অপচেষ্টা চালায় তবে তা কঠোর হাতে দমনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এই প্রদেশের অফিসিয়াল ভাষা যদি বাংলা করতে হয় তবে এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সম্পূর্ণ এক্তিয়ার নির্বাচিত প্রাদেশিক পরিষদের প্রতিনিধিদের রয়েছে। এবং তারাই তা নির্ধারণ করবেন। আমি বিশ্বাস করি, এই সমস্যার সমাধান অবশ্যই এই প্রদেশের অধিবাসীদের আশা-আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী যথা সময়ে নিষ্পত্তি ঘটবে। আমি পরিষ্কার ভাষায় একথা আপনাদের জানিয়ে রাখতে চাই, বাংলা ভাষার প্রশ্ন নিয়ে এই প্রদেশবাসীর দৈনন্দিন জীবনযাপনে, চাকরি-করিতে কোনােরূপ হতাশা, উদ্বেগ বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির কারণ ঘটবে না। আবারও বলছি এ প্রদেশের অধিবাসীরাই তাদের প্রাদেশিক ভাষা যথা সময়ে নির্ধারণ করে নিতে পারবেন। কিন্তু, আমি আপনাদের কাছে এ কথাট পরিষ্কার করে জানিয়ে রাখতে চাই, নিখিল পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা উর্দু হতে হবে। কোনাে প্রাদেশিক ভাষা রাষ্ট্র ভাষা হতে পারে না। আর এ ব্যাপারে আপনাদেরকে যারা বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করবে তারা অবশ্যই পাকিস্তানের জানি দুশমন। রাষ্ট্রের যদি একটি রাষ্ট্রে ভাষা না করা যায়, তাহলে সে রাষ্ট্রটিকে একটি শক্তিশালী ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ করা যাবে না। পৃথিবীর ইতিহাস এবং বড় বড় দেশগুলাের দিকে আপনাদের তাকাতে বলব। সেসব দেশসমূহে রাষ্ট্রভাষা কয়টি এবং অধিকাংশের বােধগম্য ভাষাটিকে কী রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে নির্বাচন করা হয়নি? সুতরাং, পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা উর্দুই হওয়া দরকার। কিন্তু রাষ্ট্রভাষার বিষয়টিও এ মুহূর্তের কোনাে বিষয় নয়। সময়ের প্রয়ােজনের সাথে মিলিয়ে, রাষ্ট্র ভাষার বিষয়টির সুরাহা করা হবে।
বক্তৃতায় আমি বারবার যে কথা বলছি, তা হলাে, প্রিয় দেশবাসী আপনারা পাকিস্তানের দুশমনদের মিষ্টি কথার ফাঁদে পা দিবেন না। এসব দুশমনরা স্বদেশের এবং স্বজাতির বিরুদ্ধে কাজ করছে। এরা পঞ্চম বাহিনী। আমি দুঃখিত এবং ব্যথিত যে, এদের পরিচয় রয়েছে মুসলিম নাম। আমার এসব ভাইয়েরা সর্বনাশা ভুলের পথে পা বাড়িয়েছে।
আমরা কোনাে দেশদ্রোহমূলক তৎপরতাকে বরদাশত করব না। আমরা পাকিস্তানের দুশমনদের সহ্য করব না। আমাদের দেশে কোনাে বিশ্বাসঘাতকদের দেখতে চাই না। এসব পঞ্চম বাহিনীর সদস্যরা তাদের অপতৎপরতা এখনই বন্ধ করলে, আমার বিশ্বাস প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় সরকার এসব নাশকতামূলক কাজ বন্ধ করতে কঠিন পথ বেছে নিবে। এরা জাতির জন্য বিষ।
আমি ভিন্নমত পােষণ করার অধিকারের বিষয়টি বুঝি এবং মানি। এদিক ওদিকে কেউ কেউ বলছেন, আমাদেরকে কোনাে একটি মাত্র পার্টিতে থাকতে হবে? অন্যটিতে নয় কেন? এ ব্যাপারে আমার মন্তব্য হলাে এবং আশা করছি আপনারাও একমত হবেন যে, আমাদের অক্লান্ত মেহনত এবং সংগ্রামের ফসল হিসেবে, সবেমাত্র ৭ মাস হলাে আমরা পাকিস্তানকে হাসিল করেছি। আর মুসলিম লীগের মাধ্যমেই এই অসাধ্য সাধন হয়েছে। এদেশের অনেক মুসলমানের কথা বলব, তারা আমাদের আন্দোলনের ব্যাপারে উৎসাহীততা নয়ই বরং অনেক ক্ষেত্রে বিরােধিতা করেছেন বা উদাসীন ছিলেন। কেউ কেউ ভীত ছিলেন যে, পাকিস্তান হয়ে গেলে, তারা সে সময়ে যে সুযােগ-সুবিধা বা কায়েমী স্বার্থ ভােগ করছিলেন, সেগুলােকে হারিয়ে ফেলবেন। এদের অনেকে আমাদের শত্রুদের সাথে হাত মিলিয়ে আমাদের বিরুদ্ধে তৎপর ছিলেন। আল্লাহর অসীম মেহেরবানীতে সকল ষড়যন্ত্র, ক্রোধ এবং বিরােধিতার বিরুদ্ধে প্রাণপণ সংগ্রাম করে আমরা পাকিস্তানকে অর্জন করে এনেছি। সারা দুনিয়া অবাক বিস্ময়ে আমাদের এই ঐতিহাসিক ঘটনাকে প্রত্যক্ষ করেছে। এজন্য মুসলিম লীগ আমাদের কাছে একটি পবিত্র আমানত। দেশবাসীর কল্যাণের লক্ষ্যে এবং দেশকে রক্ষা করার অতন্দ্রপ্রহরী হিসেবে আমাদের এই বিশ্বস্ত দলটিকে সুসংগঠিত করা দরকার নয় কী? নাকি হঠাৎ গজিয়ে উঠা দলসমূহ, যাদের নেতৃত্বে রয়েছে এমন সব লােকজন যাদের অতীত নিয়ে প্রশ্ন তােলা যায়। তাদের হাতে পাকিস্তানের নেতৃত্ব তুলে দিলে তারা বহু ত্যাগের বিনিময়ে পাওয়া দেশটির বিনাশ ঘটাবে না তার কি কোনাে গ্যারান্টি আছে?
সমবেত জনতা, আমি আপনাদের প্রশ্ন করতে চাই আপনারা কি পাকিস্তান টিকে থাকুক তা চান কিনা? (জনতা উত্তর দিল চাই) আপনারা পাকিস্তান অর্জন করেছেন তার জন্য কি বেজার না খুশি। (জনতার উত্তর খুশি খুশি) আপনারা পাকিস্তানের অংশ স্বাধীন পূর্ববাংলা ইন্ডিয়ার সাথে মিশে যাবে তা কি চান? (জনতার উত্তর না না)। আমি আশ্বস্ত হলাম। আমি খুশি হলাম। আপনারা তাহলে পাকিস্তানকে গড়ে তােলার জেহাদে নেমে পড়ন। পাকিস্তানকে গড়ে তুলতে সমৃদ্ধ করে তুলতে এ সময়ের দাবি হলাে আপনারা মুসলিম লীগে শরীক হােন এবং দেশের খেদমতে নেমে পড়ন। নতুন গড়ে ওঠা দলগুলাের নেতাদের অতীতকে জানুন। এই মুহূর্তে আমাদের বিভক্ত হওয়া উচিত হবে না। আমি এসব দল সমূহের বিরুদ্ধে কোনাে মনােভাব পােষণ করি না বা হাসি ফুটিয়ে তােলার জন্য আপনাদের আরাে যদি দুঃখ, কষ্ট ও পরিশ্রম করতে হয় এমনকি জীবন কোরবানী দিতে হয় এসবের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। আমার এ দাবিটি জানিয়ে বক্তৃতা শেষ করতে চাই। একটা জাতির কল্যাণের জন্য একটা দেশকে গড়ে তােলার পেছনে আপনাদের মেহনত বৃথা যাবে না। এই পথ বেয়েই আমরা পৃথিবীতে এক শক্তিশালী রাষ্ট্র এবং সম্মানিত জাতি হিসেবে নিজেদের পরিচয় তুলে ধরতে পারব। শুধু জনসংখ্যার হিসেবে পৃথিবীর পঞ্চম বৃহত্তম দেশ হয়ে থাকতে চাই না, শক্তি সমৃদ্ধির সাথেই আমরা পৃথিবীর অন্যান্য দেশ এবং জাতিগুলাে থেকে শ্রদ্ধা সম্মান অর্জন করে নিতে চাই। এ কথাগুলাে বলেই আমি মহান আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি এবং আমাদের তৌফিক দানের জন্য মুনাজাত করছি।’
১৯৪৮ সালের ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ সমাবর্তন সভায় বক্তৃতার সময়ও মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে আবারাে একই মত প্রকাশ করেন।
তার এ ঘােষণা জনমনে নিদারুণ হতাশার সৃষ্টি করে। ভাষা সংগ্রামীদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ দেখা দেয়।
জিন্নাহর এ বক্তৃতার প্রতিক্রিয়ায় এ. কে ফজলুল হক জিন্নাহ্র কঠোর সমালােচনা করে ২৫ মার্চ পত্রিকায় একটি বিবৃতি দেন।
১৯৪৮ সালের ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ সমাবর্তন সভায় বক্তৃতায় মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ বিবৃতি সম্পর্কে তিনি বলেন- ‘কায়েদে আযম উর্দুকে পাকিস্তানের সরকারি ভাষা বলিয়া ঘােষণা করিয়াছেন, ইহা প্রতিহিংসামূলক, স্বৈরাচার। সরকারি ভাষা কি হইবে তাহা ঘােষণা করা গভর্নর জেনারেলের কাজ নহে। জনসাধারণ তাহা স্থির করিবে।
বাংলার সমবেত জনগণের কাছে জিন্নাহ এর ভাষণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা প্রসঙ্গে। উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার যুক্তি দেওয়ার চেষ্টায় তিনি বলেন, আমি সুস্পষ্ট ভাষায় আপনাদের জানাতে চাই যে, আপনাদের দৈনন্দিন জীবনের ক্ষেত্রে বাংলাভাষার ব্যবহার নিয়ে কোনাে রকম প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হবে এক কথার মধ্যে কোনাে সত্যতা নেই। কিন্তু আপনারা, এই প্রদেশের অধিবাসীরাই চূড়ান্তভাবে স্থির করবেন, আপনাদের প্রদেশের ভাষা কি হবে। কিন্তু এ কথা আপনাদেরকে পরিষ্কারভাবে বলে দেওয়া দরকার যে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু, অন্য কোনাে ভাষা নয়। এ ব্যাপারে যদি কেউ আপনারদেরকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে তাহলে বুঝতে হবে সে হচ্ছে রাষ্ট্রের শত্রু। একটিমাত্র রাষ্ট্রভাষা ছাড়া কোনাে জাতিই এক সূত্রে প্রথিত হয়ে কার্যনির্বাহ করতে পারে না। অন্য দেশের ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে দেখুন। অতপর পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু।
সমাবর্তন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে তিনি বলেন, আমি রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে আমার বক্তব্য আবার বলছি। এই প্রদেশের সরকারি কাজের জন্য এই প্রদেশের লােকেরা নিজেদের ইচ্ছামতাে যে কোনাে ভাষা ব্যবহার করতে পারে। যথাসময়ে এবং এই প্রদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সুচিন্তিত মতামতের মাধ্যমে তাদের ইচ্ছানুসারেই এই প্রশ্নের মীমাংসা হবে। কিন্তু রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রদেশের যােগাযােগের ভাষা হিসেবে একটি ভাষা থাকবে এবং যে ভাষা হবে উর্দু, অন্য কোনাে ভাষা নয়।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের ছাত্র শিক্ষকদের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে জিন্নাহর এই ঘােষণার তীব্র প্রতিবাদ ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে, ছাত্রদের মধ্য থেকে নাে, নাে, ধ্বনি উঠতে থাকে। ছাত্রনেতা আবুদল মতিন এবং আহসানের কণ্ঠের ননা, নাে, ধ্বনি উপস্থিত ছাত্রদের কণ্ঠে কণ্ঠে ধ্বনিত হয়ে বিরাট এক হট্টগােলের সৃষ্টি হয়। জাতির জনকের কথার প্রতিবাদ উঠতে পারে বা প্রতিবাদ করার কেউ সাহস দেখতে পারে এটা সরকারি আমলাদের নয় জিন্নাহর কাছেও বিস্ময়ের সৃষ্টি করে। চরম হট্টগােলের মধ্যে তিনি বক্তৃতা দীর্ঘায়িত না করে দ্রুত বক্তৃতা শেষ করে কার্জন হল ত্যাগ করেন। ২৫ মার্চ দৈনিক আজাদ পত্রিকায় কায়েদে আযমের বক্তৃতার সমালােচনা করে এক বিবৃতি প্রকাশ হয়; এতে বলা হয় : ‘ইহা তাহার (জিন্নাহ) ন্যায় ব্যক্তির পক্ষে শােভন হয় নাই। … তিনি দুর্ভিক্ষের সময় কিংবা সাম্প্রদায়িক হত্যাকাণ্ডের সময় এখানে আসেন নাই। এখন কেন আসিয়াছেন? সরকারি কর্মচারীগণ কায়েদে আযমকে ভুল সংবাদ দিয়াছে? তাহার ফলে তিনি ভিত্তিহীন বিবৃতি প্রকাশ করিয়াছেন। এবং বর্তমান মন্ত্রিসভার কার্যকারিতার উচ্চ প্রশংসা করিয়াছেন। কায়েদে আযম বর্তমান মন্ত্রিসভাকে যে সার্টিফিকেট দিয়াছেন তাহা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।
.. কায়েদে আযম কুইসলিং, পঞ্চম বাহিনী ও রাষ্ট্রে শত্রুগণের বিরুদ্ধে বজ্রনির্ঘোষে সতর্কবাণী উচ্চারণ করিয়াছেন। কিন্তু পাকিস্তানে তাহাদের কোনাে অস্তিত্ব নাই। মন্ত্রীগণ জনসাধারণের আস্থা হারাইয়াছেন। মন্ত্রীগণ পাকিস্তানে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের অবসানের জন্য কিছুই করে নাই, পাকিস্তানের আদালতের ভাষারূপে অবিলম্বে বাংলা ভাষার প্রবর্তন করিতে ব্যর্থকাম হইয়াছে এবং মাদ্রাসার শিক্ষাব্যবস্থার অবহেলা করিয়াছে। অথচ আশ্চর্যের বিষয়, মন্ত্রিসভার অপদার্থতা সত্ত্বেও কায়েদে আযম তাঁহাদিগকে উপযুক্ত বলিয়া সার্টিফিকেট দিয়াছেন।’
সকালে কার্জন হলের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে কায়েদে আযমের উত্তেজিত বক্তৃতা প্রদানের পর অপরাহ্নে তিনি রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দের সাথে সাক্ষাত এবং কথা বলার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। সেইমতাে, সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের আমন্ত্রণ জানান হয়। – ২৪ মার্চ বিকেলে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সর্বজনাব শামসুল হক, নঈমুদ্দীন আহমদ, কামরুদ্দিন আহমদ, আজিজ আহমদ, শামসুল আলম, তাজুদ্দিন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, অধ্যাপক আবুল কাসেম, মাে. তােয়াহা অলি আহাদ, লিপি খান জাতির জনকের সঙ্গে আজিজ আহমদের বাসভবনে এক বৈঠকে মিলিত হন।
আলােচনার শুরুতেই কায়েদে আযম মন্তব্য করেন যে, একাধিক রাষ্ট্রভাষা রাষ্ট্রীয় সংহতির পক্ষে ক্ষতিকর।
এর জবাবে কামরুদ্দিন আহমদ বলেন যে, সুইজারল্যান্ড, কানাডায় একাধিক রাষ্ট্রভাষা জাতীয় সংহতি বৃদ্ধি করিয়াছে।।
জিন্নাহ অসহিষ্ণু কণ্ঠে বলেন, আমাকে ইতিহাস শিখাইতে হইবে না। ইতিহাস আমি জানি। তিনি আরাে বললেন পাকিস্তানের সংহতির খাতিরে প্রয়ােজনে তােমাদিগকে মাতৃভাষা পরিবর্তন করিতে হইবে।
তার এই দাম্ভিক উক্তি আলােচনা করতে আসা সংগ্রাম কমিটির সদস্যদিগকে বিমূঢ় আর হতবাক করে ফেলল। তারা এর আগে কায়েদে আযমকে চোখে দেখেন নাই। তবু পাকিস্তান আন্দোনের মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ সমস্ত পদক্ষেপকে অক্ষরে অক্ষরে পালন করার জন্য রাত-দিন পরিশ্রম করেছেন। মুসলিম লীগের পতাকাতলে কাতারবন্দি থেকেছেন। বাঙালি ছেলেরা পাকিস্তানের জনকের সঙ্গে কথা বলছেন। স্বাভাবিকভাবেই তারা কিছুটা সংকুচিত ছিলেন কিন্তু জিন্নাহর কথায় এবং আচরণে সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের ভেতর প্রেরণা ফিরে আসে। অলি আহাদ জিন্নাহর কথার উত্তরে বলেন, “স্যার, ব্রিটেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড একই ভাষা, একই ধর্ম, একই বংশােদ্ভূত হওয়া সত্ত্বেও তাহারা একই রাষ্ট্র গঠন করিতে সক্ষম হইয়াছে কি? একই ধর্ম ইসলাম, একই ভাষা আরবি, একই সেমেটিক রক্ত ও একই আরব ভূমি সত্ত্বেও আরব জগতে এতগুলাে রাষ্ট্রের অস্থিত্ব কেন?”
রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সদস্যদের সাথে মােহাম্মদ আলী জিন্নাহর এই আলােচনা কোনাে ফলপ্রসূ সিদ্ধান্ত ছাড়াই শেষ হয়। তবে সভা শেষে সংগ্রাম পরিষদের সদস্যরা কায়েদে আযমকে ইংরেজিতে লেখা একটি স্মারকলিপি প্রদান। করেন। স্মারকলিপিতে নিম্নলিখিত কথাগুলাে লিপিবদ্ধ হয়: (বঙ্গানুবাদ)
‘সংগ্রাম পরিষদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য সংগঠনের মুসলমান যুবকদের দ্বারাই গঠিত। সংগ্রাম পরিষদের মত বঙ্গ ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম। রাষ্ট্রভাষা করা হউক।
কারণ, প্রথমত উহা পাকিস্তানের লােক সংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশের ভাষা ও পাকিস্তান জনগণের রাষ্ট্র বিধায় সংখ্যাগুরু অধিবাসীর দাবি গ্রহণ করা বিধেয়।
দ্বিতীয়ত আধুনিককালে কোনাে কোনাে রাষ্ট্র একাধিক রাষ্ট্রভাষা গ্রহণ করিয়াছে। উদাহরণ স্বরূপ-নিম্নোক্ত কয়টি দেশের নাম উল্লেখ করা যায়: বেলজিয়াম (প্লমিং ও ফরাসি ভাষা), কানাডা (ইংরেজি ও ফরাসি ভাষা), সুইজারল্যান্ড (ফরাসি, জার্মান ও ইতালির ভাষা), দক্ষিণ আফ্রিকা (ইংরেজি ও আফ্রিকান ভাষা), মিসর (ফরাসি ও আরবি ভাষা), থাইল্যান্ড (থাই ও ইংরেজিভাষা); ইহা ছাড়াও সােভিয়েট রাশিয়ায় ১৭টি রাষ্ট্রভাষা চালু রহিয়াছে।
তৃতীয়ত সম্পদের দিক হইতে বাংলাভাষা পৃথিবীতে সপ্তম ভাষারূপে স্বীকৃত বিধায় এই রাষ্ট্রে একমাত্র বাংলা ভাষা অন্যান্য প্রাদেশিক ভাষার তুলনায় রাষ্ট্র ভাষা। হওয়ার উপযুক্ত।
চতুর্থত আলাওল, নজরুল ইসলাম, কায়কোবাদ, সৈয়দ ইমদাদ আলী, ওয়াজেদ আলী ও আরাে অনেক মুসলিম কবি ও সাহিত্যিক তাঁহাদের রচনা সম্ভারে বাংলা ভাষাকে সম্পদশালী করিয়াছেন।
পঞ্চমত বাংলার সুলতান হােসেন শাহ সংস্কৃত ভাষার প্রতিদ্বন্দ্বিতা সত্ত্বেও উক্ত ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা করিয়াছিলেন। এই ভাষার শব্দ সম্ভারের শতকরা ৫০ ভাগ। আরবি ও ফরাসি ভাষা হইতে উদ্ভূত।
পরিশেষে আমরা পেশ করিতে চাই যে, যে কোনাে পূর্ণ গণতান্ত্রিক দেশে প্রত্যেক নাগরিকের কতগুলাে মৌলিক অধিকার আছে। সুতরাং আমাদের অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত না হওয়া অবধি বঙ্গভাষার আন্দোলন চলিতে থাকিবে।
কিন্তু জিন্নাহর ঢাকা ত্যাগের পর ছাত্রদের এই আন্দোলনের শপথ বেশি দিন ধরে রাখতে পারেন নাই। কারণ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সদস্যদের সঙ্গে কয়েকদফা আলােচনার মাধ্যমে জিন্নাহ্ ভাষার এই আন্দোলনকে নস্যাৎ করার কৌশল বুঝে নিয়েছিলেন। তিনি তাঁর চলমান উদ্বুদ্ধ জনপ্রিয়তা, সাধারণ জনগণের অপরিসীম শ্রদ্ধা ও বিশ্বাসকে কাজে লাগাতে তৎপর হলেন। ভাষার প্রশ্নে তিনি। দৃঢ়তার সাথে তার সিদ্ধান্তে অনড় থাকলেন, আন্দোলনকারীদের শান্ত করার কৌশল হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানের ব্যবস্থাপক সভার মুসলিম লীগ দলীয় যেসব সদস্য বাঙালি জাতীয়তাবােধে উদ্বুদ্ধ হয়ে ভাষা আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন তাদের মধ্য থেকে কাউকে কাউকে সরকারি চাকরি দিয়ে এবং মন্ত্রীত্ব দিয়ে সরকার সমার্থকে ফিরিয়ে আনেন। যেমন, সােহরাওয়ার্দী গ্রুপের মােহাম্মদ আলী চৌধুরীকে ব্রাহ্মদেশে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত করা হলাে। হবীবুল্লাহ বাহার চৌধুরী, তােফাজ্জল আলী ও ডা. আবদুল মােত্তালেব মালিককে প্রাদেশিক সরকারের অর্থাৎ নাজিমুদ্দিনের মন্ত্রিসভায় মন্ত্রীত্ব দেয়া হলাে। এতে করে এনারা যারা উচ্চ পর্যায়ের মানুষজন ভাষা আন্দোলকে সমর্থন জানাতেন তারা আন্দোলনের সাথে তাদের সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করেন।
উচ্চ পর্যায়ের নেতাদের সমর্থন হারিয়ে ছাত্র নেতারাও হতােদ্যম হয়ে পড়েন। ছাত্ররাও নিজেদের পড়াশােনার প্রতি মনােযােগী হয়ে ওঠেন। ফলে আস্তে আস্তে এ সময় আন্দোলন স্তিমিত হয়ে আসে। তবে তা ছিল সাময়িক।
রাষ্ট্রভাষা উর্দুর প্রতি জাতির পিতার দৃঢ় প্রত্যয় ও সমর্থন দেখে পূর্ববাংলার মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সাথে সম্পাদিত চুক্তির সকল শর্ত একে একে ভঙ্গ করতে শুরু করলেন। জিন্নাহ প্রদর্শিত পথে তিনিও রাষ্ট্রভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠার দাবিকে নস্যাৎ করার জন্য কুশলী পদক্ষেপ নিতে লাগলেন।
খাজা নাজিমুদ্দিন ১৫ মার্চের স্বাক্ষরিত ৮ দফা চুক্তির ৩ দফা চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করে ১৯৪৮ সালের ৬ এপ্রিল পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদে বাংলাকে পূর্ববঙ্গের সরকারি ভাষা ও শিক্ষার মাধ্যম করার এক নতুন প্রস্তাব উত্থাপন করেন। ৮ এপ্রিল প্রস্তাব ২টি পাস করেন।
(ক) পূর্ববঙ্গ প্রদেশে ইংরেজির স্থলে বাংলাকে সরকারি ভাষারূপে গ্রহণ করা হইবে এবং যতশীঘ্র সম্ভব বাস্তব অসুবিধাগুলাে অপসারণ করা যায় ততশীঘ্র তাহা কার্যকর করা হইবে।
(খ) পূর্ববঙ্গের শিক্ষায়তনসমূহের শিক্ষার মাধ্যম যথা সম্ভব বঙ্গভাষা হইবে, কেননা ইহা অধিকাংশ বিদ্যার্থীর মাতৃভাষা।
ভাষা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে এই ছলচাতুরী চলাকালীন পাকিস্তান সৃষ্টির মাত্র এক বছর পর ১১ সেপ্টেম্বর ১৯৪৮ পাকিস্তানের জনক কায়েদে আযম মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ পরলােকগমন করলে সারা পাকিস্তানে শােকের ছায়া নেমে আসে। ফলে সরকারবিরােধী সকল কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ে। মােহাম্মদ আলী জিন্নাহর মৃত্যুর পর পূর্ববঙ্গের উজীরে আলা খাজা নাজিমুদ্দিন পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল পদে অভিষিক্ত হলেন। নওয়াবজাদা লিয়াকত আলী খান হলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। ক্ষমতা গ্রহণের পর প্রধানমন্ত্রী নওয়াবজাদা লিয়াকত আলী খান ১৯৪৮ সালের ১৮ নভেম্বর পূর্ববাংলা সফরে আসেন। লিয়াকত আলী খান ঢাকায় আগমনকালে ঢাকা কলেজ, ইডেন কলেজ, এবং কামরুন্নেসা স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের বিভিন্ন-দাবির আন্দোলন চলছিল। ছাত্ররা প্রধানমন্ত্রীকে কালাে পতাকা প্রদর্শনের সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. সৈয়দ মােয়াজ্জেম হােসেনের মধ্যস্থতায় তা প্রত্যাহার করা হয়। এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীকে মানপত্র দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
২৭ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিমন্যাসিয়াম মাঠে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের সম্বর্ধনা সভায় তাঁকে ছাত্র শিক্ষকের পক্ষ থেকে সম্মাননাপত্র দেয়া হয়। ইংরেজিতে লেখা মানপত্রটি পাঠ করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদের সাধারণ সম্পাদক (ডাকসুর জিএস) গােলাম আযম। মানপত্রে সুস্পষ্ট ভাষায় বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবি করা হয়।
সূত্র: ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ও দলিল – সাহিদা বেগম