You dont have javascript enabled! Please enable it! 1950.02.26 | হরফ বিতর্ক | সৈনিক - সংগ্রামের নোটবুক

হরফ বিতর্ক
২৬ শে ফেব্রুয়ারি সৈনিক ১৯৫০ পৃ: ৫-৬

[হরফ বদল সম্পর্কে শ্রদ্ধেয় মােহাম্মদ ওয়াজেদ আলী সাহেবের পত্রকে সমালােচনা করে অনেকেই আমাদের কাছে চিঠি লিখেছেন— প্রবন্ধাদি পাঠাচ্ছেন। দুটো চিঠি এবার আমরা পত্রস্থ করলাম চিঠি দুটোই জনাব ওয়াজেদ আলী সাহেবকে সম্বােধন করে লিখা; বলাবাহুল্য যে মতামত পত্র প্রেরকদের নিজস্ব। পত্র ও প্রবন্ধগুলাে আমরা যথাসাধ্য ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করবাে মনস্থ করেছি। বাংলা ভাষার বিশেষজ্ঞরা এদিকে মনােযােগ দিলে সুখী হবাে। সম্পাদক সৈনিক]।

শ্রদ্ধেয় ওয়াজেদ আলী সাহেব,
সৈনিক সম্পাদকের কাছে লিখিত হরফ বদল সম্বন্ধীয় পত্র পাঠ করলাম। আপনি যে আরজ কটি দিয়েছেন মূলত দেখছি যে তার প্রত্যেকটির মধ্যে থেকে ফুটে উঠছে, বর্তমান বৈজ্ঞানিক যুগে লিখবার সময় সংক্ষেপ করা এবং সেই জন্যই। আপনি বাংলা হরফের শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছেন। যা হােক আপনি বলেছেন বাংলা লিখবার সময় উপরে, নীচে, ডাইনে বামে নানা দিকে টানতে হয় তার উপরে স্বর প্রয়ােগে ও সংযুক্ত অক্ষর লিখতে ভীষণ বিপদ। ভাষা লিখতে বর্তমান জামানায় তত দেরী হলে জাতি অনেক পিছনে পড়ে থাকবে। দ্বিতীয় টাইপিং ও ছাপার দিক দিয়েও এতগুলাে অক্ষরের জন্য বিপদ।।
দ্বিতীয়টিকেই প্রথমে ধরা যাক। বাংলাতে টাইপিং ও ছাপায় যে অক্ষর আধিক্য আছে অন্য ভাষার অক্ষরে রূপান্তরিত করে তা কিরূপে কমাবেন? যদি ‘বসন্ত কে আরবি হরফে লিখতে যান তবে বাশান্তা লিখবেন – তার বদলে বাংলার ‘বসন্ত’ লেখা যেতে পারে। বর্তমান বাক্য আরবিতে লিখতে গেলে ‘বাক্কা’ ব্যতীত আর কিছু লেখা যায় না, কিন্তু বাংলাতে (১) য ফলা তুলে বাক লেখা চলে।
এইরূপ লিখলে টাইপে ন্থ ৫০/৫০০ অক্ষরের স্থান কেবল মাত্র আ, ই, উ, এ, ও, ক, খ, গ, ঘ, ঙ, চ, ছ, জ, ঝ, ঞ, ট, ঠ, ড, ঢ, ত, থ, দ, ধ ন, প, ফ, ব, ভ, ম, য, র, ল, শ, , স, হ, ড়, ,, ং, এই বেয়াল্লিশটি অক্ষরের দ্বারাই চলে। বর্তমানে বহু সংযুক্ত হরফকে ভেঙ্গে দেয়া হচ্ছে। এ ছাড়া যে স্বর চিহ্ন ভুল হয় তাও অবশ্য বর্তমানে সচরাচর হচ্ছে অতএব, তীর ও তির দুই স্থানে কেবলমাত্র ‘তির’ বসিয়ে এক শব্দের দুই অর্থ স্থান বিশেষে তট ও বান ধরিলেই চলে। ইংরাজিতেও তদ্রুপ বহু শব্দ আছে। এছাড়া আরবি হরফে বাংলা লিখতে গেলে ড়, ঝ, গ, ঘ প্রভৃতি বহু ধ্বনি আছে এগুলি আমদানি করবেন কোথেকে? বাধ্য হয়ে ‘নাড়ি দুর্বল স্থলে র অক্ষর দ্বারা নারী দুর্বল’ লিখতে হবে। তা হলে আরবি লওয়া চলে না অন্য ভাষার সাহায্য নিতে হবে। এখন এমন একটা ভাষা দেখান যা লিখতে ডাইনে বামে গিয়ে নিচে টানতে হবে না। তাই পরিষ্কার বলা যেতে পারে, আপনারা বিজ্ঞ সমাজ আরবি হতে পারে না কোনও তার উফ আদায় করে নিতে চান। কিন্তু তাতেও যে উপরে নিচে ডাইনে বামে টানতে হবে।
তারপর সংযুক্ত অক্ষর তুলে ফেললেও নানা দিকে টেনে লিখতে হলে যদি জাতির উন্নতি না হয় তবে বাংলায় স্বরচিহ্ন এক দাগে প্রকাশ পায় ও ইংরাজিতে সম্পূর্ণ হরফ লিখতে হয়। ইংরাজি Knowledge বাংলায় সংক্ষেপে ‘জ্ঞানে প্রকাশ পায়। এইরূপ আরাে বহু শব্দ আছে। সেই দীর্ঘ ভাষী ব্রিটিশের জগত জয়ী হতে পারলে আমরা পারব না কেন? আর আপনি যদি লেখার বিলম্বতেই জাতির অবনতি আশঙ্কা করেন তা হলে জাতির শিক্ষার এই দুর্দিনে হরফ বদল করে ভাষার বিপ্লব সৃষ্টি করলে তা কি এই কিঞ্চিৎ বিলম্বকর খতি অপেক্ষা অধিক খতিকর হবে না? তাতে কি জাতি আরাে বেশি বিপদের সম্মুখীন হবে না? তাই আমার মনে হয়, এই বিপ্লব সৃষ্টির চেয়ে কবি সাহিত্যিকদের দ্বারা বাংলা হরফেই বাংলা সহজ করা যাক।
এরপরেও বাঙালি স্বাধীনতাপ্রিয় জাতি, তার ভাষায় মুক্তিবাণীপূর্ণ তাই বিদ্রোহের ভয়ে যদি হরফ বদল করতে চান তা হলে কী সেটা ‘শাস রেখে ছােলা টানাটানি করা হবে না? অক্ষর বদল করেই কি বাণীদাতাদের মুখ বন্ধ করা যাবে? আর ভাষার রূপ বদল করে এক ভাষা করলে যদি যদি বাঙালিত্ব বােধ নষ্ট করা যেত তা হলে এক ভাষী রাষ্ট্র গুলাের মধ্যে গণ্ডগােল চলে কেন? আর মাটির দোশেই যদি এই বিদ্রোহ আসে তবে ভাষার রূপ ও সামান্য মূল বদল করলেও অন্যান্য দেশের মতাে এস্থানে বিদ্রোহ দেখা দেবেই থামান যাবে না কিছুতেই।
সুতরাং দেখা গেল শুধু হরফ নয় মূল বদল করলেও কাজ দেবে না— অতএব যে কটা দিক দেখালেন তাতে ভাষার রূপ বদল আমার কাছে একটা খতিকর প্রয়াস বলেই মনে হয়।
আপনার
কাজী নজরুল ইসলাম।

জনাব,
আচ্ছালামু আলাইকুম। জানুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে আপনার অতি সুচিন্তিত পত্রে হরফ বদল সম্পর্কে কটী আরবী পাঠ করে যারপরনাই প্রীত হয়েছি। তবে এ সম্বন্ধে আমার কিছু বক্তব্য রয়েছে। আপনার আমার চিন্তাধারার ভিতরে হয়তাে কিছু পার্থক্য থাকতে পারে, কিন্তু এটা জানি যে আমাদের তরুণদের চাইতে আপনাদের মহৎ গুণটি অনেক বেশি। অন্তত সেই গুণের মাহাত্মে সব বরদাস্ত করে নেবেন। আপনি বলেছেন, বাংলা হরফ দেবনাগরী সংস্কৃত লিপি হতে উৎপন্ন হয়েছে। কিন্তু শুধু এই যুক্তিতেই কি বাংলা হিন্দুদের ভাষা হয়ে গেল? ভারতে প্রথম বসবাস। ছিল হিন্দুর তাইতে কি গােটা ভারত হিন্দুদের হয়ে গেল? কিন্তু বাদ্যযন্ত্র যেটাই হােক বাদকের কৃতিত্বতে যন্ত্র সুরলহরী ঝংকার দেবে এতাে আপনি জানেন? বাংলা ভাষা যতদিন হিন্দুদের চর্চাধীন ছিল ততদিন হিন্দু সুর লহরীই থেকে ছিল কিন্তু যেই মুসলমানদের হাতে অমনি মুসলমানি সুর বাজতে লাগল তার প্রতিটি তারে। আপনি বুড়াে হয়েছেন, আপনাদের আমলে, অর্থাৎ আপনারা যখন ছােট ছিলেন তখন বাংলা ভাষার যে রূপ দেখেছেন আজ কি সেই রূপই দেখেন না কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করছেন আপনি? এটা অবশ্যই ধারণা করতে পারছেন যে বর্তমান বাংলা ভাষার যেরূপ আছে দুদিন বাদে তাও হয়তাে থাকবে না বাংলা ভাষাই বাংলা হরফে বন্দি থেকেই এমনরূপ গ্রহণ করবে যখন চক্ষু মুদেই বলা যাবে যে এটা পাকিস্তানি বাংলা আর ওটা হিন্দুস্থানি বাংলা। আরেক বাংলা মুখের বুলি দিয়েই কি পাকিস্তানি এবং হিন্দুস্থানীর পার্থক্য নির্ণয় করতে চান না আচার ব্যবহার রীতিনীতি দিয়ে নির্ণয় করতে চান? ইউরােপে তথা ইংল্যান্ডে বহু মুসলমান আছে যারা দাড়ি গোঁফ কিছুই রাখে না। তাদের মাতৃভাষা ইংরেজি। সে যদি আপনার দেশে আসে তবে কি তার বুলি শুনে তাকে খ্রিস্টান বলবেন না তার আচার ব্যবহার রীতি নীতি দেখে মুসলমান বলবেন? আমাদের বিশ্বাস এক জাতি হতে অন্য জাতির পার্থক্য নির্ণয় করতে তার ভাষার মারামারির দরকার হয় না, দরকার হয় শুধু আচার ব্যবহারের। আদর্শের পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু হতে চলেছে রাষ্ট্র ভাষার প্রত্যেকটি লােক শিক্ষিত হতে পারলে রাষ্ট্রের সাথে সাধারণ লােকের ভাবের আদান প্রদানের সুবিধা হবে জানি। তবে দেখা উচিত কিভাবে বণিকী ভাষাকে দূর করে কিংবা সামান্য কিছু রেখে রাষ্ট্র ভাষায় দ্রুত অগ্রসর হওয়া যায় ইংরেজি পড়িলে শেষে স্বর্গ পাওয়া দায় অবস্থায় আবার পড়ে বসতে না হয়। মনে রাখবেন, পাকিস্তান কায়েম রাখতে হলে গােলামী শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন করার দরকার হবে প্রথম তার পরে হবে বাকী সব।
ভাষার হরফ বদলানাের ওপর কায়েম বেকায়েম নির্ভর করে না।
আরও একটি কথা আপনি জানেন, উপদেশ অপেক্ষা দৃষ্টান্ত ভালাে। আপনি বলেছেন ‘আরবীও নয়, উর্দুও নয় তৃতীয় আর একটি অক্ষর দিয়ে আপনি বাংলা ভাষার নতুন রূপ দিতে পারেন। সে অক্ষরটি সৈনিক মারফত আপনি জানাবেন কি দেখবেন যেন পথ ‘পঠ’ এবং মতকে ‘মই বলতে না হয়; আরও লক্ষ্য রাখবেন, মাতৃভাষা বাংলাকে সহজ সুন্দর এবং কতকটা পাকিস্তানি বাংলা ভাষায় পরিণত করতে যে কয়েক শত বছর কেটেছে আপনার চিন্তিত নতুন মাতৃভাষা অন্তত শিখতেই যেন তার চাইতে বেশি সময় না লাগে।
আপনার
এ এফ মােহাম্মদ মজিদ

সূত্র: ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ও দলিল – সাহিদা বেগম