সৈনিক
বাংলা ভাষা ও হরফ হত্যার নতুন ষড়যন্ত্র
কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের সুযােগে কাজ সেরে নেবার মতলব?
ঢাকা: রবিবার,
২৮শে মে ৫০, ২য় বর্ষ
আবদুল গফুর
বাংলা ভাষা ও হরফ সম্বন্ধে সরকারের মনােভাব কিছুদিন ধরে খুবই অস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বিগত ঐতিহাসিক রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন থেকে যারা ব্যাপারটি লক্ষ করে আসছেন তারা সরকারের সাম্প্রতিক কতকগুলাে ব্যাপারে বিশ্বাসঘাতকতা ও ওয়াদা ভঙ্গের চরম নমুনা পাবেন সন্দেহ নাই। অবশ্য এ সম্বন্ধে আজ আমরা বেশি বলছি না কারণ এত সংক্ষেপে বিশ্বাসঘাতকতার সে দীর্ঘ ইতিহাস বলা সম্ভব নয়। আজ তাই একটু আধটু আভাস দিয়ে রাখছি মাত্র।
বাংলা ভাষা ও হরফকে চিরতরে কবর দিতে পূর্ব পাকিস্তানকে তান্দুনিক শৃংখল পরাতেই যে সরকার চূড়ান্তভাবে কোমর বেঁধেছেন, এইটাই আজকের সব চেয়ে স্পষ্ট ও তিক্ত সত্য। বিগত ঐতিহাসিক রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের কথা বাদই দিলাম কিছুদিন আগেও প্রদেশের বিভিন্ন স্থানে উর্দু হরফে বাংলা লেখার বিরুদ্ধে যে আন্দোলন হয়ে গেল তাতেও সরকার যে সব ওয়াদা ও কথা দিয়েছিলেন সে সব রক্ষা করবার বিশেষ প্রয়ােজনীয়তা ও অনুভব করছেন না বলেই মনে হয়। উর্দু হরফে বাংলা লিখবার চক্রান্তমূলক প্রস্তাবের বিপক্ষে যখন বিক্ষোভ ওঠে তখন সরকার জানালেন- না- বাংলা হরফ পরিবর্তনের প্রস্তাব তখনই বিবেচনা করা হচ্ছে না, এমন কি, যে কুড়িটি কেন্দ্রে পরীক্ষামূলক ট্রেনিং সেন্টার খােলার কথা ছিল তাও আপাতত স্থগিত রাখা হয়েছে। এই কথাকে বিশ্বাস করেই সেদিন আন্দোলনকারীরা আন্দোলন বন্ধ রেখেছিল। কিন্তু আজ যখন রােজা ও গরমের ছুটি বাবদ কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে গেছে, যখন ছাত্রেরা যার যার মতাে বিচ্ছিন্ন ভাবে গ্রামে চলে গেছে, তখন কর্তাদের দুষ্টবুদ্ধি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। তাঁরা হয়তাে দেখেছেন তাদের চক্রান্তকে সাফল্য মণ্ডিত করবার এই মাহেন্দ্র ক্ষণ বাধা দেবার বা প্রতিবাদ করবার মতাে তখন শহরে তাে আর সংঘবদ্ধ ছাত্র সমাজ নেই! তাই আজ আমরা দেখতে পাচ্ছি সরকার সাহস ভরে প্রকাশ করে ফেললেন যে, উর্দু হরফের সেন্টারগুলাে ইতিমধ্যেই ভােলা হয়ে গেছে। তাই আমরা আজ দেখতে পাই: জঘন্যভাবে ওয়াদা ভঙ্গ করে এমন কি ‘ভাষা কমিটির’ রায়ের অপেক্ষা না রেখে রাতারাতি কাজ হাসিলের আশায় এরা বিভিন্ন খবরের কাগজে উর্দু হরফে বাংলা বই লিখে দেওয়ার জন্য লেখকদের কাছে। ‘টেন্ডার আহবান করেছেন। শুধু তাই নয় পেছন হতে জাতিকে ছােরা মারবার আশায় গভর্নমেন্টের খরচায় নিরপেক্ষতার ভাওতা দিয়ে নামধামহীন বই (দূরদর্শী লিখি ‘হরফ সমস্যা ও Farsight লিখিত The script Question) লিখে চোরাই পদ্ধতিতে উর্দু হরফের পক্ষে প্রচার চালানাের চেষ্টা করা হচ্ছে। তাছাড়া রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সময় বাংলাকে প্রাদেশিক অফিসিয়াল ভাষা হিসেবে গ্রহণ ও কেন্দ্রের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে সুপারিশের যে ওয়াদা (তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দিন সাহেব কর্তৃক স্বাক্ষরিত ওয়াদা পত্রে) প্রাদেশিক সরকার করেছিলেন সে ওয়াদাও ভঙ্গ করবার প্রবৃত্তি বর্তমান সরকারের মধ্যে প্রবল বর্তমান সরকারের মধ্যে প্রবল হয়ে উঠেছে। শােনা যাচ্ছে উর্দুকে পূর্ববঙ্গের অফিসিয়াল ভাষা হিসেবে চালানাের পথ সাফ করবার উদ্দেশ্যে চিঠি পত্রাদি যথাসম্ভব উর্দুতে আদান প্রদানের সিদ্ধান্তও নাকি ইতিমধ্যেই গৃহিত হয়েছে। কিন্তু এই সংস্কৃতি হত্যার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে পূর্ব বঙের সুস্পষ্ট জনমত ও অন্তর্দাহী বিক্ষোভের খবর কর্তৃপক্ষ রাখেন। পাকিস্তানের প্রত্যকটি শুভেচ্ছাকামী চিন্তাশীল ব্যক্তিই এই হঠকারী চক্রান্তের বিরুদ্ধে তাঁদের সুচিন্তিত প্রতিবাদ জানিয়েছেন। তাই জনমত চেপে রাখবার উদ্দেশ্য নতুন করে এক ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। প্রকাশ; সরকার নাকি বিভিন্ন বিদ্যায়তনে বাংলা সমর্থক শিক্ষকদের সম্বন্ধে রিপাের্ট দেয়ার জন্য সম্প্রতি সার্কুলার জারী করেছেন। শােনা গেল সিলেট কলেজের জনৈক প্রবীণ সাহিত্যসেবী অধ্যাপককে বাংলা হরফ সমর্থনের অপরাধে প্রফেসারশিপের গ্রেড থেকে লেকচারশিপ গ্রেডে নামিয়ে দেয়া হয়েছে চাটগা কলেজের জনৈক সুবিজ্ঞ অধ্যাপককে, বাংলা হরফ সম্বন্ধে তাঁর স্বাধীন মতামত প্রকাশের দরুন নাকি ধমকিয়ে দেয়া হয়েছে। তাঁকে নাকি বলা হয়েছে উর্দু হরফে বাংলা লেখাটা স্টেট পলিসি’ একথাটা সরকারের নওকর’ হয়ে অধ্যাপক সাহেবের জানা উচিত ছিল। দুঃখের বিষয়- তখনাে আমরা জানি না। এটাই সত্যি আমাদের স্টেট পলিসি কিনা? এবং উপরােক্ত ঘটনাগুলাে সত্য কিনা? সরকার পক্ষ থেকে এসম্বন্ধে সুস্পষ্ট জবাব না পেলে আমরা ধরে নিতে বাধ্য হব— এগুলাে সত্য ঘটনা গুজব নয়।
আজ পূর্ব পাকিস্তানের আর্থিক সংকটের কথা কারাে অজানা নয়। লক্ষ লক্ষ মােহাজের রাস্তায় রাস্তায় খাদ্য, বস্ত্র ও গৃহের অভাবে কুকুর বেড়ালের মতাে ধুকে ধুকে মরছে।
মােহাজের সমস্যা সমাধানের জন্য যখন নাকি শিক্ষা সম্বন্ধীয় সবগুলাে পরিকল্পনাই কাগজ চাপা দিয়ে রাখা হয়েছে, তখন একটি সংস্কৃতি ঘাতক চক্রান্তকে কার্যকরী করবার জন্য চোরাই পদ্ধতিতে বেনামা প্রচার বইয়ের টেন্ডার আহবান করে আর তুঘলকী’ পরিকল্পনার ট্রেনিং সেন্টার খুলে লাখাে লাখাে টাকা এভাবে পানিতে ঢালবার অধিকার জনগণকে আর্থিক ও তামদুনিক শােষণের এ লাইসেন্স কর্তাদেরকে দিয়েছে এই কথাই আজ প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হয়। বঞ্চিত জনসাধারণ আর বিক্ষুব্ধ ছাত্র সমাজের পক্ষ থেকে আজ প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হয় বা আজ আমরা শাসন কর্তাদের শুধু একটা কথাই জানিয়ে রাখছি। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ আছে অতএব রােদ থাকতে শুকিয়ে নিতে পারবেন বলে কর্তাদের মনে এরকম কোনাে ক্ষীণ আশা থাকলেও তারা ভুল করেছে তার পুনরাবৃত্তি না করে জনসাধারণের সঙ্গে একগাট্টা হয়েই এবার তারা এই গুরুত্বপূর্ণ সংগ্রামে অগ্রসর হবে। ভাষা ও হরফের দাবি শুধু ছাত্রদের একলার নয় জনসাধারণের ও। এবং সংগ্রামী ইসলামি এই সম্বিলিত সংগ্রামের যে কোনাে চক্রান্ত তাদের ঘরের মতাে ধসে পড়তে বাধ্য!
সূত্র: ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ও দলিল – সাহিদা বেগম