You dont have javascript enabled! Please enable it!

১৯৫২ সালের আন্দোলনের মূলে

সৈনিক, ১৯৫৩
পূর্ব বাংলার খাজা নাজিমুদ্দিন
যাকে বলে কপাল খুলে গেল। খুলে গেল জনাব লিয়াকত আলীর হত্যায়। পূর্ববাংলাকে গৌরবান্বিত করে খাজা নাজিমুদ্দিন হলেন উজিরে আযম-সঙ্গে সঙ্গে সিভিল সাপ্লাই মন্ত্রী নূরুল আমীন সাহেবেরও কপাল বিস্তৃত লাভ করল অসম্ভব রূপে।
এমন গৌরবান্বিত পদ নিয়ে পূর্ববাংলার একবার দর্শন দেওয়া নেহায়েত দরকার। প্রতিটি পূর্ব বঙ্গবাসী তাঁর শুভদর্শনের জন্য অপেক্ষা করে নিশ্চয়। তিনি আসলেন। রাজকীয় সম্বর্ধনার ব্যবস্থায় ত্রুটি হল না। যে রাস্তা দিয়ে তিনি যাবেন— এক ঘণ্টা পূর্ব থেকে সে সব রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হলাে। আমিরুল মােমেনিন হিসেবে খাজা সাহেব স্মিত হাস্যে পূর্ববঙ্গ সফর করলেন। ২৭ শে জানুয়ারি। পুরাননা পল্টনে বিরাট জনসভার আয়ােজন করা হল। খাজা তার খােতবা ফরমালেন। নিমকহারাম তিনি নন। করাচীর রাজধানীর প্রধানমন্ত্রী তিনি। সুতরাং ঘােষণা করলেন তিনি সুউচ্চ মঞ্চ থেকে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা হবে একমাত্র উর্দু।’ তিনি আরও বলেন পূর্ববঙ্গে ও উর্দু হরফে বাংলা লেখা সফল হয়েছে।’
কিন্তু বড় নফরমান পূর্ববাংলার ছাত্রগণ প্রশান্ত ঢাকা নগরী খাজা সাহেবের আস্ফালনে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল। ২৯শে তারিখে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবাদ সভা হলাে। ৩০ তারিখে ছাত্রগণ প্রতীক ধর্মঘট করে বিরাট শােভাযাত্রা বের করে করল। ৩১ তারিখে পূর্ব পাক মুসলিম ছাত্র লীগ বার লাইব্রেরি হলে এক সভা আহবান করল সেই সভায় পূর্ব-পাক ছাত্র লীগ, তমদুন মজলিস আওয়ামী লীগ, নিখিল পূর্ব পাক ছাত্র লীগ যুব লীগ ও ইসলামী ভ্রাতৃসঙ্ প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি নিয়ে ‘কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হলাে। ছাত্রলীগের কাজী গােলাম মাহবুব সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক নিযুক্ত হলেন। ৪ ফেব্রুয়ারিতে ব্যাপক ধর্মঘট ও হরতালের সিদ্ধান্ত গৃহীত হলাে-ঐ সভাতেই। ধীরে ধীরে পূর্ববাংলা মহাআন্দোলনের দিকে এগিয়ে চলল নাজিমুদ্দিন সাহেবের হটকারিতাপূর্ণ আস্ফালত্রে সমুচিত জবাব দেবার জন্যই।
প্রথম ভাষা আন্দোলনের আর ও দুটী দলিল
রক্তাক্ত বিবৃতিটি ১৯৪৮ সনের ১৬ ফেব্রুয়ারিতে সংবাদপত্রের উপর জন্ম দেওয়া হয়েছিল। ইহাতে স্বাক্ষর করিয়াছিলেন অধ্যাপক নুরুল হক। (প্রথম সংগ্রাম কটির কনভেনার ও তখনকার তমদদুন মজলিশ বাসী।
অধ্যাপক এম, এ কাসেম (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)
অধ্যাপক রেআয়ৎ খাঁ (‘)
অধ্যাপক সরদার ফজলুল করিম (‘)
আজিজ আহমদ
আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী (তখনকার সাপ্তাহিক ইনসাফের সম্পাদক)
এম আবুল খায়ের
নইমুদ্দীন আহমদ (ছাত্র)
এবং আর ও কয়েকজন।

চির নকল
আমরা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের নিকট আবেদন জানাই তারা যেন বাংলা ভাষার স্বীকৃতির জন্য আগাইয়া আসেন। মাতৃভাষাকে কোণঠাসা করার জন্য যে একটি সূক্ষ্ম ষড়যন্ত্র চলছে তার বিরুদ্ধে আমাদের এখন হইতে তৎপর হওয়া আবশ্যক হইয়া পড়িয়াছে। দুর্ভাগের বিষয় এখানে সংবাদপত্র ও শিক্ষিত এখনাে এ ব্যাপারে সম্যক অবহিত বলিয়া মনে হয় না। আমরা সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করিতেছি। আমাদের মনে রাখা উচিত দেশব্যাপী এক আন্দোলন গড়িয়া তােলা ছাড়া বাংলা ভাষা যথার্থ মর্যাদা পাইবে না।
আরও একটি বিষয় আমরা পূর্ব পাকিস্তানের হিতাকাক্ষীদের বাসনা করিতেছি। সমস্ত প্রদেশ ব্যাপী আন্দোলন করিতে আমাদের অনেক অর্থের দরকার বাংলাভাষার প্রচার করিতে ইতিপূর্বেই তমদ্দুন মজলিশের অনেক অর্থের ক্ষতি হইয়াছে। বিবেচনা করিয়া তমদুন মজলিশের কেন্দ্রীয় পরিষদ একটি বাংলা প্রচার তহবিল খুলিবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়াছে। এই ফান্ডে যােগদান প্রস্তাব গৃহীত হইলে যুক্তরাষ্ট্রীয় আইনসভা রাষ্ট্রের প্রধানকে তাঁহার পদ হইতে অপসারণ করিতে পারিবেন। তবে ওই প্রস্তাবে উভয় পরিষদের মােট সদস্য সংখ্যার অন্যূন দুই তৃতীয়াংশের সমর্থন থাকিতে হইবে।
রাষ্ট্রের প্রধান তাহার নিজ দায়িত্বে নিম্মলিখিত ক্ষমতা প্রয়ােগ করিবেন।
(১) পবিত্র কোরানশরীফ এবং সুন্নায় নিষিদ্ধ না হইলে পাকিস্তানের সর্বত্র অনুকম্পা প্রদর্শনের ক্ষমতা।
(২) নির্বাচন কমিশন এবং নির্বাচনী ট্রাইবুন্যাল নিয়ােগ।
মন্ত্রি পরিষদ রাষ্ট্রের প্রধানই প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁহার মন্ত্রিসভার অন্যান্য সদস্য নিয়ােগ করিবেন। লােক পরিষদের (নিম্ন পরিষদ) নির্বাচিত সদস্য প্রধানমন্ত্রী হইবেন। স্টেটমন্ত্রী, ডেপুটিমন্ত্রী এবং পার্লামেন্টারি সেক্রেটারিগণ মন্ত্রিসভার সদস্য বলিয়া গণ্য হইবেন।
প্রধানমন্ত্রী ও তাহার মন্ত্রিসভার অন্যান্য সদস্যের কার্যাবলি রাষ্ট্রের প্রধানের উপর নির্ভর করিবে। মন্ত্রিসভা অথবা মন্ত্রীপরিষদ কেবল মাত্র তােক পরিষদের নিকট সম্মিলিত দায়ী থাকিবেন। মন্ত্রী নিয়োেগ অথবা তাহাদিগকে বরখাস্ত করণের ব্যাপারে রাষ্ট্রের প্রধানের কার্যাবলী আদালতে উত্থাপন করা চলিবে না।
আইন সভা :
যুক্তরাষ্ট্রীয় আইনসভায় দুইটি পরিষদ থাকিবে, যথা: ইউনিট পরিষদ (House of unit উচ্চ পরিষদ) এবং লােক পরিষদ (House of Reopen নিম্মপরিষদ)।

ইউনিট পরিষদ
ইউনিট পরিষদের সদস্য সংখ্যা ১২০ জন। ইহার মধ্যে ৬০ জন পূর্ববঙ্গের ব্যবস্থা পরিষদ কর্তৃক নির্বাচিত হইবেন। অবশিষ্ট ৬০ জন সদস্য করাচীসহ পশ্চিম পাকিস্তানের সকল ইউনিট হইতে নির্বাচিত হইবেন। পশ্চিম পাকিস্তানের ৬০ জন নির্বাচিত হইবেন এই ভাবে; পঞ্জাব ২৭ জন, সিন্ধু ৮ জন, সীমান্ত প্রদেশ ৬ জন উপজাতি এলাকা ৫ জন, বাদওয়াল ৪ জন বেলুচিস্তান ২ জন, বেলুচিস্তান দেশীয় রাজ্য- ২ জন, খয়েরপুর রাজ্য-২ জন এবং ফেডারেশন রাজধানী ২ জন। যে সব ইউনিটে ব্যবস্থা পরিষদ আছে ব্যবস্থা পরিষদই সেখান হইতে ইউনিট পরিষদে সদস্য নির্বাচন করিবে। আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের নীতি অনুযায়ী একক হস্তান্তরযােগ্য ভােটে এই সদস্য নির্বাচিত হইবেন। করাচীতে মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের সদস্য এবং নিম্ন পরিষদের নির্বাচিত সদস্যগণের মারফত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে।

সদস্য সংখ্যার সমতা
ইউনিট পরিষদে পূর্বে ও পশ্চিম পাকিস্তানের সদস্য সংখ্যার যে সমতা থাকিবে তা কোনাে ক্রমেই ক্ষুন্ন করা যাইবে না।
কেহই একসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রীয় আইনসভার উভয় পরিষদের সদস্য যুক্তরাষ্ট্রীয় আইনসভার উভয় পরিষদের সদস্য যুক্তরাষ্ট্রীয় আইনসভা ও ইউনিট বা দেশীয় রাজ্য (Federated state) ব্যবস্থা পরিষদের সদস্য হইতে পারিবেন না। এতদ্ব্যতীত কোনাে লােক এক সঙ্গে ইউনিট পরিষদ ব্যবস্থা ও রাজ্য পরিষদের সদস্য হইতে পারিবেন না। ইউনিট পরিষদ সদস্যদের অযােগ্যতা নির্ধারণ সম্পর্কে রিপােটে পাঁচটি ধারা উল্লেখ করা হইয়াছে।
লােক পরিষদ
কেন্দ্রীয় আইনসভার লােক পরিষদের সদস্য সংখ্যা হইবে ৪০০ শত। পূর্ববঙ্গ হইতে ২০০ শত সদস্য সরাসরি নির্বাচিত হইবেন এবং দেশীয় রাজ্য গুলিসহ পশ্চিম পাকিস্তান হইতে ২০০ নির্বাচিত হইবেন।
পূর্ববঙ্গের আসন : মুসলমান ১৫৩, তফশিলী, ২৪, বর্ণ হিন্দু ২, খ্রিস্টান ১, বৌদ্ধ ২।।
পশ্চিম পাকিস্তানের আসন : মুসলমান ১৯৪, তফসিলী (সিন্ধু) ২ খ্রিস্টান, (পাঞ্জাব) ২, বর্ণহিন্দু (সিন্ধু) ১. পার্শী (করাচী (১) | (১) জুনাগড় ও কাশ্মীর হইতে আসনের সমতা রক্ষা করিয়া আইনসভা কর্তৃক সদস্য নির্বাচিত হইবে।
ভােটাধিকার : প্রত্যেক ২১ বৎসর বয়স্ক পাকিস্তানই তােক পরিষদ নির্বাচনে ভােট দিতে পারিবে।
মেয়াদ ও যুক্ত বৈঠক : যুক্তরাষ্ট্রের আইনসভার কার্য কালের মেয়াদ ৫ বৎসর (১) আইনসভার দুই পরিষদের বিরােধ (২) রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচন (৩) যুক্ত অধিবেশনের নিয়মাবলী ও কর্মচারী নিয়ােগ ব্যাপারে যুক্ত অধিবেশন আহবান করা যাইবে।
অর্ডিন্যানস : আইনসভার অধিবেশন বন্ধ থাকিলে রাষ্ট্রের প্রধান অর্ডিন্যাস জারী করিতে পারিবেন।
ইউনিট : প্রত্যেক ইউনিটের একজন প্রধান থাকিবেন তিনি পাকিস্তানের নাগরিক হইবন। কার্যকাল রাষ্ট্রপ্রধানের ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল, মেয়াদে ৫ বৎসরের অধিক নয়। প্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্য মন্ত্রীর কার্যকাল ইউনিট মন্ত্রীর ইচ্ছাধীন।।
মুসলমান মন্ত্রীর শপথ: কেন্দ্রীয় ও ইউনিট মন্ত্রীগণ ব্যক্তিগত জীবনে ও সরকারি কাজে বহাল থাকা কালে কোরান ও সুন্নাহর মােতাবেক দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করিতে চেষ্টা করিবেন মর্মে শপথ করিতে হইবে।
সদস্যর যােগ্যতা : ইউনিট সদস্যদের যােগ্যতার গুরুত্বপূর্ণ ২টি শর্ত (১) ২৫ বৎসর বয়স্ক হইতে হইবে (২) কোনাে ভাষায় লিখিবার ও পড়িবার সামর্থ্য থাকিতে হইবে।
এলাকা : ফেডারেশন রাষ্ট্রের প্রধান কর্তৃক শাসিত তিনটি এলাকা থাকিতে (১) শাসন সংস্কার বহির্ভূত এলাকা (২) আংশিক শাসন সংস্কার বহির্ভূত এলাকা এবং উপজাতীয় এলাকা। | ইউনিট ও ফেডারেশন সম্পর্ক : (১) যে বিষয়ে কেবলমাত্র কেন্দ্রীয় আইনসভার বক্তব্য আইনে প্রণীত হইবে (৩) যে বিষয়ে কেন্দ্রীয় আইনসভা ও ইউনিট পরিষদ কর্তৃক আইন-প্রণীত হইবে। এইগুলাে যথাক্রমে ফেডারেল ইউনিট ও সম্মিলিত তালিকা বলিয়া অভিহিত হইবে। | বিরােধের ক্ষেত্রে ইউনিট আইন যাহাতে ফেডারেল আইনের আওতায় থাকে তাহার ব্যবস্থা করিতে হইবে। পারস্পরিক বিরােধ প্রধান বিচারক কর্তৃক গঠিত ট্রাইবুন্যাল মীমাংসা করিতে হইবে ইহাতে রাষ্ট্রের প্রধান এক বা একাধিক কাউন্সিল গঠন করিতে পারিবেন না। * বিচার বিভাগ : পাকিস্তানে একটি সুপ্রিম কোর্ট থাকিবে, প্রধান বিচারপতিসহ দুই-জনের কম বা ৬ জনের বেশি নয় বিচারক থাকিবেন।
ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন : গভর্নমেন্ট ভাষা আন্দোলনের সব দাবি মানিয়া লইতে রাজী এই মর্মে আলােচনা করার জন্য নাজিমুদ্দিন সাহেবের একটি অনুরােধ পত্র ও সংগ্রাম পরিষদের কাছে পেশ করা হয়। সংগ্রাম পরিষদ প্রথমে ইহা। প্রত্যাখ্যান করেন। পরে তাঁহাদের দাবি মানিয়া লওয়ার প্রতিশ্রুতি পাওয়ার পর। তাহারা আলােচনা করিতে সম্মত হন। | নাজিমুদ্দিন সাহেবের সঙ্গে সংগ্রাম পরিষদের দুইটি বৈঠক হয়। সংগ্রাম পরিষদ নিম্মলিখিত শর্তগুলাে নাজিমুদ্দিন সাহেবের কাছে পেশ করেন—
১. অবিলম্বে বাংলাকে পূর্ববঙ্গের সরকারি ভাষা, আদালতের ভাষা ও শিক্ষার | মাধ্যমে বলিয়া ঘােষণা করিতে হইবে।।
২. কেন্দ্রীয় গভর্নমেন্ট যাহাতে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকার নেয়— তজ্জন্য পূর্ববংগ ব্যবস্থা পরিষদকে একটি প্রস্তাব পাস করিয়া কেন্দ্রীয় গভর্নমেন্টের নিকট পাঠাইতে হইবে।
৩. ভাষা আন্দোলনের সময়ে ইত্তেহাদ, অমৃতবাজার আনন্দবাজার যুগান্তর
প্রভৃতি পত্রিকার উপর যে নিষেধাজ্ঞা আরােপ করা হইয়াছে তাহা
উঠাইয়া লইতে হইবে।
৪. ভাষা আন্দোলনের সময়ে যাহারা বন্দি হইয়াছে তাহাদিগকে বিনা শর্তে | মুক্তি দিতে হইবে।
৫. ভাষা আন্দোলনে জড়িত ছিল বলিয়া কোনাে সরকারি কর্মচারীকে
কোনাে রকমের শাস্তি দেওয়া চলিবে না।
৬. প্রেস নােট বাহির করিয়া সরকার স্বীকার করিবেন যে, ভাষা আন্দোলন।
কোনমতেই রাষ্ট্রের শত্রুদের দ্বারা পরিচালিত হয় নাই।
৭. ভাষা আন্দোলন দমাইবার জন্য সরকার যে কার্যক্রম লইয়াছে তজ্জনা
প্রকাশ্যে নাজিমুদ্দিন সাহেবকে ক্ষমা চাহিতে হইবে। বহু বাদ প্রতিবাদের পর নাজিমুদ্দিন সাহেব ২, ৪, ৫ ও ৭ ছাড়া অন্য চারটি দাবি মানিয়া নেন। ২নং দাবি সম্বন্ধে তিনি বলেন, ইহা কেন্দ্রীয় গভর্নমেন্টের পক্ষে কিছু করা সম্ভবপর নয়। ৪নং শর্ত সম্বন্ধে তিনি বলেন— কয়েকটি পত্রিকা বন্ধ করা হইয়াছে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। লিখিয়াছে বলিয়া, ভাষা আন্দোলনের জন্য নয়। ৫নং শর্ত সম্বন্ধে তাহার বক্তব্য ছিল সরকারি কাজে শৃঙ্খলা রক্ষা করিতে হয়- না হয় রাষ্ট্র চালানাে সম্ভবপর নয়। ৭নং সম্বন্ধে তিনি বলেন- প্রকাশ্যে দুঃখ প্রকাশ্য করা তাঁহার পক্ষে অবমাননাকর। তিনি সংগ্রাম পরিষদ ঘােষণা করেন সমস্ত শর্ত মানিয়া না লইলে কিছুতেই আন্দোলন প্রত্যাহার করা হইবে না। ইহাতে প্রথম বৈঠকের আলােচনা ব্যর্থ হয়।
পুনরায় নাজিমুদ্দিন সাহেব সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে আলােচনার মিলিত হন। দ্বিতীয় বৈঠকে ও অনেকক্ষণ ধরিয়া তর্কাতর্কি চলে। কিন্তু সংগ্রাম পরিষদের প্রতিনিধিগণ শেষ পর্যন্ত তাঁহাদের আটদফা শর্তে অনমনীয় থাকেন। ফলে নাজিমুদ্দিন সাহেবকেই সংগ্রাম পরিষদের সমস্ত দাবি মানিয়া লইতে হয়। সঙ্গে সঙ্গে এই ৮ দফা শর্তকে কেন্দ্র করিয়া এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই দিকে সংগ্রাম পরিষদ অন্যদিকে গভর্নমেন্টের পক্ষে নাজিমুদ্দিন সাহেব চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেন।
ভাষা আন্দোলনের সাফল্য : বলা বাহুল্য, সংগ্রাম পরিষদের শর্তগুলাে যে নাজিমুদ্দিন সাহেব মানিয়া লইবেন তাহা কেহ ভাবিতে পারে নাই। অধিকন্তু সেদিনকার আন্দোলন ১৯৫২ সনের মত এত ব্যাপক আকার ধারণ করে নাই, রিরাট জনসমাজ ছিল ভাষা আন্দোলনের বিরুদ্ধে। ছাত্র সমাজের এক অংশ থাকে ইহার বিরােধী। সরকারি কর্মচারীরা এ আন্দোলনে আগাইয়া আসে নাই, মফঃস্বলের অনেক জায়গাতেই আন্দোলন সাফল্যমণ্ডিত হয়। বহু স্থানে বাংলা বিরােধী আন্দোলন হয়। তবু কেন নাজিমুদ্দিন সরকার সংগ্রাম পরিষদের কাজে মাথা নত করিল, তাহার বিশ্লেষণ দরকার।
প্রথমত, তখনকার সময়ে গভর্নমেন্ট ছাত্রদের ভয় ও শ্রদ্ধা করিয়া চলিত। প্রধানত ছাত্রদের সাহায্যেই পাকিস্তান আন্দোলনে মন্ত্রী বা এম- এল- নেতৃত্ব পাইয়াছিলেন। সুতরাং তাহাদিগকে এতে শীঘ্র খেপাইয়া তুলিতে তাঁহারা সাহস পান নাই।
দ্বিতীয়ত, কায়েদে আযম মি. জিন্নাহ আসিয়া যদি পূর্ব পাকিস্তানের বিশৃঙ্খলা শান্ত করিতে নাজিমুদ্দিন সরকারকে অক্ষম দেখেন তাহা হইলে মন্ত্রীমণ্ডলীর অক্ষমতা প্রকাশ পাইবে- এই ভয়ে ও তাড়াতাড়ি চুক্তি করিবার প্রয়ােজন ছিল।
তৃতীয়ত, আমাদের মন্ত্রী ও সেক্রেটারিয়েটের শাসকেরা এখন পর্যন্ত জাদরেল শাসক (বুরােক্রাট) বনিয়া যায় নাই। কঠোর কোনাে নীতি প্রয়ােগ করিতে তাহাদের এখনাে দ্বিধা করিতে হইত।
অনেকে বলেন, নাজিমুদ্দিন সাহেব উর্দু সমর্থক হইলেও ব্যক্তিগতভাবে তিনি বিশৃংখলা ভয় করিয়া চলেন বলিয়াই তাড়াতাড়ি চুক্তিতে সম্মত হইয়াছিলেন।
চুক্তি না হইলে কি হইত? : চুক্তি না হইলে আন্দোলন সম্পূর্ণ অসাফল্যে পর্যবসিত হইত। পূর্বেই বলা হইয়াছে—আন্দোলনের পেছনে এখন জনমত সুসংগঠিত হয় নাই। অনেকেই নিরপেক্ষ বা বিরােধী ছিল। গভর্নমেন্ট কঠোর নীতি প্রয়ােগ করিলেই আন্দোলনের সঙ্গে তুলনীয়।
অন্যদিকে আহসান মঞ্জিলে ঢাকার জনসাধারণকে নিয়া সিদ্ধান্ত গৃহীত হইতে ছিল। যদি কায়েদে আযমের আসার পর ও ছাত্রেরা আন্দোলন চালায় তাহা হইলে কিছু সংখ্যক লােক যাইয়া দলগুলাে আক্রমণ করিয়া আন্দোলনকারীকে শায়েস্তা করিবে। আন্দোলনকারীরা কায়েদে আযমকে অপমান করিয়াছে ইহা প্রচার করিয়া আন্দোলনকে সম্পূর্ণরূপে পর্যদস্ত করা হইত। ফল হইত এই যে, ভবিষ্যতে কোনাে আন্দোলন সহজে গড়িয়া উঠিতে পারি না। আর সংগ্রাম পরিষদে পরিষদ গভর্নমেন্টের দুর্বলতার সুযােগ গ্রহণ না করিলে আন্দোলনের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতাই করিতেন যাহারা বন্দি হইয়াছিল তাহারা মুক্তি পাইত না। সহযােগিতাকারী সরকারি কর্মচারীদের কঠোর শাস্তি হইত। পূর্ববাংলায় ও বাংলার স্বীকৃতি হইত।।
চুক্তির পর: যে কয়েক শত লােককে বন্দি করা হইয়াছিল— চুক্তির পর তাহাদের মুক্তির আদেশ দেওয়া হয়। ভারতের যে সমস্ত পত্রিকার উপর নিষেধাজ্ঞা ছিল তাহাও উঠাইয়া লওয়া হয় সরকারের পক্ষ হইতে ভাষা আন্দোলনকারীদের প্রতি যে দুর্ব্যবহার করা হইয়াছে নাজিমুদ্দিন সাহেব তজ্জন্য দুঃখ প্রকাশ করিয়া বিবৃতি দেন। আন্দোলনটি যে রাষ্ট্রদ্রোহীদের দ্বারা পরিচালিত হয় নাই তাহাও তিনি বিবৃতিতে স্বীকার করেন। সরকারি কর্মচারীদের শাস্তির জন্য যে কর্মনীতি গ্রহণ। করা হইয়াছিল তাহা বাতিল করিয়া দেন। উপরন্ত তিনি আরাে ঘােষণা করেন যে পববর্তী (বাজেট) অধিবেশনই বাংলাকে পূর্ববঙ্গের সরকারি ভাষা আদালতের ভাষা ও শিক্ষার মাধ্যমে করার প্রস্তাব এবং ইহাকে কেন্দ্রের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার সুপারিশ গৃহীত হইবে।
বিভিন্ন পত্রিকায় অভিনন্দন : চুক্তির শর্তাবলী বিভিন্ন পত্রিকার বড় বড় হেডলাইনে প্রকাশিত হয়। প্রায় পত্রিকাই এই সাফল্যের জন্য সংগ্রাম পরিষদকে অভিনন্দন জানাইয়া সম্পাদকীয় লিখেন। ভাষা আন্দোলনের সর্বশ্রেষ্ঠ সমর্থনকারী ইত্তেহাদ। তাহার প্রধান সম্পাদকীয়তে বলেন বিরাট শক্তি ও দুর্জয় বিরােধিতার মধ্যে সংগ্রাম করিয়া বাংলাভাষা আন্দোলনকারীগণ যে সাফল্য লাভ করিয়াছেন। তাহা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকিবে।
কায়েদে আযমের আগমন : অতঃপর কায়েদে আযম ঢাকায় আগমন করেন। রেসকোর্স ময়দানে কয়েক লক্ষ লােকের সামনে বক্তৃতায় তিনি পূর্ব বাংলার সরকারি ভাষা এখানের জনসাধারণই ঠিক করিবে বলিয়া মন্তব্য করেন। কিন্তু কেন্দ্রীয় রাষ্ট্র ভাষা যে উর্দু হইবে তাহা জোরের সহিত বলিয়া যান। এই সময়ে সংগ্রাম পরিষদ কায়েদে আযমের সঙ্গে সাক্ষাৎ করিয়া তাহাকে রাষ্ট্রভাষা বাংলাকেও গ্রহণ করার পক্ষে যুক্তি দিতে থাকলে কায়েদে আযমের সঙ্গে সংগ্রাম পরিষদের সদস্যদের বহুক্ষণ তর্কবিতর্ক হয় ও শেষে আলােচনা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
অ্যাসেম্বলির অধিবেশন : ইহার পরই অ্যাসেম্বলির অধিবেশনে মি: নাজিমুদ্দিন সরকারের পক্ষ হইতে চুক্তির অন্যতম দাবি অনুযায়ী এক প্রস্তাব পেশ করেন। ইহাতে বাংলাকে পূর্ববাংলার সরকারি ভাষা, আদালতে ভাষা ও শিক্ষার মাধ্যমে করার প্রস্তাব করা হয়। কংগ্রেস সদস্যগণ সহ সকলে ও প্রস্তাব সমর্থন করার পর সর্বসম্মতিক্রমে তাহা গৃহীত হয়।
বিশ্বাসঘাতকতা : কিন্তু কেন্দ্রীয় গভর্নমেন্টের নিকট বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার জন্য যে প্রস্তাব পাস করার কথা ছিল তাহা নাজিমুদ্দিন সাহেব উপস্থাপনই করেন নাই। সংগ্রাম পরিষদ তাহার কাছে ইহার কৈফিয়ত করিলে। নাজিমুদ্দিন সাহেব বলেন কায়েদে আযম, যাহাকে জাতির পিতা বলা যায় তিনি বলে গিয়াছেন যে, উর্দুই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হইবে। অতএব তিনি এ প্রস্তাব পাস করেন, তাহা কায়েদে আযমের প্রতি অনুগত প্রদর্শন করা হইবে না। আর চুক্তির এই ধারা পালনে তিনি অক্ষম, সংগ্রাম পরিষদ চুক্তি ভঙ্গের জন্য নাজিমুদ্দিন সাহেবকে দায়ী করে।।
পুনরায় আন্দোলনের চেষ্টা : ইহার পর সংগ্রাম পরিষদ কেন্দ্রে ও যাতে বাংলা ভাষা স্বীকৃতি পায় তজ্জন্য আন্দোলন করার আহবান জানান এবং গণপরিষদের নানা কর্ম পদ্ধতি গ্রহণ করেন কিন্তু এবার আন্দোলনে কেহ এগিয়ে আসতে রাজী হল না।
কারণ নিম্মরূপ:
১. কায়েদে আযমের আগমনের পর তাহার বক্তৃতায় ও ব্যক্তি ছাত্রদের
অনেক এবং জনসাধারণ আন্দোলনের বিরােধী হইয়া পড়েন।
২. অনেকে তখন মনে করে থাকে যে, আবার আন্দোলন মানে কায়েদে
আযমকে অপমান করা।
৩. ছাত্রদের মধ্যে নানা প্রচার করা হয়। মন্ত্রীত্বশিকারী সরকারি গােয়েন্দা ও
অতি প্রগতিশীলরা আন্দোলনের নেতৃত্বের নানা রূপ উক্তি করিয়া ছাত্রদের মধ্যে দলাদলি সৃষ্টি করিয়া ছাত্রদের ঐক্যের মূলে কুঠারঘাত ও নৈরাশ্যের মধ্যে ফেলিয়া দেয়। ৪৮ সাল হইতে ৫২ সাল : ১৯৪৮ সাল হইতে ১৯৫২ সালের মধ্যে ভাষা লইয়া আর কি কোন আন্দোলন হয় নাই। ১৯৫২ সনের আন্দোলনের মূলে ছিল। বাংলাতে উর্দুকে সরকারি ভাষা শিক্ষার মাধ্যম করার সরল অপচেষ্টা। অ্যাসেম্বলিতে বাংলা এখানের সরকারি ভাষা ও শিক্ষার মাধ্যমে করার স্বীকৃতি দেওয়া তখন ছাত্রেরাও অনেকটা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। বৎসরান্তে ১১ মার্চ রাষ্ট্র ভাষা দিবস পালনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে।

সূত্র: ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ও দলিল – সাহিদা বেগম

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!