বাঙলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে গণ-সংস্কৃতি সংঘের অনুষ্ঠান
সাহিত্যিক জনগণ থেকে দূরে সরে থাকতে চাইতেন। কিন্তু এবারের সংগ্রামে শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র, যুবকদের মাঝে এসে দাঁড়িয়েছেন লেখক, বুদ্ধিজীবী, রেডিও-টেলিভিশন, চলচ্চিত্র ও নাটকের শিল্পীরা। তারা সামিল হচ্ছেন মিছিলে, উদ্দীপিত করছেন জনগণকে।
শিল্পীদের একটি মিছিল কি গভীর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল শ্রীসেন সেই ঘটনার উল্লেখ করেন। উদীচী শিল্পী গােষ্ঠী গত মার্চ মাসে ঢাকায় একটি মিছিল বার করেন। শিল্পীদের এই মিছিল বিভিন্ন রাজপথ পরিক্রমা করে ঢাকার সেন্ট্রাল জেলের কাছে এসে উপস্থিত হয়। শিল্পীদের তীব্র স্লোগান যখন বন্দীদের কানে পৌছল তখন তারা অধীর হয়ে উঠলেন। কারার এই লৌহ কপাট ভেঙে ফেলে তারা ছুটে এলেন মিছিলের দিকে। কারারক্ষীরা গুলি চালালেন। অনেক বন্দী আহত হলেন, কিছু নিহত হলেন। কিন্তু রক্তস্রোত বন্ধ করতে পারল না তাদের মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে।
পশ্চিমবাংলায় আজ যে বিভেদ ও সন্ত্রাসের রাজনীতি চলছে তার উল্লেখ করে ভারতীয় গণ-সংস্কৃতি সংঘের সভাপতি শ্রীদিগিন বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, বাঙলাদেশের মহান সংগ্রামের সমর্থনে এই সংস্থা যেমন জনমত সৃষ্টি করবে অন্যদিকে বিভেদ ও খুনের রাজনীতির বিরুদ্ধেও প্রচার চালাবে।
এরপর শুরু হয় প্রতিরােধের গান।’ একক ও সমবেত সঙ্গীতের মাধ্যমে দুই বাঙলার শিল্পীরা শ্রোতাদের মনে উদ্দীপনার সঞ্চার করেন। এই অংশে সর্বমােট পনেরটি গান ছিল। প্রত্যেকটি গানের পৃথক আলােচনা নিপ্রয়ােজন, কারণ এই জাতীয় অনুষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে সামগ্রিভাবে দর্শকমনে প্রভাব সৃষ্টি করা। কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি পরিহার করতে পারলে সঙ্গীতানুষ্ঠানটি আর ভালভাবে বাঞ্চিত প্রভাব সৃষ্টি করতে সমর্থ হত।
তবু বিশেষভাবে কয়েকটি গানের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। এগুলি হচ্ছে-‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইরা নিতে চায়, ভিড়বে তরী বন্দরে’, রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলন করিলিরে বাঙালী’ ও ‘এবার সবে কাঁধে কাঁধ মিলায়ে।’ বাঙলাদেশের যে সব শিল্পী এই প্রতিরােধের গান গাইলেন তাঁরা হলেন-মাধুরী আচার্য, অসীম মুখার্জী, গৌর হালদার, বিউটি দাম, চম্পক সাহা, শক্তি বর্ধন ও দীপ্তি বর্ধন। অংশ গ্রহণকারী পশ্চিম বাংলার শিল্পীরা হলেন—দেবনাথ চক্রবর্তী, তুষার চট্টোপাধ্যায়, অমূল্য চট্টোপাধ্যায়, সুকোমল দেব, সৌরেন সেনগুপ্ত, সুপ্তি কুমার, সন্ধ্যা চন্দ, রেবা মােহান্ত ও সাথী গুপ্তা। সঙ্গীতাংশটি পরিচালনা করেন পরেশ ধর, মাধুরী আচার্য ও অসীম মুখার্জী।
অনুষ্ঠানের প্রধান আকর্ষণ ছিল ‘বিদ্রোহী বাঙলা’ নাটকটি। পূর্ণেন্দু (পানু) পাল রচিত এই ছােট্ট নাটকটিতে প্রতিফলিত হয়েছে বাঙলাদেশের বর্তমান সংগ্রাম এবং এপার বাঙলায় সেই সগ্রামের প্রতিক্রিয়া।
মঞ্চের পর্দা উঠলে দেখা যায়, একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের বৈঠকখানা। সেখানে যুব নেতা বিদ্যুৎ ও তার স্ত্রী দ্যুতি রেডিয়ােতে আমার সােনার বাঙলা’ গানটি শুনছেন। বলাবাহুল্য, এ গান ভেসে আসছে সীমান্তের ওপার-পূর্ব পাকিস্তান থেকে। স্বামী, স্ত্রী অতীতের সুন্দর স্মৃতির রােমন্থন করছেন। তারা ভাবছেন, আবার দেখতে পাবেন সেই শস্য-শ্যামলা দেশকে মিলবেন আবার ফেলে আসা আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে। এমন সময় বিদ্যুতের পিতা ঘরে ঢুকে এগিয়ে দিলেন একটি সংবাদপত্রের বিশেষ সংখ্যা। এ কি! চমকে উঠল ওরা। পূর্ব বাঙলায় ইয়াহিয়া সৈন্যবাহিনী আক্রমণ চালাতে শুরু করেছে।
কিছুক্ষণ বাদে বিদ্যুতের বন্ধু এবং সংবাদপত্রের রিপোের্টার উপস্থিত হয়। তার সঙ্গে আসে সীমান্তের ওপারের এক যুবক, নাম সামসুল। শােনায় এক বীভৎস অত্যাচারের কাহিনী। বর্বর পাক-হানাদারের দল কিভাবে মসজিদ-মন্দির ধ্বংস করেছে। গ্রামের পর গ্রাম আগুনে জ্বালিয়ে দিয়েছে। নারী-পুরুষ-বৃদ্ধ-শিশু কেউই রক্ষা পায় নি ঘাতকদের হাত থেকে।
এর বীভৎস ধ্বংসের কাহিনী শুনে এরা স্তম্ভিত হয়ে যায়। ভাবে, এরা পারবে কি লড়তে। হ্যা, নিশ্চয়ই পারবে। তাই সামসুল শানায় আর এক কাহিনী। যেখানে নারী-পুরুষ-যুবক-যুবতী-কৃষক-শ্রমিক এক হয়ে লড়াই করতে নেমেছে যেখানে মৃত্যুভয়কে তুচ্ছ করে যুদ্ধ চলছে, যেখানে বিশ্বাসঘাতকদের বিনা দ্বিধায় হত্যা করা হচ্ছে। হঁ্যা, এই বাঙলা নিশ্চয়ই জয়ী হবে। সামসুল বলে, আমদের জয়কে দ্রুততর করবার জন্য আমাদের অস্ত্র দিন, আমাদের সরকারকে স্বীকৃতি দিন।
সূত্র: কালান্তর, ২৩.৭.৭১