হরফ বিতর্ক
শামসুল হক
১৬ই এপিল ১৯৫০ পৃ: ৬
[ নানা কারণে আমরা সাময়িকভাবে এই বিতর্কটি বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছিলাম। আজ আবার নতুনভাবে এর অবতারণা করা হচ্ছে। বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ
লিপিসমস্যার সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানিদের তামদ্দুনিক ভাগ্য অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। এদিকে চিন্তাশীল পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যাচ্ছে সম্পাদক সৈনিক
জনাব সম্পাদক ভাই,
সালাম নিন। আপনার কাছে লিখিত জনাব মােহাম্মদ ওয়াজেদ আলী সাহেবের হরফ বদল সম্পর্কীয় পত্রখানা পড়েছি। অনেক বারই পড়েছি, অনেক চিন্তা করেছি। কিন্তু একমত হতে পারিনি প্রবীণ সাহিত্যিক সাহেবের সঙ্গে। আমার মনে হয় ওপথে হরফ সমস্যার সমাধান আসতে পারে না।
বর্তমানে বাংলা হরফে লেখার যে যে রেওয়াজ চলছে, তা অবৈজ্ঞানিক, তাতে জলদি লেখা যায় না বেহুদা সময় নষ্ট হয়। ওয়াজেদ আলী সাহেবের সঙ্গে আমরাও একমত যে, এতে টাইপিং, ছাপা, টেলিগ্রাম প্রভৃতি আরাম সাধ্য, কোনাে কোনােটি দুঃসাধ্যও বটে। কিন্তু আমার মনে হয়, তিনি যে পথ বাতলিয়েছেন সে পথ সুষ্ঠু নয়। বৈজ্ঞানিক ও নয়। তাতে করে নতুন সমস্যার উদ্ভব হবে।
আমরা রক্ষণশীল নই। অক্ষর পূজা আমরা করি না, বাংলারও না আরবীরও। আমরাও মানি জীবন মানেই গতি আমরা চাই বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে হরফ সমস্যার সমাধান। তিনি বলেছেন হরফ বদলানাের জন্য। কিন্তু আমাদের মাত্র হরফ বদল নয়, সংস্কার চাই। আমরা মনে করি এপথেই সব সমস্যার সমাধান হতে পারে। পক্ষান্তরে হরফ বদল করলে নতুন নতুন সমস্যার উদ্ভব হবে, যাতে করে জাতীয় জীবন বিপর্যস্ত হয়ে যাবে।
বাংলা হরফের বদলে আরবি হরফ নিলে কি কি অসুবিধা হবে, সে সম্বন্ধে অনেক আলােচনা হয়েছে। বাংলায় যে আরবি হরফ চলতে পারে না সে সম্বন্ধে অনেক অখণ্ডনীয় যুক্তি দেওয়া হয়েছে। সংক্ষেপে বলতে গেলে : আরবি হরফ বাংলা ধনি তত্ত্বের উপযােগী নয়। স্বরচিহ্ন না দিলে আরবি পড়া একদম দুঃসাধ্য। তাতে দ্রুত পড়া যায় না। স্বরচিহ্ন দিতে গেলে লেখার গতি কমে যায়। গতি কমে যাওয়ার মানেই পিছিয়ে যাওয়া। আরবি হরফ শব্দের প্রথমে, মধ্যে ও শেষে ভিন্ন। ভিন্ন রূপ লয়। প্রায় হরফেরই তিনটি রূপ আছে। এতে হরফ আয়ত্ত করতে অনেক বেশি সময় লেগে যায়। শুধু হরফ জানা থাকলেই আরবি পড়া যায় না, ব্যাকরণবিদও হতে হয়। আরবি হরফের অবৈজ্ঞানিকতার এটা চূড়ান্ত নজির। বাংলায় এমন অনেক হরফ আছে, যাদের উচ্চারণ আরবি হরফ দিয়ে হতে পারে। আরবি হরফ আমদানি করলে বা হরফ বদল করলে, বাংলা হরফের মারফত এতকাল ধরে যে জ্ঞান সাধনা করা হয়েছে, তা থেকে আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ব। দেশ কাল জাতি ভেদে উচ্চারণের পার্থক্য হয়। বাংলায় আরবি হরফ নিয়ে টানাটানি করলে, অনেক আরবি অক্ষর আমাদের মুখে ধীরে ধীরে বিকৃত হয়ে যাবে। এতে অবশেষে আমরা ভুল উচ্চারণ করে কোরান পড়ব।
বস্তুত শুধু আরবি নয়, পৃথিবীর অন্য কোনাে হরফেই সুষ্ট ভাবে, বাংলা তত্ত্ব অনুসারে বাংলা লেখা হতে পারে না। প্রত্যেক ভাষারই এমন কতকগুলাে নিজস্ব ধ্বনি থাকে যা অন্য ভাষার কোনাে হরফ দিয়ে উচ্চারণ করা যায় না। প্রত্যেক ভাষার হরফ গড়ে উঠে সেই ভাষার স্বতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য মাফিক। এজন্য বাংলা হরফে যেমন আরবি লিখা যেতে পারে না। আরবি হরফে যেমন ইংরেজি লেখা যায় না, দ্রুপ আরবি অথবা ইংরেজি হরফেও বাংলা লিখা যেতে পারে না। হরফের বেলায় রক্ষণশীলতা আসে তখনই যখন যুগের সমস্যা সমাধানের জন্য সুযযাপযােগী ভাবে হরফের সংস্কার সাধন করা হয় না। হরফের বেলায় আমরা রক্ষণশীল হয়ে পড়ব তখনই, তখন হরফকে যুগােপযােগী সংস্কার করে টাইপ, টেলিগ্রাম প্রভৃতির উপযােগী করব না।
জনাব ওয়াজেদ আলী সাহেব সরকারি নীতির ভাষা দিয়েছেন। তাঁর মতে, সরকার এক অখণ্ড পাকিস্তানি জাতি এবং জাতীয়তা বােধ গড়ছে; বাঙালি, পাঞ্জাবি, সিন্ধি, বেলুচি, সরহদি প্রভৃতিকে ধ্বংস করে অর্থাৎ প্রাদেশিকতা বা বাঙালিত্ব: পাঞ্জাবিত্ব প্রভৃতি ঝেড়ে ফেলে, নীতির দৃষ্টিকোণেই উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা করা হয়েছে। তারি জন্য বাংলাতে আরবি হরফ চালানাের বন্দোবস্তু হচ্ছে।
আমাদের মতে, পাকিস্তানের জাতীয়তা আজগুবী কিছু নয়, আকাশ থেকে বা আরব থেকে দেদার আমদানি হতে পারে না। পাক জনগণের মধ্য হতেই ফুটে উঠবে পাকিস্তানের অখণ্ড রূপ, পাকিস্তানি জাতীয়তা বাঙালি, পাঞ্জাবি, সিদ্ধি, বেলুচি, সরহদি সবাইকে নিয়েই পাকিস্তানি জাতীয়তা, অখণ্ড পাকিস্তান। কাউকে জবাই করে অখণ্ড পাকিস্তান বা পাকিস্তানি জাতীয়তা পাওয়া যাবে না। প্রত্যেক প্রদেশেরই নিজস্ব কতকগুলাে বৈশিষ্ট্য বা বৈচিত্র রয়ে গেছে যা অন্য প্রদেশ থেকে তার পার্থক্য সূচিত হয়। প্রত্যেক প্রদেশের বৈশিষ্ট্যগুলাের সমন্বয়েই গড়ে উঠবে পাকিস্তানের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। এই বৈশিষ্ট্য বা বৈচিত্র গুলােকে প্রাদেশিকতা নামে জাহির করার কোনাে মানে হয় না। করা মানে, দিন-দুপুর পুকুর চুরি করা। প্রদেশেকিতা বলতে আমরা বুঝি: কোনাে বিশেষ প্রদেশের অন্যায় আবদার রক্ষার জন্য অন্যান্য প্রদেশের ন্যায় সংগত স্বার্থে আঘাত।
ওয়াজেদ আলী সাহেব সরকারি নীতির তাৎপর্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন, শুধু উর্দু রাষ্ট্র ভাষা হলেই, আপনাদের বাঙালিপনা (যেটা পশ্চিমবঙ্গের মানে ভারতের সঙ্গে আপনাদের অবশিষ্ট যােগসূত্র) দেদার আরবি-ফারসি উর্দু শব্দ ঢুকিয়ে এবং আরবী হরফ চালিয়ে তাকে এক ধরনের উর্দুতে পরিণত করার দরকার। আপনাদের বাঙালি বুদ্ধি (মানে বাঙালিত্ব বােধ) তাতেই পুরাপুরি নষ্ট হয়ে যাবে এবং তার ফলে আপনারা পাকিস্তানি জাতির অংগে নিশ্চিন্তে মিলে যেতে পারবেন।
বাংলা হরফে যদি ভারতের সহিত পূর্ববাংলার যােগ সূত্র হয়, তবে সেই যােগসূত্রকে আরবি হরফ আমদানি করে নষ্ট করা যাবে না, অন্যবিধ রূপে মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে। পশ্চিম বাংলার লােকেরা ভাত খায় সেজন্য আমাদিগকে রুটি ধরতে হবে? কিন্তু রুটি ধরলেতাে নিস্তার নেই, হিন্দুস্থানিরাও রুটি খায়। তবে কি সব পাকিস্তানিকে গরুর গােসত খেয়ে জীবন ধারণ করে নিজেদের পাকিস্তানি স্বাতন্ত্র্য বহাল রাখতে হবে? তাতেও তাে যােগসূত্র থেকে যায়, হালে কোনাে কোনাে হিন্দুও গরু-গােস্ত খেতে শুরু করেছে। তবে ভারতের সহিত যােগসূত্র ছিন্ন। করার উপায় কী? বাতলে দেবেন ওয়াজেদ আলী সাহেব? … হিজরত? … আরবে? কিন্তু তাতেও যে যােগসূত্র রয়ে যায়। আমাদের দু’চোখ, তাদেরও দু চোখ, আমাদের দুহাত তাদেরও দুহাত, আমাদের দু’পা তাদের ও দু’পা, আমরাও পায়ে চলি তারাও পায়ে চলে। এবার হতে স্বাতন্ত্র্য রক্ষার খাতিরে আমরা পা উপরের দিকে দিয়ে চলতে শুরু করব নাকি? বস্তুত মানুষের সহিত মানুষের, দেশের সহিত দেশের, জাতির সহিত জাতির কতকগুলাে সাদৃশ্য রয়ে গেছে। এগুলাে খােদাই দান। এগুলােকে এক বিশেষ দৃষ্টিকোণে ভয়ংকর ধরনের যােগসূত্র মনে করবার কারণ নেই।
আবার দেশের সহিত দেশের বৈসাদৃশ্যও থাকে। পূর্ব আর পশ্চিমবঙ্গের মধ্যেও আছে। দুই বঙ্গের ভাষায়, সাহিত্যে, লেবাসে, তমুদুনে এই বিভিন্নতা ক্রমশই বেড়ে উঠে দুই ভিন্ন জাতির অস্তিত্ব প্রমাণ করেছে। হরফ একই হলেও দুই বঙ্গের সাহিত্যের ধারা স্বাভাবিক ভাবেই দু’দিকে গতি নিয়েছে। একটা হচ্ছে পাক-বাংলা অপরটা হচ্ছে হিন্দুস্থানি। ওয়াজেদ আলী সাহেব বলেছেন, কামারশালে গিয়ে দাঁড়াতে, যেখানে তৈরি হচ্ছে পাকিস্তানি জাতীয়তা, তিনি বােধ হয় কামারশাল বলতে বুঝেছেন করাচী বা পশ্চিম পাকিস্তান। কিন্তু আমাদের মতে, কামারশাল সারা পাকিস্তান। পাকিস্তানের প্রতি কোনায় কোনায় পাকিস্তানি জাতীয়তা গড়ে উঠেছে। প্রতিটি লােকের মধ্যে পাকিস্তানের প্রতিটি ভাষায় প্রতিটি সাহিত্যে, একটি হরফে, একটি ভাষায়, একটি সাহিত্যে পাকিস্তানি জাতীয়তা গড়া অস্বাভাবিক, অবৈজ্ঞানিক। সে পথে গড়তে পরে না। ভেঙ্গে যাবে।
সরকারি নীতির ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি বলেছেন, প্রাদেশিকতা প্রাচীন কাল থেকে এ পর্যন্ত মহাভারতের রাজনৈতিক ঐক্যানুভূতিকে কিভাবে ইতিহাসের পাতায় পাতায় ব্যর্থ করে রেখেছে, তাতাে জানেন।
আমাদের জিজ্ঞাস্য – আরবী হরফে কি সেই ঐক্য পাকিস্তানের আসতে পারে? আমরা জোর করে ‘না’ বলতে পারি। ঐক্যানুভূতি আসবে: মনের মিলে, বাহিরের মিলে নয়; একই আদর্শে, প্রত্যেক ভাষায় সাহিত্যে সেই আদর্শ প্রচারে, প্রত্যেক ভাষায় পাকিস্তানি জাতীয়তা প্রচার করার মাধ্যমে, যাতে জনসাধারণের মরমে ঐক্যের বাণী দোলা লাগায়। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, সবাই যদি বাঙালি পাঞ্জাবি সিন্ধি, বেলুচি, সরহদি হয় তবে পাকিস্তানি হবে কে? একটু উলটিয়ে আমরাও বলতে পারি: কেহ যদি বাঙালি পাঞ্জাবি সিন্ধি, বেলুচি, সরহদি না হয়, তবে পাকিস্তানি হবে কে? বস্তুত এসব কোনাে কথাই নয়। বাংলা, পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তান, সরহদ সবাই মিলে যেমন পাকিস্তান। অন্য কথায় পাকিস্তান যেমন বাংলা, পাঞ্জাব, সিনধু বেলুচিস্তান, সরহদের সমন্বয়; তেমনি বাঙালি পাঞ্জাবি সিন্ধি, বেলুচি, সরহদি সবাই মিলে পাকিস্তানি; অন্য কথায় পাকিস্তানি হচ্ছে: বাঙালি পাঞ্জাবি সিন্ধি, বেলুচি, সরহদি সব। এসব কোনাে প্রশ্নের বিষয় নয়। প্রশ্ন হলাে কে পাকিস্তানের আদর্শ নাগরিক আর কে নয়। সে বাংলার পাকিস্তানিই হউক আর পান্জাবের পাকিস্তানিই হউক।
তিনি বলেছেন, পাকিস্তানে পাকিস্তানিই হবেন, বাংগালি হতে চান কেন?
আমরা বলি, অন্তরে সকলেই হবে পাকিস্তানি। কিন্তু কোনাে কোনাে বাহ্য আচার ব্যবহারে কারও কারও বাংগালি বা পাঞ্জাবি মার্কা ছাপ থেকে যাবে। আর মজার কথা হলাে এই যে ওই মার্কা ভিন্ন কেউ পাকিস্তানি হতে পারবে না। অন্তরের পাকিস্তানি রূপটি হচ্ছে সকলের আর্থিক, সামাজিক ধর্মীয় ও আদর্শিক ঐক্যানুভূতি থেকে উদ্ভূত মিল। এই মিলটিকে আবার অন্যান্য ক্ষেত্রে ফুটিয়ে তুলতে হবে, যাকে বাহ্য- আচার ব্যবহার বলা হয়েছে। বাঙালি খাটি পাকিস্তানি হলেও তার গায়ে বাঙালিত্বের ছাপ থেকে যাবে। ভেতাে বাঙালি তাে আর রুটি খেয়ে থাকতে পারবে না। কিন্তু খাছ করে বলতে গেলে বাঙালিত্ব পাঞ্জাবিত্ব প্রজ্ঞানে প্রভৃতিও পাকিস্তানিরই বিভিন্ন প্রকাশ। আমরা বাঙালি ভাত খেয়েও যেমন মুসলমান হতে পারি, আরবি রুটি খেয়েও যেমন মুসলমান হতে পারে; তেমনি বাংলা হরফ নিয়েও আমরা পাকিস্তানি হতে পারি, বাঙালি আরবি বা উর্দু হরফ নিয়েও পাকিস্তানি হতে পারে। আসল কথা, খাবার সময় দেখতে হবে, অই আরবি ও ‘বিসমিল্লাহ’ বলে কিনা আর অই বাঙালি বেটাও ‘বিসমিল্লাহ্’ বলে কিনা। বাংলা হরফ অসদৃশ্য নয় যে তা নিয়ে জাতে উঠা যাবে না। যেমন আরবি হরফ হযরতের পূর্বে কাফেরদের হরফ থেকেও বাঁধেনি আরবি মুসলমানদের হরফ হতে।
ওয়াজেদ আলী সাহেব বলেছেন, পাকিস্তান চেয়েছিলাম কেন? আমরা বলি: পাকিস্তান চেয়েছিলাম পরিপূর্ণভাবে আত্মবিকাশের জন্য, আত্মহত্যা বা কোনাে অঙ্গ ঘায়েল করবার জন্য নয়। এক পা কেটে সেখানে গাদের পা লাগিয়ে দেবার জন্য নয়। সমস্ত দেহের সাথে পাকেও সবল ও পুষ্ট করার জন্য। আর দেহের পুষ্টিটি মানেই সমস্ত অংগে প্রত্যঙ্গের পুষ্টিটি, সমস্ত অঙ্গ প্রত্যঙ্গের পুষ্টিটি মানেই দেহের পুষ্টিটি। পাকিস্তান ও প্রদেশ সম্বন্ধেও কথাটি সমান সত্য। প্রদেশের উন্নতি চাই না, পাকিস্তানের উন্নতি চাই। এ ধরনের বিবৃতিগুলাে ভাওতা দেবার কলাকৌশলপূর্ণ বাক্যজাল বই আর কিছু নয়।
আর বাঙালিত্ব পাঞ্জাবিত্ব ইত্যাদি যদি কেহ একেবারে ঘুচিয়ে দিতে চায়, তবে পূর্ব পাকিস্তানকে হনুমানের পিঠে করে নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের সহিত জুড়ে দিক, রাজপুত আর কথার সােনার কাঠির পরশে বাঙালীত্ব পান্জাবিত্ব ঝেড়ে ফেলুক। প্রত্যেকটি রুটি খাওয়াক, একবুলি শিখাক, ফু দিয়ে সকলের গায়ের রং এক করে ফেলুক, গ্রাম জেলা প্রদেশ ইত্যাদি সীমারেখা তুলে দিক। তবেই সে উদ্দেশ্য সিদ্ধ হতে পারে, অন্যথায় নয়। এ যদি আজগুবী মনে হয় তবে বাঙালীত্ব, পাঞ্জাবিত্ব প্রভৃতি মুছে ফেলাও সমান আজগুবী। দাদী আম্মার রূপ কথার কেচ্ছার মতাে।।
এখন মূল কথায় ফিরে আসা যাক, পূবেই বলেছি; হরফ বদল চাই না, সংস্কার চাই। বস্তুত আজ আমাদের ভাষা ও সাহিত্য ক্ষেত্রে হরফ সমস্যা নিয়ে যে বিপর্যয়ের সৃষ্টিটি হয়েছে তা শুধু হরফ সংস্কারেই দুরীভূত হতে পারে।
আমাদের মতে যুক্তাক্ষর ও মহাপ্রাণ হরফ বাদ দিয়ে ২৭টি হরফ দ্বারা বাংলা ভাষা শুদ্ধ রূপে লিখা যায়, যাতে বাংলা ভাষা সহজ হবে এবং টাইপ, লিননা টাইপ, ছাপা, টেলিগ্রাম প্রভৃতি বৈজ্ঞানিক আবিক্রিয়ার জন্য সম্পূর্ণ উপযােগী হবে। যুক্তাক্ষরে দুই বা ততধিক হরফ নিয়ে নতুন হরফের সৃষ্টি প্রক্রিয়া থেকে রেহাই পেতে আপত্তি নেই। মহাপ্রাণ বর্ণগুলােও যুক্তাক্ষর বিশেষ, বাংলায় খ, ঘ, ছ, ঝ, ঠ, ঢ, য, ধ, ফ, ভ, শ ইত্যাদি মহাপ্রাণ বর্ণ। ইহারা অল্প প্রাণ হরফের সহিত ‘হ’ যুক্ত হয়ে উচ্চারিত হয়। যথা : ক + হ – খ, গ + হ – ঘ, চ + ২ – ছ, জ + হ – ঝ, ট + হ – ঠ, ড + হ – ঢ, ত + ২ – থ , দ + হ – ধ, প + হ – ফ, ব + হ – ভ; স + হ –শ।
সুতরাং আমরা অল্প প্রাণ হরফ সমূহের পরেই হ দিয়ে মহাপ্রাণ হরফ সমূহের উচ্চারণ করতে পারি। নতুন হরফের কোনাে দরকার নেই। যেমন : খারাপ কাহ্রাপ; ঘাম-গাহম, ইচ্ছুক – ইচচুহক, ঝংকার— জহংকার; ঠগ- ঠগ; ঢাকডাহুক, থাম- তাহ্ম; ধনী— দহ্নী, ফল- পহ্ল, ভারত বাহ্রত, শাসক সাহশক। সুতরাং অ, আ, ই, উ, ত, ও, ক, গ, চ, জ, ট, ড, ত, দ, ন, প, ব, ম, র, ল, য, হ, ং, ঃ, ড়, য, , এবং আকার, ঈকার, একার (শুধু _’) একার, এই চারটি স্বরচিহ্ন ও হসন্ত চিহ্ন দিয়ে উত্তম রূপে বাংলা লিখা যায়। মহাপ্রাণ বর্ণ, যুক্তাক্ষর, বিভিন্ন ফলা কিছুই লাগে না। মহাপ্রাণ বর্ণগুলােতে আমরা বর্ণমালা থেকে বিদায়ও দিতে পারি, বা এভাবে রাখতে পারি। যেমন : ক, কহ, গ, গহ্ ইত্যাদি। কোন অল্প প্রাণ হরফের পরে ‘হ্ থাকলে বুঝতে হবে উহা মহাপ্রাণ বর্ণে রূপন্তরিত হয়েছে।
নিম্নে কতকগুলাে হরফকে পরীক্ষা করে দেখা যাক। ঈ উচ্চারণ ‘ই’ র মতাে। সুতরাং ইটকে ফেলে দেওয়া যায়। আমরা ‘ঈ কে ফেলে দিয়েছি। কারণ ‘ঈ’ এর মধ্যে যেমন উচ্চারণে প্রভেদ নেই, তেমনি ই কার আর ঈ কারের মধ্যেও উচ্চারণে পার্থক্য নেই। সুতরাং একটিকে ফেলে দেওয়া যায়। আমরা ই কার ফেলে দিয়েছি। কারণ ই কারের চেয়ে ঈ কারে লেখা দ্রুত হয় এবং টাইপিং এর ও সুবিধেও হবে।
দীর্ঘ উচ্চারণ ‘উ’ এর মতাে। কাজেই পেঁচালাে হরফ ‘দীর্ঘউ’ দিয়ে ‘উ’ নেওয়া যায়। কারণ ‘উ’ দীর্ঘউ থেকে সহজে ও কম সময়ে লেখা যায়। তদ্রুপ উ কার আর দীর্ঘ একারের উচ্চারণেও কোন প্রভেদ নেই। কাজেই উ কার আর দীর্ঘউ কারের যাবতীয় কার্য্য শুধু উ কার () দিয়েই করা যায়। যেমন- রূপ রুপ রুটী, রুটী, গুণ গুন।
ঋ কোন স্বতন্ত্র বর্ণ নয়। কাজেই রাখার যৌক্তিকতা নেই। ঋ কারের কার্য্য ‘রী দিয়ে সারানাে যায়। যে হরফের নিচে থাকে, তার নিচে হসন্ত দিয়ে পারে ‘র’ দিলেই চুকে যায়। যেমন : কৃত-ক্রীত মৃত – মৃরীত; যকৃত – যকৃরীত।
৯ বাংলায় প্রয়ােগ বা উচ্চারণ কোনােটাই নেই। তত দিন বাল্য শিক্ষার পাতাতে অনধিকার প্রবেশ করেছে। এখন নির্বাসন দেওয়া যায়। | এ কার এ কার সম্বন্ধে শহীদুল্লা সাহেবের অনুসরণ করাই শ্রেয় পন্থা। এ কার হরফের আগে না দিয়ে পরে দিলেই লেখার দ্রুত বাড়ে তার টাইপিং এর জন্যও সােজা হয়। যেমন : কেমন কু ১ মন গেল- গ্যালে। ঐ – উচ্চারণ ওই। ওই লেখা যায়। যথা : ঐকান্তিক – ওইকান্তীক; ঐ-ওই। অক্ষরের পরে ‘ই’ দিয়ে ঐকারের কাজ সারান যায়। যেমন : কৈ-কই, সৈনিক সইনীক।।
ও কার – হরফের পরে ‘ও’ দিয়ে ও কারের বিড়ম্বনা রােধ করা যায়। হরফের আগে একবার এ কার পারে আবার আকার দিলে অনেক সময় লাগে। তাতে লেখার দ্রুততা অনেক কমে যায় এবং টাইপিং এর জন্য ভয়ানক অসুবিধা। কাজেই ‘ও’ দিয়ে ও কারের পালা শেষ করতে হবে। যেমন মােহাম্মদ মওহাম্মদ ঔ-উচ্চারণ ‘ওউ’ লেখা যায়। যথা : ঔকাৰ্য্য ওউকারক। সুতরাং রাখা অনাবশ্যক। ঐকারের কাজ ‘উ’ দিয়ে সারান যায়। যেমন : মৌলবী, মউলবী, অলৌকিক অলউকীক, কৌরব কউরব।
ঙ – পুরানা আমলে উচ্চারণ দিল ‘উআঁ। বর্তমান উচ্চারণ ‘ং’ ঙ থেকে ‘ং’ লেখায় দ্রুততা বাড়ে। তাই ‘ঙ বাদ দিয়ে শুধু ‘র’ রাখলে চলে।।
সূত্র: ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ও দলিল – সাহিদা বেগম