You dont have javascript enabled! Please enable it!

৪৮ সনের আন্দোলন—সৈনিক

সংগ্রাম পরিষদ সম্প্রসারণ : এই সময় লীগ রাজনীতিতে বিশেষ করিয়া ছাত্রলীগ রাজনীতিতে ২টি দলের সৃষ্টি হয়। শাহ আজিজুর রহমানের নেতৃত্বকে অস্বীকার করিয়া শেখ মুজিবুর রহমান, আজীজ আহমদ, কাজী গােলাম মাহবুব প্রভৃতির নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিম ছাত্রলীগ বলিয়া একটি ছাত্র প্রতিষ্ঠান গঠিত হয়। ইহার কনভেনর ছিলেন মিঃ নইমুদ্দীন। এই ছাত্রলীগের নেতৃত্বে একদল ছাত্র মজলিশের সঙ্গে হাত মিলাইয়া সংগ্রাম পরিষদে যােগদান করেন।

ইউনিভার্সিটি গ্রাউন্ডে প্রথম মিটিং
এসময়ে ফজলুর রহমান সাহেব ও অন্য কয়েকজন মন্ত্রীর বাংলা বিরােধী বক্তৃতায় ও বিবৃতিতে বিক্ষোভ ধূমায়িত হইয়া উঠিতে থাকে মনি অর্ডার ফরম ও টাকায় বাংলা ভাষা থাকিবে না বলিয়া এক খবর প্রকাশিত হয়। সংগ্রাম পরিষদ ১৯৪৮ সনের জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে ইউনিভার্সিটির সম্মুখ মাঠে এক মিটিং আহ্বান করেন। এই সভায় সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় ফেব্রুয়ারিতে একটি প্রতিবাদ দিবস পালন করা হইবে। অর্থের অভাব : বিভিন্ন কার্যক্রম সম্পাদনের জন্য অর্থের দারুণ অভাব দেখা দেয়। দুই আনা চারি আনা করিয়া চাঁদা উঠানাে হয়। সরকারি কর্মচারীরা, এমনকি কয়েকজন মন্ত্রীও সেখানে কিছু চাঁদা দেন। (অবশ্য হামিদুল হক সাহেব ও অপর কয়েকজন মন্ত্রীর বাসায় গিয়ে কর্মিরা অপমানিত হয়? যাই হােক এই সামান্য অর্থে পােস্টার, ইস্তেহার প্রভৃতি চাপানাে হয় বিভিন্ন জেলার সংগঠনের জন্য দাও কর্মী প্রেরণ করা হয়।
সরকারি কর্মচারীর উপর চাপ : এই সময়ে সরকারি কর্মচারীদের উপর চাপ আসিতে থাকে। আন্দোলন যতই আগাইয়া যাইতে থাকে ইহারা ততই আন্দোলন হইতে সরিয়া পড়িতে থাকে।

আন্দোলনকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র : আন্দোলন এইভাবে দানা বাঁধিয়া গড়িয়া উঠার সঙ্গে সঙ্গে ইহাকে মূলেই পণ্ড করিয়া দিয়া ইহার মধ্যে দিয়া স্বার্থোদ্ধারে জন্য জোর চেষ্টা হইতে থাকে। সরকারি এজেন্ট বলিয়া সন্দেহ করা হইয়াছিল। এমন কয়েকজন লােক বড় বড় সংগ্রামী কথা বলিয়া সংগ্রাম পরিষদে ঢুকিবার চেষ্টা করিতে থাকে। তাহারা নানা রকম অবাস্তব কথা তুলিয়া ছাত্র ও কর্মীদের মধ্যে বিরােধ ও বিভেদ সৃষ্টির প্রয়াস পায়। অন্যদিকে কয়েকজন এম, এল, এ এই আন্দোলনকে কেন্দ্র করিয়া মন্ত্রিত্ব পাইবার জন্য মাতিয়া উঠেন। ইহাদের অনুসারী বহু ছাত্র ও এই কার্যে নিযুক্ত হইয়া ভাষা আন্দোলনকে তলাইয়া দিয়া ইহাকে মন্ত্রিত্ব সংকট আন্দোলনে পরিণত করার জন্য ইহারা উঠিয়া পড়িয়া লাগিয়া যায়। বলা বাহুল্য কিছুদিন আগে ও ইহারা ভাষা আন্দোলনকে অবাঞ্চিত বলিয়া মনে করিতেন। এই সময়ে বড় বড় বক্তৃতা দিয়া মােহাম্মদ আলী সাহেব, তােফাজ্জল আলী সাহেব ও নাহরুল্লা সাহেব প্রভৃতি এম, এল, এ বাংলা ভক্ত হইয়া ছাত্রদের মধ্যে খুবই জনপ্রিয় হইয়া ওঠেন।
তৃতীয় আর এক দল এই আন্দোলনকে সাবােটাজ করার চেষ্টা করে। বলা বাহুল্য ইহারা কোনাে কাজেই আগাইয়া আসে নাই, অথচ আন্দোলন যখন বেশ জমিয়া উঠিয়াছিল তখন ইহারা গােপনে পাকিস্তান বিরােধী ও ধ্বংসাত্মক কয়েকটি হ্যান্ডবিল ও পােস্টার দিয়া জনগণকে আন্দোলন বিরােধী করিয়া তােলে। জনসাধারণ তখন সন্দেহ করিতে আরম্ভ করে যে, এই আন্দোলন নিশ্চয়ই ভারতের
প্ররােচিত। এমনও হইয়াছে যে, কয়েকজন ছাত্র ফেডারেশন কর্মিকে উত্তরবঙ্গে প্রচারের জন্য যাতায়াত খরচ দিয়া পাঠানাে হইয়াছিল, কিন্তু ঐ কর্মিরা ভাষা আন্দোলনের জন্য কোনাে কাজই করে নাই, বরং সেই টাকার কোনাে হিসাব ও দিতে পারে নাই।
অপূর্ব মিলন : এইভাবে সরকারি গুপ্তচর মন্ত্রীত্ব লােভীরা এবং তথাকথিত প্রগতিশীলরা এবং জোট বাঁধিয়া ভাষা আন্দোলনকে সাবােটাজ করার কাজে লাগিয়া যায় এবং নানারূপ অবাস্তব প্রচার করিয়া জনমত বিভ্রান্ত করার চেষ্টা। করে। অনেক এমএলএ বড় বড় কথা বলিয়া নেতা হইয়াছেন এবং তারা আন্দোলনকে সুযােগে রাষ্ট্রদূতের পদ বা মন্ত্রিত্ব লাভ করেন জনাব মােহাম্মদ আলী ও জনাব তােফাজ্জল আলী সাহেব। ইহারাই মন্ত্রিত্ব পাইয়া প্রকাশ্যভাবে বাংলার বিরুদ্ধাচরণ করিতেও লজ্জা বােধ করেন নাই। সংগ্রাম পরিষদের পুনঃ সম্প্রসারণ : ইতিমধ্যে সংগ্রাম পরিষদের বিভিন্ন গ্রুপ এবং বিভিন্ন কলেজ ও স্কুলের প্রতিনিধি নিয়া ইহাকে আরও সম্প্রসারিত করা হয়।
ভাষা আন্দোলন ও সম্প্রসারণ : সত্য কথা বলিতে কি, সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে ছাত্র ও কর্মীদের এত চেষ্টা সত্ত্বেও জনসাধারণ এই আন্দোলনের বিরুদ্ধাচারণ করিতে থাকে। তাদের সঙ্গে যােগ হয় সরকারি প্রচার। অতি প্রগতিশীলদের কয়েকটি গােপন পােস্টারকে ভিত্তি করিয়া নির্লজ্জভাবে সরকার প্রচার করিতে থাকে যে ইহা রাষ্ট্রের শত্রুদের কাজ। ফলে জনসাধারণ আরাে ক্ষেপিয়া উঠে। এই সময়ে ইউনিভার্সিটি নিকটস্থ তমদ্দুন মজলিশের অফিসটি সম্মানীয় লােকেরা লুট করে প্রকাশ্যভাবে ভীতি প্রদর্শন করিয়া অফিসটি উঠাইয়া দেয়। ঢাকার জনসাধারণ ভাষা আন্দোলনের ফলে খুবই ক্রুদ্ধ হইয়া উঠে মজলিশ কর্মীদের ও ছাত্রদের এখন শহরে প্রবেশ একেবারে অসম্ভব হইয়া পড়ে। মজলিশ কর্মী মি: সিদ্ধি বাউলা (সলিমুল্লা হলের তৎকালীন জেনারেল সেক্রেটারী) ছদ্মবেশে বলিয়াদী প্রেসে হ্যান্ডবিল ছাপাইতে গিয়া কসাই টুলীতে বন্দী হন এবং তাঁহাকে কাটিয়া ফেলিবার মুহূর্তে জনৈক দয়শীল লােকের দ্বারা মুক্ত হইয়া পলায়ণ করিতে সমর্থ হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক আবুল কাসেম সাহেবের উপর কয়েকবার হামলা হয়। ঢাকা কলেজের অধ্যাপক আহসান সাহেবও কয়েকবার প্রহৃত হন। এইভাবে ছাত্র ও কর্মীরা রমনাতে অবরুদ্ধ হইয়া পড়ে।
বাংলা বিরােধী আন্দোলন : এই দিকে উর্দু সমর্থক আন্দোলন গড়িয়া উঠে। মৌলনা দীন মােহাম্মদ প্রভৃতিকে কেন্দ্র করিয়া বিভিন্ন মহল্লায় ও মফস্বলের বহুস্থানে উর্দুকে সমর্থন করিয়া বহু সভা করা হয়। ইহার কয়েক লক্ষ দস্তখত সংগ্রহ করিয়া কেন্দ্রীয় গভর্নমেন্টের কাছে এক মেমােরেন্ডাম পেশ করেন। পথে ঘাটে স্টিমারে ওই সই সংগ্রহ কার্য চলে সই সংগ্রহের পর কয়েকজন নাম করা লােক এরােপ্লেনে চড়ে করাচীতে তা পেশ করে আসেন।

হাস্যকর অপপ্রচার : ঢাকার ‘মর্নিং নিউজ’ ও সিলেটের যুগভেরী জঘন্যতমভাবে ভাষা আন্দোলনের বিরুদ্ধে লিখিতে থাকে। মর্নিং নিউজ সম্পাদকীয়তে ও চিঠিপত্র স্তম্ভে মজলিশকে রাষ্ট্রদ্রোহী প্রতিষ্ঠান বলিয়া ঘােষণা করে যুগভেরী, একদিন। এমনও লিখে যে, তমদদুন মজলিশ একটি ভয়ংকর বিপ্লবী প্রতিষ্ঠান ভাষা আন্দোলনের। ইহা ঢাকাতে সমান্তরাল গভর্নমেন্ট (Parallel Government) স্থাপন করিয়া ট্যাক্স আদায় করিতেছে।
বাংলাবিরােধী আন্দোলনে ছাত্রসমাজের একাংশ: ছাত্রসমাজের এক বিরাট অংশও তখন উর্দু সমর্থন আন্দোলনে যােগ দেয়। রায়সাহেব বাজার হইতে ছাত্র মিছিল বাহির করিয়া ঢাকা কলেজে আনা হয়। আন্দোলনের সমস্ত ব্যবস্থা ফজলুল হক হল হইতে ও শামসুল হুদার নেতৃত্বে এক ছাত্র মিছিল বাহির করা হয়। (তখনকার সৈনিক পত্রিকার বাক্য গঠনে অনেক সম্পূর্ণতা ছিল, আমরা অবিকল রাখলাম)।
আন্দোলন চলিতে থাকে: এত বিপত্তি সত্ত্বেও আন্দোলন চলিতে থাকে। সংগ্রাম পরিষদ ধর্মঘটে যােগ দেওয়ার জন্য রেল শ্রমিকদের সঙ্গে সংযােগ স্থাপন করেন। নির্দিষ্ট দিনে (তখনকার দৈনিক পত্রিকার বাক্য গঠনে অনেক অপূর্ণতা ছিল, আমরা অবিকল রাখলাম) ইউনিভার্সিটি প্রাঙ্গণে মিটিং হয়— মিটিং এর পর মিছিল বাহির হয়। মিছিলকে হাইকোর্ট পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ ও সুশৃঙ্খলভাবে আগাইয়া নেওয়া হয় কিন্তু ইতিমধ্যে মন্ত্রীত্ব লােভীদের সমর্থকেরা অন্যান্য স্যাবােটিয়াদের সঙ্গে মিলিয়া কতকগুলাে অশােভন কাজ করিয়া বসে বহু ঘণ্টা ধরিয়া সেক্রেটারিয়েট ঘিরিয়া রাখা হয় জনৈক মন্ত্রীকে সেক্রেটারিয়েট হইতে বাহির করা হয়। এবং তিনি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করিতে না পারিলে পদত্যাগ করিবেন বলিয়া লিখিতভাবে প্রতিশ্রুতি দিতে বাধ্য হন ও অগ্রিম পদত্যাগপত্র লিখিয়া দেন। ইতিমধ্যে এই খবর শহরে ছড়াইয়া পড়ে এবং এই খবর আসে যে কয়েক জন লুংগি পরা শহরের গুণ্ডা সেক্রেটারিয়েটে ঢুকিয়া পড়িয়াছে। তখন তাদের আক্রমণের ভয়ে ছাত্ররা সেক্রেটারিয়েট ছাড়িয়া চলিয়া যায়। এই সময়ে সংগ্রাম পরিষদের কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
পরদিন : পরদিন আবার মিছিল বাহির হয়। সেক্রেটারিয়েটের নিকট পুলিশ বাধা দেয়। ছাত্র পুলিশ সংঘর্ষ আরম্ভ হয়। পুলিশ লাঠিচার্জ করে ও বহুজনকে গ্রেপ্তার করে। অনেককে বাসে করিয়া তেঁজগাও নারায়ণগঞ্জে লইয়া ছাড়িয়া দেয়া হয়। এইদিকে খবর আসে আহসান মঞ্জিলের বাড়িতে নবাব সাহেবের বৈঠক হইয়া গিয়াছে লােকেরা ছাত্রদের শায়েস্তা করার জন্য হলগুলাে আক্রমণ করিয়া বসিবে।
অন্যান্য স্থানে আন্দোলন : সেক্রেটারিয়েটে ধর্মঘট করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তাহা অসফল হয় মাত্র। দ্বিতীয় দিন ভােরের বেলা চলন্ত ২/৩টি ট্রেন বন্ধ থাকে। কিন্তু পরে সমস্ত রেল আবার চলতে শুরু করে।

মফঃস্বলে : মফঃস্বল নােয়াখালীতে ও রাজশাহীতে হরতাল ও মিছিল সফলভাবে হয়। রাজশাহীতে ছাত্রেরা গ্রুপে বিভক্ত হয়। দলাদলি ভিত্তি করে কলেজ কর্তৃপক্ষ বাংলা ভাষা ভাষীদের উপর দারুণ নির্যাতন করে অনেকে গ্রেপ্তার হয়। দুই দলের মধ্যে মারামারি হয়। ইহাতে অনেকে আহতও হয়। চট্টগ্রামে সংগ্রাম পরিষদে যে। প্রস্তাবটি পাঠাইয়াছিল তাহা কোনাে কালেই কার্যকর হয়নি। কয়েকজন মজলিশ কর্মী লালদিঘী ও মেডিকেল স্কুলে মিছিল করা সম্ভবপরই হয়নাই। সিলেট গােবিন্দ পার্কে তখন তমদুন মজলিশ এক মিটিং করে। মিটিংয়ের সময় স্থানীয় গুন্ডারা হামলা করিয়া মিটিং এর উদ্যোক্তাদের দারুণভাবে প্রহার করে এবং স্টেজ ভাঙ্গিয়া ফেলে। অন্যান্য স্থানে ও কিছু অশান্তি ছড়াইয়া পড়ে। কিন্তু ইহা জনসাধারণের মধ্যে তেমন কোনাে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেনি। কেবলমাত্র ছাত্রদের মধ্যেই ইহা সীমাবদ্ধ ছিল। দোকানপাট বন্ধ করাও তখন হয় নাই।

সূত্র: ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ও দলিল – সাহিদা বেগম

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!