You dont have javascript enabled! Please enable it! 1949.12.09 | পূর্ব পাকিস্তানের স্ট্যান্ডার্ড বাংলা – অধ্যাপক মােহম্মদ ফেরদাউস খান | সৈনিক - সংগ্রামের নোটবুক

পূর্ব পাকিস্তানের স্ট্যান্ডার্ড বাংলা
– অধ্যাপক মােহম্মদ ফেরদাউস খান

এখন যে ভাষাকে আমরা স্ট্যান্ডার্ড হিসেবে ব্যবহার করছি তা কলকাতা এবং কলকাতার কাছাকাছি অঞ্চলের কথ্য ভাষা। এ ভাষাই অবিভক্ত বাংলার ভাষা। এ ভাষাই অবিভক্ত বাংলার স্ট্যান্ডার্ড চলতি ভাষা হিসেবে মর্যাদা পেয়েছে এবং কালক্রমে আমরাও তা মেনে নিয়েছি। এই ভাষার ক্রমবিকাশে কলকাতার বিশেষ প্রাধান্য পাবার কারণও রয়েছে। প্রথমত কলকাতা সারা বাংলার রাজধানী এবং শিক্ষাকেন্দ্রে ছিল বলে নানা ধারার দেশের চতুর্দিকে তার প্রভাব ব্যাপক হচ্ছিল। দ্বিতীয়ত, বাংলা ভাষার শক্তিশালী লেখকদের অনেকেই পশ্চিমবঙ্গীয়। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। তাঁর আবির্ভাব সাহিত্য ক্ষেত্রে এমনই একটা সাড়া এনে দিয়েছিল যে, দেশের গােটা শিক্ষিত সমাজ রাবীন্দ্রিক ভাষা এবং ভাব ধারাকে গ্রহণ করার প্রেরণা পেয়েছে। তাতে বাংলার দূরতম অঞ্চলেও রবীন্দ্রনাথের ভাষা পরিচিত হয়ে ওঠে। (সৈনিক ১৯৪৯ পৃ: ৮)
আজ পাকিস্তান অর্জনের পর একটা কথা উঠেছে, আমাদের স্ট্যান্ডার্ড বাংলা মূলত পশ্চিম রঙের এবং পূর্ববঙ্গের কোন অঞ্চলেরই কথ্যভাষা নয়, কজেই সেটি আঁকড়ে থাকা আমাদের শােভা পায় না। এ ব্যাপারে স্থির সিদ্ধান্তে পৌছুবার আগে সমস্যাটার সবদিক যাচাই করে দেখতে হবে। আমার ধারণা, এই স্টান্ডার্ড বাংলাকে বিতাড়নের চেষ্টা আদৌ সুফলপ্রসূ হবে না। অনেকেই হয়ত বলবেন, বয়সে তরুণ হলেও মানসিকতায় আমি প্রাচীনপন্থী। আমি বলব পুরাতনের ভাললাকে সাদরে গ্রহণ করার মধ্যে আমি অন্যায় কিছু দেখি না।
আমাদের লব্ধপ্রতিষ্ঠ সাহিত্যিক এবং উদীয়মান লেখকেরা বর্তমানে পূর্বেকার সেই স্ট্যান্ডার্ড বাংলাকে মেনে নিয়েছেন এবং তাতেই নিজেদের সাহিত্য সাধনা রূপায়নের প্রয়াস পাচ্ছেন। এ ভাষাতে তাদের ভাব প্রকাশের পথ সুগম হয়ে। উঠেছে। তখন হঠাৎ একে নির্বাসিত করলেই প্রত্যেকটি লেখকের আপন আপন কথ্যভাষার আশ্রয় গ্রহণ করা ছাড়া উপায় নাই। পূর্ববঙ্গের কোনাে কথ্যভাষার প্রকাশ ক্ষমতা সবল নয়। কারণ সাহিত্যে সত্যিকার মর্যাদা এরা কোনােকালেই পায়নি এবং সেভাবে চেয়েও উঠেনি। ফলে এসব কথ্যভাষা তখনাে যথেষ্ট পরিমাণে অক্ষম ও অনুন্নত। কাজেই এরূপ কথ্য ভাষায় প্রত্যেকটির লেখকের স্বতঃবৃত্তি ব্যাহত হওয়াই স্বাভাবিক। সাহিত্য এর প্রভাব অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর, কারণ স্বতঃস্ফূর্তি অর্থাৎ আপন ভাববেগের সহজ, সম্যক এবং কঠিন ব্যঞ্জনই হচ্ছে সাহিত্যের মূলকথা। তার অভাবে সৃষ্টিধর্মী প্রতিভার পূর্ণ বিকাশ সম্ভব নয়। সুতরাং স্ট্যান্ডার্ড এ বাংলাকে বাদ দিলে আমাদের সাহিত্য পঙ্গু হয়ে পড়বে। এবং তাগিয়েও চলবে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। এতদসঙ্গে আরাে একটি কুফল হবে। সবারও মিলিত চেষ্টা স্ট্যান্ডার্ড ভাষাকে উন্নত ও সমৃদ্ধ করত তখন তা খণ্ড খণ্ড হয়ে স্থানীয় কথ্যভাষাও সীমাবদ্ধ থাকবে। এতে সাহিত্যক্ষেত্র সমৃদ্ধির গতিবেগও বিশেষভাবে ক্ষুন্ন হবে।
হয়তাে অনেকে এই চান যে, অধুনাচলিত স্ট্যান্ডার্ড বাংলাকে বিতাড়িত করে এখানকারই কোনাে কথ্যভাষাকেও মর্যাদা দেওয়া হােক। আগেও বলেছি, পূর্ববঙ্গের কোনাে কথ্য ভাষা কোনদিক দিয়ে এর সমকক্ষ নয় এবং এ ব্যবস্থায় এক দিনেই আমরা সাহিত্যক্ষেত্র বহুদূর পেছিয়ে পড়ব। দ্বিতীয়ত প্রত্যেক জেলারই কথ্যভাষা এখন স্ট্যান্ডার্ড হিসেবে মর্যাদা লাভের জন্য জোর গলায় আপন আপন দাবি পেশ করবে। এতে সাহিত্যেক্ষেত্রে অনর্থক এবটা বিশৃঙ্খলা এবং দলাদলির সৃষ্টি হবে। এসবের কুফল সহজেই অনুমেয়।।
সারা দেশব্যাপী ভাষার সাধারণ একটা চলতি রূপ না থাকায় আরাে একটা মারাত্মক অসুবিধা আছে। এতে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা অত্যন্ত জটিল হয়ে ওঠে। শিক্ষার মাধ্যমে নির্ধারণ, পাঠ্যপুস্তক, প্রণয়ন, আন্তঃআঞ্চলিক মেলামেশা বা ভাব বিনিময় ইত্যাদি নানা ব্যাপারে অসংখ্য সমস্যা এসে দেখা দেয়। আমাদের দেশে ইচ্ছা করে কেহ সমস্যা বিভ্রান্ত হতে চান কিনা জানি না।
সুতরাং দেখা যাবে, দেশে ভাষার একটা স্ট্যান্ডার্ড রূপ থাকা একান্ত জরুরি। পূর্ববঙ্গে নতুন করে ওরকম ভাষা সৃষ্টির চেষ্টা যে কীভাবে আমাদের সাহিত্য সমৃদ্ধির পথ রােধ করবে তার উল্লেখ আগেই করেছি। শুধু সাময়িক একটা আবেগ সত্তার খাতিরে ভাষার কোনাে পরিবর্তন সাধন সমীচীন নয়। ভাষার ক্ষেত্রে পরিবর্তনের অবতারণা ধীর গতিতে হওয়াই বাঞ্ছনীয়। ক্রমবিকাশের ফলে যে প্রতিসরণ এবং একদিনেই গোঁড়া থেকে ছিনিয়ে নেওয়া, এ দুয়ের মধ্যে তফাত অনেক। প্রথমটি হচ্ছে প্রগতিশীল পরিবর্তন, আজ দ্বিতীয়টি আঘাতজনিত কৰ্তন। তাই আমি বলব- যে স্ট্যান্ডার্ড বাংলা আমরা দেশ বিভাগের পূর্বে মেনে নিয়েছি এখনাে তাই চালু থাকুক, পূর্ববঙ্গের কোন জেলার কথ্যভাষার সঙ্গে এর হুবহু মিল নাই বা রইল। তার সৌকর্য যা দীর্ঘকাল ধরে সঞ্চিত হয়েছে অস্বীকার করা যায় না।
কেউ কেউ হয়ত বলতে পারেন এই ভাষায় আমাদের ভাবধারা আমাদের বৈশিষ্ট্য ঠিক পরিস্ফুট হয়নি, সুতরাং ঐতিহ্যের তরফ থেকেও দুর্বল। কিন্তু মাতৃভাষার চর্চায় আমাদের গাফিলতিই কি এর জন্য দায়ী নয়? ভাষা ভাবের আদান-প্রদান এবং সংরক্ষণের একটা টেকনিক’ বা কৌশল, একে আপন প্রতিভা বিকাশের কাজে লাগবে না অথচ তজ্জন্য ভাষার দোষ দেব- এ মনােভাব অযৌক্তিক। ঐ ‘টেকনিক’ টিকে মেনে নিয়ে এর মাধ্যমেই চলুক আমাদের সাহিত্য সাধনার সম্মিলিত উদ্যম। অচিরেই দেখা যাবে, এ ভাষায় নতুন প্রাণ সঞ্চারিত হচ্ছে, এ ভাষা নবরূপায়নের দিকে ধাপে ধাপে এগিয়ে চলছে এবং আমাদের ভাবধারায় দিন দিন পরিস্ফুট হচ্ছে। আমার মনে হয়, পাকিস্তানি বাংলা গড়ে তােলার এই হচ্ছে স্বাভাবিক ঐক্য সহজতম পন্থা।

সৈনিক, শুক্রবার-৯ই ডিসেম্বর, ১৯৪৯