You dont have javascript enabled! Please enable it!

নাজিমুদ্দিন সরকারের বিশ্বাসঘাতকতা

১. ব্যবস্থাপক সভায় খাজা নাজিমুদ্দিনের সরকারি প্রস্তাব ৬ই এপ্রিল, ১৯৪৮: মঙ্গলবার বেলা তিনটের সময় পূর্ববাংলা ব্যবস্থাপক সভার যে অধিবেশন বসে, তাতে প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন বাংলাকে সরকারি ভাষা ও শিক্ষার মাধ্যম করার জন্য নিম্নলিখিত প্রস্তাব পেশ করেন :
(ক) পূর্ববাংলা প্রদেশে ইংরাজির স্থলে বাংলাকে সরকারি ভাষা হিসেবে গ্রহণ করিতে হইবে; এবং
(খ) পূর্ববাংলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে শিক্ষার মাধ্যম হইবে যথাসম্ভব বাংলা অথবা প্রতিষ্ঠানগুলাের অধিকাংশ স্কলারদের মাতৃভাষা।
এর পর ব্যবস্থাপক সভায় কংগ্রেস দলের নেতা বসন্তকুমার দাস স্পীকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, পূর্বদিন পরিষদের নেতা খাজা নাজিমুদ্দন একটি নােটিশ মারফৎ জানিয়েছিলেন যে, তিনি সেদিন একটি প্রস্তাব উত্থাপন করবেন, কিন্তু তার প্রস্তাবের বিষয়বস্তু সম্পর্কে কোনােকিছু উল্লেখ করেননি। তিনি আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবটিকে সরকারি প্রস্তাব বলেই মনে হয় এবং সেটা সরকারি দলের অনুমােদনও নিশ্চয় লাভ করেছে। বসন্ত দাস প্রস্তাবটির বিবেচনার জন্যে সময় প্রার্থনা করে বলেন যে, এ বিষয়ে সংশােধনী প্রস্তাব আনার অধিকার তাদের আছে এবং তার পূর্বে মূল সরকারি প্রস্তাবটি তাঁদের পার্টি মিটিং-এ আলােচিত হওয়া প্রয়ােজন।
বিরােধী দলীয় নেতার এই বক্তব্যের পর খাজা নাজিমুদ্দিন তার প্রস্তাবের উপর আলােচনা পরদিন পর্যন্ত মুলতবি রাখতে সম্মত হন। এরপর স্পিকার আবদুল করিম বলেন যে মুলতবি প্রস্তাবের সংখ্যা দুই একটি হলে কোনাে অসুবিধা হবে না। কিন্তু সংখ্যা যদি তার থেকে বেশি হয়, তাহলে যারা সংশােধনী প্রস্তাব পেশ করতে চান, তাঁরা যেন পরদিন বেলা তিনটের মধ্যে সেগুলি দাখিল করেন।
৮ই এপ্রিল বৃহস্পতিবার বেলা। তিনটের সময় পরিষদের কাজ শুরু হয়। অন্যান্য কয়েকটি বিষয়ে প্রাথমিক আলােচনার পর স্পিকার আবদুল করিম সদস্যদেরকে ভাষা বিষয়ক সংশােধনী প্রস্তাবগুলাে পেশ করতে অনুরােধ জানান। প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দিন তখন বলেন, পরিষদের সামনে পূর্বে যে প্রস্তাব তিনি উপস্থিত করেছেন, তার শেষ বাক্যে স্কলার’-এর স্থলে ‘ছাত্র’ শব্দটি তিনি সংযােজন করতে চান।

২. ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের সংশােধনী প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের উপরােক্ত বক্তব্যের পর বিরােধী দলীয় সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত সরকারি প্রস্তাবের উপর নিম্নলিখিত সংশােধনী প্রস্তাবটি ১ পেশ করেন :
১. এই পরিষদের অভিমত এই যে
(ক) বাংলা পূর্ববাংলা প্রদেশের সরকারি ভাষা রূপে গৃহীত হইবে;
(খ) পূর্ববাংলা প্রদেশে ইংরেজির স্থলে বাংলা প্রবর্তনের জন্য আশু ব্যবস্থা অবলম্বন করিতে হইবে;
(গ) পূর্ববাংলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে শিক্ষার মাধ্যমে হইবে বাংলা।
২. এই পরিষদ আরও মনে করে যে, বাংলা পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত; এবং
৩. এই পরিষদ পাকিস্তান সরকারের নিকট সুপারিশ করে যে
(ক) সর্ব প্রকার নোেট ও টাকা পয়সা, টেলিগ্রাফ, পােস্ট কার্ড, ফর্ম, বই ইত্যাদি ডাক সংক্রান্ত যাবতীয় জিনিস, রেলওয়ে টিকিট এবং পাকিস্তান সরকারের অন্য সর্বপ্রকার সরকারি ও আধা-সরকারি ফর্মে অবিলম্ব বাংলা প্রচলন করা হউক;
(খ) কেন্দ্রীয় সিভিল সার্ভিসে এবং সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীতে যােগদানের জন্য সকল প্রকার প্রতিযােগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে এবং অন্যতম বিষয় হিসেবে বাংলা প্রবর্তন করিতে হইবে; এবং
৪. এই পরিষদ সংবিধান সভার সকল সদস্যকে অনুরােধ জানাইতেছে এবং পূর্ববাংলার প্রতিনিধিদের নিকট বিশেষভাবে আবেদন করিতেছে যাহাতে তাহারা বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করিবার জন্য সর্বপ্রকার প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা অবলম্বন করেন।
ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর প্রস্তাবটি পাঠ করার পরই সে সম্পর্কে কয়েকজন সদস্য আপত্তি উত্থাপন করেন। প্রথমেই আবদুল বারী চৌধুরী বলেন যে ধীরেন দত্তের উত্থাপিত সংশােধনী প্রস্তাবটি বাস্তবপক্ষে মূল প্রস্তাবের পরিবর্তে একটি সম্পূর্ণ নােতুন প্রস্তাব। কাজেই সেটি সংশােধনী প্রস্তাব হিসেবে কোনােমতেই বিবেচিত হতে পারে না। শিক্ষামন্ত্রী আবদুল হামিদ বলেন যে প্রস্তাবটি সংশােধনী প্রস্তাবের আকারে কখনােই আসতে পারে না কারণ তাতে এমন কতকগুলাে বিষয়ের উল্লেখ আছে যেগুলাের উপর প্রাদেশিক সরকারের কোনাে এখতেয়ার নেই। তাঁকে সমর্থন করে অর্থ দফতরের মন্ত্রী হামিদুল হক চৌধুরী বলেন যে ধীরেন দত্তের প্রস্তাবটি কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে সুপারিশের আকারে একটি নােতুন প্রস্তাব হিসেবে আসতে পারে অন্য হিসেবে নয়, কারণ তার মধ্যে যে সমস্ত বিষয়ের উল্লেখ আছে। সেগুলি প্রাদেশিক সরকারের আওতা বহির্ভূত।।
উপরােক্ত সমালােচনার জবাবে ধীরেন দত্ত বলেন যে সরকারি প্রস্তাবটিতে বাংলা ভাষাকে শুধু পূর্ববাংলার সরকারি ভাষা করার কথা বলা হয়েছে কিন্তু তাঁর প্রস্তাবে তিনি বাংলা ভাষাকে এই প্রদেশের মাতৃভাষা এবং পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার কথা বলেছেন। তাঁর সেই মূল প্রস্তাব যদি না নেওয়া হয় তাহলে সংশােধনী প্রস্তাব দেওয়ার কোনাে অর্থ হয় না।
এর জবাবে প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দিন বলেন : এটি একটি স্বীকৃত নীতি যে প্রাদেশিক সরকারের এলাকা বহির্ভূত কোনাে বিষয়ে প্রাদেশিক পরিষদে প্রস্তাব উত্থাপন করা চলে না, তার জন্যে গভর্নরের কাছে সরাসরি বক্তব্য পেশ করতে হয়। স্যার, আপনার হয়তাে স্মরণ আছে যে আগেকার দিনে কেন্দ্রীয় সরকারের এখতেয়ারভুক্ত কোনাে বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে বক্তব্য পেশ করতে হলে গভর্নরের মাধ্যমে সেটা করার একটা নির্ধারিত পদ্ধতি ছিল। যে সমস্ত বিষয়গুলাে প্রাদেশিক একমাত্র সেগুলােই এখানে আলােচিত হতে পারে। এই প্রস্তাবটির যা বিষয়বস্তু তাতে করে এর একমাত্র আলােচনাক্ষেত্র সংবিধান সভা। সেই হিসেবে গভর্নরের মাধ্যমে একটা আবেদন ব্যতীত অন্য কোনােভাবে বিষয়টি তিনি এখানে আলােচনা করতে পারেন না।
ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের এই সংশােধনী প্রস্তাবটির বিরুদ্ধে খাজা নাজিমুদ্দিন। ব্যবস্থাপক সভার এখতেয়ার এবং নির্ধারিত নীতির উল্লেখ করেন। এ প্রসঙ্গে একজন অভিজ্ঞ সংসদীয় রাজনীতিক হিসেবে তিনি পর্ববর্তী বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার আইন কানুন সম্পর্কেও স্পীকারের মাধ্যমে পরিষদে স্মরণ করিয়ে দেন। এক্ষেত্রে নীতি বিষয়ে তিনি যাই বলুন রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের সাথে তিনি যে ৮ দফা চুক্তি সম্পাদন করেন তার তৃতীয় দফা অনুসারে তিনি এই মর্মে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন যে পূর্ববাংলা ব্যবস্থাপক সভার পরবর্তী অধিবেশনে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্যে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে সুপারিশ করে তিনি একটি সরকারি প্রস্তাব উত্থাপন করবেন। এই চুক্তিপত্রটি তিনি ১৫ই মার্চ প্রাদেশিক ব্যবস্থাপক সভায় পাঠ করে শােনান। ধীরেন দত্তের প্রস্তাবটিতে ৮ দফা চুক্তি বহির্ভূত কোনাে বক্তব্য ছিল না। বিতর্কের পরবর্তী পর্যায়ে কয়েকজন সদস্য চুক্তির এই দিকটি সম্পর্কে উল্লেখ করলেও কর্ম পরিষদের সাথে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার সময় নাজিমুদ্দিনের এই নীতি জ্ঞান বিলুপ্ত হয়েছিল কেন এ সম্পর্কে প্রশ্ন করে তাঁকে কেউই খুব বেশি বিব্রত করেননি। উপরন্ত প্রস্তাবটি মূল প্রস্তাবকে ছাড়িয়ে গেছে এবং তা প্রাদেশিক সরকারের এলাকা বহির্ভূত এই বলে স্পিকার সংশােধনী প্রস্তাবটিকে অগ্রাহ্য করায় এ বিষয়ে বিশেষ কোনাে উচ্চবাচ্য করে সকরেই স্পিকারের সিদ্ধান্ত মেনে নেন। শুধু তাই নয়। এই স্বীকৃতির পরও ধীরেন দত্তের সংশােধনী প্রস্তাবটি প্রাদেশিক সরকারের আওতা বহির্ভূত এই কথার পুনরুক্তি করে আবদুস সবুর খান এবং শামসুদ্দীন আহমদ খােন্দকার পরিষদের সময় নষ্ট করেন। প্রথম সংশােধনী প্রস্তাবটি নাকচ হওয়ার পর ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত নিম্নোল্লিখিত দ্বিতীয় প্রস্তাবটি উত্থাপন করেন :
১. এই পরিষদের অভিমত এই যে
(ক) বাংলা পূর্ববাংলা প্রদেশের সরকারি ভাষা রূপে গৃহীত হইবে;
(খ) পূর্ববাংলা প্রদেশে ইংরাজির স্থলে বাংলা প্রবর্তনের জন্য আশু ব্যবস্থা অবলম্বন করিতে হইবে।
(গ) পূর্ববাংলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে শিক্ষার মাধ্যমে হইবে বাংলা।
২. এই পরিষদ পাকিস্তান সরকারের নিকট সুপারিশ করে যে
(ক) সর্ব প্রকার নোেট ও টাকা পয়সা, টেলিগ্রাফ, পােস্ট কার্ড, ফর্ম, বই ইত্যাদি ডাক সংক্রান্ত যাবতীয় জিনিস, রেলওয়ে টিকিট এবং পাকিস্তান সরকারের অন্য সর্বপ্রকার সরকারি ও আধা-সরকারি ফর্মে অবিলম্ব বাংলা প্রচলন করা হউক;
(খ) কেন্দ্রীয় সিভিল সার্ভিসে এবং সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীতে যােগদানের জন্য সকল প্রকার প্রতিযােগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে এবং অন্যতম বিষয় হিসেবে বাংলা প্রবর্তন করিতে হইবে।
এই দ্বিতীয় প্রস্তাবটিকেও খাজা নাজিমুদ্দিন প্রাদেশিক সরকারের এলাকা বহির্ভূত হিসেবে বিবেচনার অযােগ্য বলে বর্ণনা করেন। একথার পর ধীরেন দত্ত তৎক্ষণাৎ অন্য একটি সংশােধনী প্রস্তাব পেশ করতে উদ্যত হন। তার এই অবস্থা দেখে হামিদুল হক চৌধুরী বলে ওঠেন যে ধীরেন বাবু তার প্রস্তাবগুলাের দোষত্রুটি সম্পর্কে পুরােপুরিভাবে অবহিত কাজেই তিনি আসল সংশােধনী প্রস্তাবটির দিকে ধাপে ধাপে এগিয়ে আসছেন।
ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত এর পর তাঁর তৃতীয় এবং শেষ সংশােধনী প্রস্তাব পেশ করেন :
১। পরিষদের অভিমত এই যে-
(ক) বাংলা পূর্ববাংলা প্রদেশের সরকারি ভাষা রূপে গৃহীত হইবে।
(খ) দুই বৎসরের মধ্যে পূর্ববাংলা প্রদেশে ইংরাজির স্থলে বাংলা প্রবর্তনের জন্য আশু ব্যবস্থা অবলম্বন করিতে হইবে।
(গ) পূর্ববাংলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ শিক্ষার মাধ্যম হইবে বাংলা।
ধীরেন দত্তের প্রস্তাব উত্থাপন পদ্ধতি থেকে একথা স্পষ্ট বােঝা যায় যে প্রস্তাবটি সম্পর্কে হামিদুল হকের বক্তব্য আংশিকভাবে সত্য। ধীরেন দত্তের প্রথম প্রস্তাবটি তিন অংশে বিভক্ত। এই তিন অংশকে তিনি এমনভাবে সাজিয়েছিলেন যাতে প্রথমবার সেটির বিরুদ্ধে আপত্তি উঠলে শেষ অংশকে তিনি বাদ দিতে পারেন। এবং দ্বিতীয় প্রস্তাবের ক্ষেত্রে আপত্তি উঠলে দ্বিতীয় অংশটিকে বাদ দিয়ে প্রথম অংশটি আবার উত্থাপন করতে তাঁর কোনাে অসুবিধা না হয়। ধীরেন দত্তের তিন দফা প্রস্তাব এবং তার পরবর্তী পর্যায়ে কংগ্রেস দলীয় সদস্যদের একের পর এক সংশােধনী প্রস্তাব পেশের দ্বারা এটাই প্রমাণিত হয় যে তাঁদের প্রস্তাবগুলাে প্রত্যাখ্যাত হবে একথা তাঁরা পূর্বেই ধরে নিয়েছিলেন এবং সেই হিসেবে নাজিমুদ্দিন সরকারের সাথে ভাষার দাবি নিয়ে দরাদরি করার জন্যেই ধীরেন দত্ত ধাপে ধাপে তার ন্যূনতম প্রস্তাবের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন। এদিক থেকে বিচার করলে প্রস্তাবটি ত্রুটিপূর্ণ এই উপলব্ধি থেকে আলােচ্য প্রস্তাবটি তিন দফায় পেশ করা হয়েছিল, হামিদুল হকের এই যুক্তির ভ্রান্তি সহজেই বােঝা যাবে।
প্রস্তাবটি পাঠ করার পর ধীরেন দত্ত পরিষদে একটি ব্যাখ্যামূলক বক্তৃতা দেন। বাংলাকে যথাশীঘ্র দেশের শিক্ষা ও সরকারি কাজকর্মের ভাষা হিসেবে প্রচলনের যুক্তি হিসেবে তিনি বলেন :
এখন কথা হচ্ছে যে প্রস্তাব এই House এ উত্থাপিত হয়েছে যে প্রস্তাবে কতদিনের ভিতর বাংলা ভাষা আমাদের Official-language হবে তার উল্লেখ নাই। আমাদের কথা হচ্ছে অতি শীঘ্র তা করা দরকার। কারণ যদি অতি শীঘ্র তা করা না হয়, যদি তার ভিতর dead line পড়ে যায় তাহলে ১০০ বৎসরেও বাংলাভাষা এখানকার প্রাদেশিক ভাষার স্থান লাভ করতে পারবে না। সেইজন্য আমি বলছি যত শীঘ্র হয় তার ব্যবস্থা করুন যাতে আমরা বাংলা ভাষাকে সম্পূর্ণভাবে প্রাদেশিক ভাষায় পরিণত করতে পারি। বর্তমানে আজি ও শিক্ষাক্ষেত্রে সব কিছুই ইংরাজির Through তে হয়ে আসছে। এখন হতে ইংরেজি বাদ দিয়ে বাংলা করতে হবে। অনেকে বাংলা ভালাে জানেন, লিখতে পড়তে পারেন, অথচ Court কাছারীর কোনাে কাজের জন্য তাঁদের ইংরাজি জানা লােকের উপর নির্ভর করতে হয়। বাংলা হলে এই সব অসুবিধাগুলাে দূর হতে পারে। আর একটা কথা। নিজের ভাষা আয়ত্ত করা সহজ কিন্তু পরের ভাষা ইংরাজি আমরা যতই বুঝি বা বলি আমার অভিজ্ঞতা হতে বলতে পারি যে নিজের ভাষা ছাড়া অন্য ভাষায় মনের ভাব ঠিক ঠিক ব্যক্ত করা যায় না। আমি একজন উকিল হিসেবে একথা বলতে পারি যে উকিল ও বিচার কর্তারাও মাতৃভাষায় বক্তৃতা ও রায় দানের ব্যবস্থা হলে ভালােভাবে কাজ করতে পারবেন। স্কুল কলেজে শিক্ষার ভিতর দিয়ে বাংলাকে গড়ে তুলতে হবে। কাজেই বাংলা ভাষার উন্নতি ও পরিপুষ্টির জন্য একটি Committee গঠন করতে হবে যেরূপ পশ্চিমবঙ্গে গঠিত হয়েছে। যদি এ বিষয়ে ভালাে ব্যবস্থা অবলম্বিত না হয় তাহলে ১০ বৎসরে কেন ১৫ বৎসরেও কোনাে উন্নতি হবে না। কাজে কাজেই ইংরেজি থেকে যাবে।
বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্র ভাষা করার যুক্তি হিসেবে তিনি বলেন :
জনগণের দাবি যে প্রাদেশিক ভাষা নিয়েই পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে। জনগণের এই দাবির পিছনে একটা যুক্তিসঙ্গত কারণ রয়েছে। আমরা যে রাষ্ট্র গঠন করছি এই রাষ্ট্রের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের ব্যবধান ২ হাজার মাইল। রাষ্ট্রের এক অংশের সঙ্গে অপর অংশের ব্যবধান ২ হাজার মাইল এবং এমন ক্ষেত্রে রাষ্ট্র ভাষা দুইটি করাই সঙ্গত। প্রকৃত প্রস্তাবে পাকিস্তানের দুই unit এর মধ্যে এক unit এর ভাষা পুরাপুরি বাংলা আর এক nuit এ সিন্ধু, বেলুচিস্তান, পশ্চিম পাঞ্জাব ও উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে কোনােটির ভাষার কোনােটির সঙ্গে মিল নেই।
এক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের ৪ কোটি অধিবাসীর ভাষাকে তারা তাদের unit এর রাষ্ট্রভাষা দাবি করলে অন্যায় বলা যায় না। প্রথম যখন এ বিষয়ে কথা উঠেছিল তখন আমাদের প্রধানমন্ত্রী সাহেব বলেছিলেন একটা agreement হচ্ছে যাতে বাংলাকে এই প্রদেশের রাষ্ট্রভাষা করা হয়। তিনি আরও জানান যে এটা পাকিস্তান মন্ত্রিসভাকে জানান হবে ও ব্যবস্থা করা হবে। মুসলিম লীগ পক্ষের সভ্য মি. আবদুল হাকিম বিক্রমপুরী এই প্রস্তাব এনেছিলেন যে বাংলা ভাষা প্রাদেশিক ভাষা হবে ও পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে। এই agreement এর উপর আমি সংশােধনী প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলাম কিন্তু সে প্রস্তাব অগ্রাহ্য হয়েছে। আপনারা জানেন প্রকৃত প্রস্তাবে আবদুল হাকিম বিক্রমপুরী যে প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন তা শুধু বাংলাকে পাকিস্তানের official language করবার জন্য। আমাদের উজিরে আজমের সেই প্রস্তাব আনা উচিত ছিল।
এর পর ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ফেব্রুয়ারি মাসে গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে ভাষা সম্পর্কিত বিতর্কের উল্লেখ করে বলেন :
আপনারা জানেন এটা সৰ্ববাদী সম্মত যে প্রকৃত প্রস্তাবে বাংলা ভাষাই এখানকার রাষ্ট্রভাষা। আমাদের Constituent Assembly তে এই প্রস্তাব আমি গত অধিবেশনে উত্থাপন করেছিলাম। আমাদের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী সাহেব সেটা সংশােধন করে নেবেন এইটাই ছিল আমার অভিপ্রায়। আমাদের দেশের শিক্ষিতের শতকরা ৬০ জনের বেশি লােক বাংলা ভাষায় পড়তে পারে অথচ ইংরাজি জানে না, উর্দু জানে না, এই প্রশ্নের উত্তরে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী সাহেব ব্যবস্থা করব বলে ছিলেন। আমি আমাদের প্রধানমন্ত্রী সাহেবকে জিজ্ঞেস করছি যে তার কি ব্যবস্থা করা হয়েছে। Post card এ বাংলার নাম নাই, money order form এ বাংলার নাম নাই, Telegraph এ বাংলার নাম নাই, Railway ticket এ বাংলার নাম নাই। আমি জিজ্ঞাসা করি বাংলা দেশের কত লােক বাংলা ছাড়া অন্য ভাষা বােঝে। উজিরে আজমের বােঝা উচিত ছিল যে currency তে বাংলা না থাকলে সাধারণ লােকের কত অসুবিধা হয়। Railway ticket নিয়েও কম অসুবিধা হবে না। একজন অজ্ঞলােক যে উর্দু জানে না এমন লােকের সংখ্যা এখানে খুব বেশি। তাদের অসুবিধা কথা একটু চিন্তা করুন।
ধীরেন দত্ত তাঁর বক্তৃতার শেষে বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার সপক্ষে পরিষদের কাছে নিম্নলিখিত ভাষায় আবেদন করেন :
এই সংশােধনী প্রস্তাব প্রকৃত পক্ষে জনগণের নিজেদের : আমি প্রতিনিধি মাত্র। এই প্রস্তাব অনুসারে কাজ করলে জনসাধারণের যথেষ্ট কষ্টের ও অসুবিধার লাঘব হতে পারত। এগুলি Central Subject বলে উড়িয়ে দিলে চলবে না। Provincial Administration এর উপর যা এসে পড়েছে তার উপর Province এর জনগণের একটা দাবি আছে। এই সব প্রশ্ন উত্থাপন করলে উজিরে আজম ও মন্ত্রীবর্গ নানা কথা বলে থাকেন। আমি আপনাদের কাছে জানাতে চাই এটা সমর্থন করুন না না করুন এটাই জনগণের দাবি। আমি পাকিস্তানের অধিবাসী হিসেবে এবং পাকিস্তানের প্রতি আমার আনুগত্য আছে বলে আমি এই অসুবিধার কথা পাকিস্তান পরিষদে পেশ করেছিলাম। আমার এর ভিতর অন্য কোনাে উদ্দেশ্য ছিল। এটা আমার দাবি বলে মনে করি বলেই এই প্রশ্ন আমি উত্থাপন করেছিলাম। আমরা পাকিস্তান গ্রহণ করেছি বলে পাকিস্তান রাষ্ট্রের উপর আমাদের একটা দাবি রয়েছে। ৭ কোটি বাঙালির মধ্যে ৪ কোটির উপর পাকিস্তানে রয়েছে। তাদের রাষ্ট্রভাষা বাঙ্গালা হওয়া যুক্তিসঙ্গত এইজন্য আমি এই দাবি উপস্থিত করেছিলাম। আমি আশা করি মন্ত্রীমণ্ডলী এবং জনগণের প্রতিনিধি যারা আছেন তারা জনগণের এই দাবি সমর্থন করবেন এবং নিজেরাই এই প্রস্তাব করবেন। শুধু বাংলায় বক্তৃতা করলে চলবে না। বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করতে হবে।
বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা করার জন্যে প্রস্তাব উত্থাপনকালে পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য জ্ঞাপন করে ধীরেন দত্তের কিছু বলা প্রয়ােজন হয়েছিল তার কারণ গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনের বিতর্ক থেকে শুরু করে কয়েকটি প্রতিক্রিয়াশীল সংবাদপত্র, মুৎসুদ্দীদের স্মারকলিপি, কায়েদে আযমের বক্তৃতা এবং প্রাদেশিক পরিষদের বিতর্কে ভাষা আন্দোলকে হিন্দুদের দ্বারা প্ররােচিত এবং অন্তর্ঘাতমূলক বলে সব সময়েই অভিহিত করা হয়েছিল। অবশ্য ধীরেন দত্তের এই আনুগত্য প্রকাশের পর রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে এই সাম্প্রদায়িক এবং উদ্দেশ্যপ্রণােদিত মিথ্যা প্রচারণা যে বন্ধ হয়েছিল তা নয়। বস্তুত এর কোনাে প্রভাবই সরকারি মহলের পরবর্তী সমালােচনার মধ্যে প্রতিফলিত হয়নি। এবং তা না হওয়ারই কথা।
স্পিকারের নির্দেশমতাে বিনােদচন্দ্র চক্রবর্তী এর পর নিম্নলিখিত সংশােধনী প্রস্তাবটি উত্থাপন করেন :
(ক) পূর্ববাংলা প্রদেশের সকল অফিস এবং আদালতে ইংরাজির পরিবর্তে বাংলা সরকারি ভাষা হিসেবে গৃহীত হইবে; এবং
(খ) পূর্ববাংলার বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমহে বাঙালিদের শিক্ষার মাধ্যম হইবে বাংলা।।
বিনােদ চক্রবর্তী তার সংশােধনী প্রস্তাবটি পাঠ করার পর বক্তৃতা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন যে তিনি যেভাবে ভাষা বিষয়ক প্রস্তাবটি পরিষদের সামনে উপস্থিত করেছেন তাতে তাদের মনে যথেষ্ট আশঙ্কার সঞ্চার হয়েছে। তিনি মন্ত্রিসভার উদ্দেশ্যের সততা সম্পর্কে তাদের সন্দেহের অবসান ঘটানাের জন্যে নাজিমুদ্দিনের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি সরকারি প্রস্তাবে ‘যথাসম্ভব’ কথাটির প্রতি বিশেষভাবে জোর দিয়ে বলেন যে এই ধরনের এটা অস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি রক্ষার জন্যে সরকার যে কোনাে আশু ব্যবস্থা অবলম্বন করবেন। যে ভরসা তাদের নেই। ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে সরকারি মনােভাবই যে তাঁদের এই আশঙ্কার মূল কারণ একথাও তিনি তাঁর বক্তৃতায় উল্লেখ করেন। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন:
এই বাংলা ভাষার আন্দোলন অধিবেশন হবার পূর্ব হতে যখন আরম্ভ করা হয়েছিল তখন আপনারা জানেন যে সকল যুবক ও নেতৃবৃন্দ এই আন্দোলনের পুরােভাগে ছিলেন তাঁরা ছিলেন সকলেই সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের এবং মুক্ত নাগরিক হিসেবে সম্পূর্ণভাবে এটা সমর্থন করবার ইচ্ছা আরও অনেক প্রকাশ করেছিলেন। আমরা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অনেক নানা দিক বিচার করে এর সঙ্গে যােগ দিতে পারি নাই। তাদের আমরা কোনাে সাহায্য করি নাই তবুও তাদের নিন্দার ভাগী করা হয়েছে। যদি আমরা সর্ব সম্প্রদায় এই আন্দোলনকে আরও সাহায্য করতাম তাহলে আন্দোলন আরও বড় হয়ে উঠত। তথাপিও প্রধানমন্ত্রী মহাশয় ঘােষণা করেছিলেন এই আন্দোলনের পিছনে অনেকের দূরভিসন্ধিমূলক সম্পর্ক ছিল। এ বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারী এবং মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির ষড়যন্ত্রের বিষয়ে উল্লেখ করে বিনােদ চক্রবর্তী বলেন : আপনারা জানেন এই বাংলা ভাষার প্রচলনের বিরুদ্ধে অনেক গােপন ষড়যন্ত্র হয়েছিল এবং যারা এই পথে বাধা সৃষ্টি করেছিল তারা কেবল মাত্র এটা নিজেদের মধ্যে আবদ্ধ রাখে নাই সরকারি কর্মচারীদেরও প্রভাবান্বিত করেছিল এবং এই যুক্তিসঙ্গত আন্দোলন যারা করেছিল তাদেরও নির্যাতন ভােগ করতে হয়েছিল। এর দায়িত্ব ও কাহার নিজের একার নয় সমস্ত দলের ও নেতার প্রতি দায়িত্ব রয়েছে।

সূত্র: ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ও দলিল – সাহিদা বেগম

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!