আরবি হরফে বাংলা
মােহাম্মদ ওয়াজেদ আলী
বাংলা বাম ধার থেকে ডাইনে এবং আরবি ডান ধার থেকে বামে লেখা হয়, এটাকে বিশেষ কোনাে উল্লেখযােগ্য ব্যাপার না মনে করলেও চলে। কিন্তু এটা অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ সমস্যা যে, বাংলার সমস্ত বর্ণধ্বনি (Letter-sound) লিখবার জন্যে আরবি হরফ পাওয়া যায় না। বাংলা খ, গ, ঘ, ঙ, চ, ঝ, ঞ, ট, ঠ, ড, ঢ, থ, ধ, প, য, ড, ঢ, ং, ও ‘ র আওয়াজ আরবী হরফে লেখা সম্ভব নয়।।
এসব আওয়াজ আরবীতে লিখতে হলে নতুন হরফ তৈরি করে নিতে হবে, যেমন পারসি ভাষা এবং পরে হিন্দুস্তানী (বা উর্দু) ভাষা আরবী হরফে লেখার জন্যে করার প্রয়ােজন হয়েছিল। কিন্তু এই ঝামেলার সার্থকতা কি?
প্রাচীন ইরাণী ভাষা ইরাণে আরব বিজেতাদের রাজনৈতিক প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্বে তার নিজস্ব হরফে লেখা হতাে। ভারতবর্ষের হিন্দুস্তানি বা হিন্দি ভাষাও মুসলিম আমলদারির আগে তার নিজস্ব বর্ণমালা দেবনাগরীতে লেখার রেওয়াজ ছিল। মুসলিমরা রাজনৈতিক প্রাধান্যের শক্তিতে ইরাণের নিজস্ব বর্ণমালার প্রচলন বন্ধ করলেন এবং তার জায়গায় আরবি হরফ কাজে লাগালেন। কিন্তু ইরানি ভাষার সবগুলাে বর্ণধ্বনি আরবি হরফে লেখা সম্ভব না হওয়ায় তাঁরা আরবী বর্ণমালার ক’টী নতুন হরফ যােগ করলেন। এর ফল ফললাে তিনটা। প্রথমত ভিন্ন একটা ভাষার প্রয়ােজনে আরবি হরফের সংখ্যা বেড়ে গেল। দ্বিতীয়ত, প্রাচীন ইরাণী বর্ণমালা, যারা আরবি হরফের তুলনায় ইরানি ভাষার পক্ষে বেশি উপযােগী এবং ইরানি ভাষার ব্যাকরণের দাবি পূরণ করতে বেশি সক্ষম ছিল, তা চিরদিনের জন্যে নির্বাসিত হলাে।
তৃতীয়ত আরবি হরফের নিজস্ব প্রকৃতির জন্যে ইরানি ভাষার বহু শব্দের উচ্চারণে ধ্বনিক বিশুদ্ধতা (phonetic correctness or exactitude) রক্ষা অনিশ্চিত হয়ে পড়ল। ভারতীয় হিন্দুস্তানি বা হিন্দি ভাষার বেলাতেও এই সব ফল ফলল; তবে মুসলিমদের প্রভুত্ব-শক্তির প্রবলতা সত্ত্বেও তার নিজস্ব বর্ণমালা, দেবনাগরী, নির্বাসিত হলাে না; কেননা মুসলিম অধিকারের পূর্বে ভারতবর্ষ যাদের দেশ ছিল, সেই বিরাট, সুশিক্ষিত ও কৃষ্টি সম্পন্ন হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্ম ভাষা সংস্কৃতের বর্ণমালা ছিল দেবনাগরী!
জগতে আরাে দুটি ভাষা আরবী হরফে লেখার চেষ্টা কার্যকরী হয়েছিল।
একটা হলাে ভারতের পশ্চিম প্রান্তবর্তী সিন্ধীভাষা; অন্যটা তুরস্কের তুর্কী ভাষা। এ দু’টো ভাষাতেও আরবি হরফ প্রবর্তনের ফল ইরানি ও হিন্দী ভাষার মতােই ফলেছিল। …
বাংলা ভাষায় আরবী হরফ চালু করার জন্যে যারা ওকালতী করছেন, আশ্চর্যের বিষয়, তাঁরা এর পক্ষে কোনাে বৈজ্ঞানিক যুক্তি উপস্থিত না করে শুধু পূর্ববংগের সংখ্যাবহুল লােকদের ধর্মান্ধতা জাগিয়ে তুলতে চেষ্টা পাচ্ছেন। তাঁরা বলছেন, হরফুল্ কোরআন- মানে, কোরআনের হরফে আমাদের মাতৃভাষা লিখতে হবে। এ-রকম কথায় ভাষা তত্ত্বে অজ্ঞ ও বৈজ্ঞানিক বুদ্ধি থেকে বিচ্ছিন্ন ধর্মান্ধ লােকরাই ভিজতে পারে, আর কেউ নয়। কোরআন আমাদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ। হলেও সেই কারণে আরবি ভাষা বা আরবি হরফ পবিত্র হয়ে পড়ে কেমন করে, বােঝা শক্ত। আর যদি আরবি ভাষা বা হরফ পবিত্রই পরে নেয়া যায়, তার জন্যে আরবি থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র গােষ্ঠীভুক্ত ভাষা বাংলা সেই হরফে লিখতে হবে এমন কথা আসে কোত্থেকে? তা হলে চীন, রাশিয়া, উত্তর ও দক্ষিণ ভারত এবং অন্যান্য অন্-আরবিভাষী দেশে যে কোটি কোটি মুসলিম রয়েছে, তাদের মাতৃভাষাগুলােও আরবি হরফে লেখা ফরজ’ হয়ে দাঁড়ায়! কিন্তু এমন অদ্ভুত কর্মকে তারা ফরজ’ মানতে রাজী হবেন কি? যদি রাজী না হন এবং রাজী না হলেও যদি তাদের দ্বীনদারী বজায় থাকে, তা হলে ধর্মন্ধতাকে উস্কানি দিয়ে তার প্রমত্ততার সাহায্য নিয়ে আমাদের পূর্ব পাকিস্তানিদের বেচারী মাতৃ-ভাষার ওপর জীবনঘাতী অস্ত্রোপচারের এ অপচেষ্টা কেন? …
দিলরুবা, অগ্রহায়ণ, ১৩৫৮
সূত্র: ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ও দলিল – সাহিদা বেগম