You dont have javascript enabled! Please enable it! 1952.03.03 | আন্দোলনে সরকারি আচরণ সমর্থন করে মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য | পাকিস্তান প্রচার বিভাগ - সংগ্রামের নোটবুক

ভাষা আন্দোলনের অন্তরালে
নূরুল আমীন

বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করার জন্য জনসাধারণের নিয়মতান্ত্রিক দাবি দমাইয়া রাখার প্রশ্নই উঠে না। ২১ শে ফেব্রুয়ারির মাত্র এক পক্ষকাল পূর্বে এই সম্পর্কে ঢাকায় এবং প্রদেশের অন্যান্য স্থানে সভা ও শােভাযাত্রা করা হয়। স্থানীয় কর্তৃপক্ষ তাহাতে কোনরূপ হস্তক্ষেপ করেন নাই। কিন্তু রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নটি আসল প্রশ্ন নয়, ইহার পশ্চাতে সরকারকে বানচাল করার জন্য বিদেশী দালাল ও অন্যান্যদের ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র নিহিত আছে। আইন আইন অমান্যের উদ্যোক্তাদের যদি ভাষার দাবি প্রতিষ্ঠা করা ছাড়া অন্য উদ্দেশ্য না থাকিত তবে ব্যবস্থা পরিষদে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার জন্য গণপরিষদের নিকট সুপারিশ করিয়া প্রস্তাব গৃহীত হওয়াতেই তাহারা সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট হইত।
কিন্তু আমরা কি দেখিলাম…
গত ৩রা মার্চ রাত্রে পাকিস্তান রেডিওর ঢাকা হইতে জনসাধারণের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত প্রধানমন্ত্রী জনাব নূরুল আমীনের বেতার বক্তৃতা :
দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে আজ আপনাদের উদ্দেশে কয়েকটি কথা বলিতেছি। ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে ঢাকায় যেসব ঘটনা ঘটিয়াছে তাহাতে আমি অত্যন্ত ব্যথিত ও মর্মাহত হইয়াছি। আমি আপনাদেরই একজন, আপনারাই আমাকে একজন খাদেম হিসেবে আপনাদের খেদমত করার সুযোেগ ও গৌরব দিয়াছেন। আমার বিবেকবুদ্ধি মতে আমার সাধ্যমতাে আপনাদের খেদমত করাই আমার কর্তব্য। এই কথা হয়তাে না বলিলেও চলে যে, প্রত্যেক পাকিস্তানির জীবন— সে ছাত্রই হউক বা অন্য কেউ হউক আপনাদের কাছে যেমন প্রিয় আমার কাছে ঠিক তেমনি প্রিয়। প্রত্যেকটি পাকিস্তানির জীবন পাকিস্তানের জাতীয় সম্পদ, তাই ঢাকায় দুর্ঘটনায় যে পাঁচজনের জীবন নাশ হইয়াছে তাহাতে আমি জাতীয় ও আমার ব্যক্তিগত ক্ষতি বলিয়াই মনে করি। ঢাকার সাম্প্রতিক দুর্ঘটনার যাহারা ভুক্তভােগী তাহাদের প্রতি আমার আন্তরিক সমবেদনা জ্ঞাপন করিতেছি। যদি পূর্বেই বলিয়াছি যে, ঢাকার গুলী চালানাে সংক্রান্ত ঘটনাবলী যথাসময়ে প্রকাশিত হইবে এবং এ সম্পর্কে কেহ দোষী সাব্যস্ত হইলে তাহার বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা অবলম্বন করা হইবে।
যেহেতু অবস্থা ক্রমেই স্বাভাবিক হইয়া আসিতেছে এবং গত কয়দিনের ঘটনার স্থানে যে উত্তেজনার সৃষ্টি হইয়াছিল তাহা ক্রমেই প্রকাশিত হইতেছে, এখন এ বিষয়ে ধীর স্থিরভাবে চিন্তা করিবার সময় আসিয়াছে। রাষ্ট্রের স্বার্থে আমার আগের বক্তৃতায় আপনাদের কাছে অনেক কিছুই খুলিয়া বলিতে পারি নাই। এখন আরও কিছু তথ্য প্রকাশ করিতে চাই এবং তাহা হইতে আপনারা সহজেই বুঝিতে পারিবেন যে, সরকার এমন এক পরিস্থিতির সম্মুখীন হইয়াছিলেন যেখানে কঠোর ব্যবস্থা অবলম্বন করা ছাড়া আর গত্যন্তর ছিল না। কম্যুনিস্ট, বিদেশী চর এবং হতাশ রাজনৈতিকদের ধ্বংসাত্মক চক্রান্ত অংকুরেই বিনষ্ট হইয়াছে। এই চক্রান্তের মাধ্যমে টেলিফোন ও টেলিগ্রাফ ব্যবস্থা এবং ট্রেন চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি করা হয়। পরিশেষে রাষ্ট্রের নিরাপত্তার খাতিরে বাধ্য হইয়া সরকার কঠোর ব্যবস্থা অবলম্বন করিতে বদ্ধপরিকর হন। সুতরাং বিত্তশালী ব্যক্তিগণের নিকট ইহা সুস্পষ্ট হইয়া উঠে যে, বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্র ভাষা করা প্রকৃত প্রশ্ন মােটেই ছিল না, বরং সরকার একদল লােককে দেশের শান্তি, শৃঙ্খলা বিপন্ন করিতে দিবেন কিনা তাহাই ছিল সত্যিকারের প্রশ্ন। এমতাবস্থায় সরকারের কি করা উচিত ছিল তাহাই বিবেচ্য। এইরূপ হীন ষড়যন্ত্রের সম্মুখীন হইয়া পৃথিবীর কোনাে দায়িত্বশীল সরকার কি ব্যবস্থা অবলম্বন করিতেন? অতি নগন্য সংখ্যক লােক জনগণের প্রতিনিধি ব্যবস্থা পরিষদের মজলিশ সদস্যদিগকে ভয় দেখাইয়া বাধ্য করা। এবং এইভাবে মুসলিম লীগ সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করিয়া নিজে বা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হইবার জন্য চেষ্টায় অবতীর্ণ হইয়াছিল। ইহা ঘটিতে দিলে আমরা জনসাধারণের নিকট বিশ্বাস ভঙ্গের অপরাধে দোষী হইতাম। যদি দৃঢ়তার সঙ্গে এই অরাজকতা দমনে আমি ও আমার সহকর্মীগণ অগ্রসর হইতে না পারিতাম, তাহা হইলে জনগণ ও ইসলামের প্রতি কর্তব্য সম্পাদনের আমরা আপনাদের সামনেও আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের সামনে নিশ্চয়ই অপরাধী সাব্যস্ত হইতাম। নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে সরকারের পতন ঘটান যাইতে পারে। কেবলমাত্র আইন সভার সদস্যগণই নিজেদের স্বাধীন ইচ্ছায় ভােট দিয়া সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করিতে পারেন। আইনসভার সদস্যগণ যাহাতে ধীর স্থির ও স্বাধীনভাবে এই ব্যাপারে নিজেদের মতামত প্রকাশ করিতে পারেন, তাহার জন্য এমন পরিবেশ সৃষ্টির প্রয়ােজন যেন সর্বপ্রকার ভয়ভীতির বাহিরে থাকিয়া তাহারা কাজ করিতে পারেন। এইরূপ পরিবেশ সৃষ্টি না হইলে গণতান্ত্রিকতার বিলােপ হইয়া উচ্ছংখল জনতার শাসনই কায়েম হয়। ভয় দেখাইয়া ও উচ্ছংখলতার সৃষ্টি করিয়া দেশের শান্তি শৃংখলা বিপন্ন করিবার এই যে ষড়যন্ত্র হইয়াছিল, সরকারের অবলম্বিত ব্যবস্থার কলে যদিও সাময়িকভাবে যে বিপদের অবসান হইয়াছে তথাপি আমাদের আজাদীর বিরুদ্ধে যে বিপদ দেখা দিয়াছিল এখনও তাহা সম্পূর্ণরূপে দূরীভূত হয় নাই। প্রদেশের শান্তি ও নিরাপত্তা যেমন করিয়াই হউক আমাদিগকে রক্ষা করিতে হইবে। আমি আশা করি এই ব্যাপারে সরকার দেশপ্রেমিক সকল পাকিস্তানিরই পূর্ণ সমর্থন পাইবেন। আমি সকল পাকিস্তানির কাছে আবেদন করিতেছি, সরকারের হাত মজবুত করিতে আগাইয়া আসুন, সমগ্র প্রদেশে আইন ও শৃঙ্খলা অব্যাহত রাখিতে সরকারকে সাহায্য করুন— দুষ্কৃতকারীদের আতংক সৃষ্টি, মিথ্যা গুজন প্রচারণা এবং জনসাধারণের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি প্রয়াস ব্যর্থ করুন।

ইসলামের আদর্শ
দেশবাসীর খেদমতে আমার আরও আরজ, আপনারা সীমান্তের ওপারে একবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করুন, উপলব্ধি করিতে চেষ্টা করুন বর্তমানে আমরা কি সঙ্কটের সম্মুখীন হইয়াছি। শুধু পাকিস্তান নয় বরং ইসলামই আজ নিদারুণ সংকটের সম্মুখীন। আমরা দাবি করিয়া থাকি, জাতিগত, ভৌগােলিক, অর্থনৈতিক ও ভাষাগত ব্যবধান দূর করিয়া ইসলাম একদিন যে স্বর্ণযুগের সূচনা করিয়াছিল, বর্তমানেও ইসলাম তাহা করিতে সক্ষম যাহার ফলে মানব জাতির জীবনে আসিবে অশেষ সুখ-সমৃদ্ধি ও শান্তি। আমরা পাকিস্তানে ইসলামের এই আদর্শই বাস্তবে রূপায়িত করতে চাই। লক্ষ লক্ষ লােকের ত্যাগের বিনিময়ে আমরা পাকিস্তান হাসিল করিয়াছি শুধু মাত্র ইসলামকে কায়েম রাখিবার জন্যই। বিভিন্ন জাতি ও বিভিন্ন ভাষাভাষী লােক অদ্যাবধি ভৌগােলিক বৈচিত্র্যপূর্ণ আমাদের এই পাকিস্তানের বিভিন্ন অংশকে ইসলাম এক সূত্রে গ্রথিত করিয়া রাখিয়াছে। আমাদের সংহতি ও সংঘবদ্ধতা শত্রু-মিত্র সকলকেই বিস্মিত করিয়াছে। পাকিস্তান সমগ্র মুসলিম জাহানে নবজীবন আনয়ন করিছে এবং সর্বত্রই ইসলামের এই নবজীবন স্পন্দন অনুভূত হইতেছে। দুনিয়ার নিকট আমাদিগকে প্রতিপন্ন করিতে হইবে যে, যদিও আমাদের পথ প্রদর্শন করার জন্য কায়েদে আযম ও কায়েদে মিল্লাত আজ আর নাই, তথাপি ইসলাম আমাদের ঐক্যবদ্ধ রাখিয়া, আমাদিগকে সমৃদ্ধির পথে পরিচারিত করিতে সক্ষম। এই ব্যাপারে আমাদের দায়িত্বই বেশি। কারণ, এখানে যত মুসলমানের বাস দুনিয়ার আর কোথাও এক জায়গায় এত মুসলমান বাস করে না। সুতরাং বিশ্ব মুসলিমের সংহতি রাখার দায়িত্ব বিশেষভাবে আমাদেরই। মুসলিম জাহানের এই সংকট মুহূর্তে আমরা কি পাকিস্তান ও ইসলামের প্রতি এই গুরুদায়িত্ব পালনে অসমর্থ হইব? পাকিস্তানের ও মুসলিম জাহানের প্রতি আমাদের পবিত্র কর্তব্য সম্পাদনে আমরা কোনাে দিনই পশ্চাৎপদ হইব না।

পাকিস্তান জিন্দাবাদ*
(পূর্ব পাকিস্তানের উজীরে আলা জনাব নূরুল আমীনের বেতার বক্তৃতা। ৩রা মার্চ ১৯৫২)
নূরুল আমীনের বেতার-বক্তৃতা-১
২৪ শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২ রাত্রে পূর্ববঙ্গের প্রধানমন্ত্রী নূরুল আমীন ঢাকা বেতারকেন্দ্রে থেকে বক্তৃতা করে পরিস্থিতি সম্পর্কে সরকারি ব্যাখ্যা প্রদান করেন। বক্তৃতাটি পরে প্রচারপত্র আকারে ছেপে বিলি করা হয়। প্রচারপত্রে তাঁর বক্তৃতাটি ছিল এরকম:
‘গত তিন চার দিন যাবত ঢাকা শহরে কয়েকটি অবাঞ্ছিত ও দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছে যার ফলে জনসাধারণের মধ্যে ভুল ধারণার সৃষ্টি হয়েছে। এ সম্পর্কে আপনাদের কাছে পরিষ্কারভাবে আমি কিছু বলা দরকার বলে মনে করছি।
……………………………………………………………………………
* ভাষণটি ‘মাহেনও’-এর ৪র্থ বর্ষ, ১ম সংখ্যা, এপ্রিল, ১৯৫২ থেকে উদ্ধৃত।
……………………………………………………………………………

আজ ঢাকা শহরে কোনাে দুর্ঘটনা ঘটেনি।
এযাবত প্রেসনােটে কেবলমাত্র ঢাকা শহরে শান্তি ও শৃঙ্খলা নষ্ট করার যে সকল প্রচেষ্টা হয়েছে এবং এর ফলে যে সকল ক্ষতি হয়েছে ও সরকার যে সকল ব্যবস্থা নিয়েছেন কেবলমাত্র তাই উল্লেখ করা হয়েছে। ১৪৪ ধারা জারি করার কারণ ও যৌক্তিকতা সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করা হচ্ছে। এরূপ অভিযােগ করা হয়েছে যে, ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষারূপে বাংলার দাবিকে দমন করার জন্য। এ সকল অভিযােগ সাধারণত কলিকাতার খবরের কাগজগুলােতে করা হয়। এ কাগজগুলাে সব সময়েই এ প্রদেশের জনসাধারণের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা করে। এবার উপরােক্ত প্রচেষ্টা ঢাকার কোনাে কোনাে মহল হইতেও করা হচ্ছে। শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য যে সকল কার্যকরী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে সে সম্পর্কেও উত্তেজনামূলক মিথ্যা প্রচারণাপূর্ণ বিবৃতি দেয়া হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে যে, ঢাকার কোনাে কোনাে দৈনিক কাগজে এ মর্মে খবর প্রকাশিত হয়েছে য, গত শুক্রবার সামরিক বাহিনী নিরীহ লােকদের উপর গুলী ছেড়ে, বেয়নেট চার্জ করে এবং লুটপাট করে। এ খবর সম্পূর্ণ মিথ্যা।
যানবাহন চলাচল বন্ধ, দোকানদারদিগকে হরতাল পালন করার অনুরােধ বা হুমকি এবং সরকারি ও বেসরকারি অফিসসমূহের কর্মচারীদের কাজে যোেগ দানে বাধা দেয়ার প্রচেষ্টাকে সরকার এযাবত মনে করেছেন যে, যে সকল ছাত্র বা ব্যক্তি হাঙ্গামার ফলে নিহত বা আহত হয়েছেন তাদের প্রতি জনসাধারণের সমবেদনা প্রদর্শন। সেজন্য সরকার মিথ্যা অভিযােগ সম্পর্কে কোনাে প্রকার গুরুত্ব দেয়া সঙ্গত মনে করেননি, উপরন্তু সরকার আশা করেছিলেন যে, গত বৃহস্পতিবার থেকে যে সকল ঘটনা ঘটেছে কেবলমাত্রতার পূর্ণ বিবরণ প্রকাশ দ্বারাই ১৪৪ ধারা জারি এবং শান্তি রক্ষার জন্য যাবতীয় ব্যবস্থার কারণ ও যুক্তি জনসাধারণের নিকট সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে।
কিন্তু তার পরবর্তী ঘটনাবলী থেকে এখন একথা বলা প্রয়ােজন হয়েছে যে, গত কয়েক দিনের হাঙ্গামা ও হাঙ্গামার ধারা এবং যারা এই হাঙ্গামার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে ও উস্কানি দিয়ে চলেছে তাদের প্রকৃত রূপ ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে আরও অধিক তথ্যাদি জানানাে আমার কর্তব্য।
বাংলা ভাষার আন্দোলন সম্পর্কে জনমতের কণ্ঠরােধ করার উদ্দেশ্যে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে বলে যে অভিযােগ করা হয়েছে তাহা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। ১৪৪ ধারা জারি করার সিদ্ধান্তের সঙ্গে ভাষার প্রশ্নের কোনাে সম্পর্ক নেই। প্রাদেশিক আইনসভার প্রথম অধিবেশনের দিক থেকে শেষ দিন পর্যন্ত শহরে শান্তি ও শৃঙ্খলা বন্ধের উদ্দেশ্যে ছাত্রদের ভাষা-আন্দোলনের সুযােগ নিয়ে কতিপয় সুবিধাবাদী ও বিভেদসৃষ্টিকারী যে পরিকল্পনা নিয়েছিল, তার উপযুক্ত প্রমাণ পেয়ে সাবধানতা অবলম্বনের জন্যই জেলা কর্তৃপক্ষ ১৪৪ ধারা জারি করেছিলেন। জেলা কর্তৃপক্ষ যাতে শান্তি ও শৃঙ্খলাভঙ্গের যে কোনাে প্রকার হুমকির মােকাবেলা করতে পারেন কেবলমাত্র সেজন্যই এই আদেশ জারির দরকার হয়েছিল। ভাষা প্রশ্ন বা অন্য কোনাে বিষয় সম্পর্কে জনমতকে দমন করার কোনাে উদ্দেশ্য বা ইচ্ছা সরকারের ছিল না। এ কথাগলাে যে সত্য তা প্রমাণিত হবে এই একটি বিষয় দ্বারা যে কেবলমাত্র পনের দিন আগে ঢাকা এবং প্রদেশের অন্যান্য জায়গায় বাংলা ভাষা সম্পর্কে মিছিল বার করা এবং সভা করায় সরকার কোনাে প্রকার বাধা দেননি।।
১৪৪ ধারা জারি করার পর থেকে যে পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে তা একথাই প্রমাণ করেছে যে, ভাষার প্রশ্ন না থাকলেও শান্তি এবং শৃঙ্খলাভঙ্গের জন্য সুপরিকল্পিত চেষ্টা চলত। জনসাধারণ যে দু’টি বিষয় জানেন, এখানে আমি তা উল্লেখ করলেই আমার আগেকার বক্তব্যের সত্যতা প্রমাণিত হবে- বিষয় দুটির প্রথমটি হলাে এই যে, ১৪৪ ধারা জারি দ্বারা মিছিল বা জনসভা বন্ধ করা হয়নি। ঐ আদেশে এ-কথাই বলা হয়েছিল যে, জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ নিয়ে মিছিল ও জনসভা করতে হবে। যারা মিছিল বা জনসভা করে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করা সম্পর্কে তাদের মতামত দিতে চেয়েছিলেন, তাঁদের জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি পেতে কোনাে বাধা ছিল না। কিন্তু তারা কেউই অনুমতি চাননি।
দ্বিতীয়ত, পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদ বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার সুপারিশ করা সত্ত্বেও শান্তি এবং শৃঙ্খলাভঙ্গের জন্য ছাত্রবৃন্দ ও জনসধারণকে সুপরিকল্পিতভাবে উস্কানি ও প্ররােচনা দেয়া হচ্ছে। এ সকল ঘটনা এবং এর পদ্ধতি থেকে এটুকু সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে, যে, যারা এ প্ররােচনা ও উস্কানি দিচ্ছে। তাদের আদত উদ্দেশ্যে ব্যাপকভাবে অরাজকতা ও অশান্তির সৃষ্টি করা-রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নকে টানা হয়েছিল শুধু ছাত্রদের ও জনসাধারণের সহযােগিতা পাবার জন্য। এসকল পদ্ধতি ও ধারার কয়েকটি উদাহরণ এখানে দেয়া যেতে পারে।
ঢাকার ঘটনাবলী সম্পর্কে মিথ্যা ও উত্তেজনামূলক গুজব শহরে এবং শহরের বাইরে সারা দেশে ব্যাপকভাবে ছড়ানাে হচ্ছে। যারা আইনভঙ্গ ও শান্তি নষ্ট করতে চায়, তারা মুসলিম লীগ এম, এল, এ, এবং খবরের কাগজের অফিসের কর্মচারীদের হুমকি ও শাসানি দিচ্ছে, নিজেদের দুরভিসন্ধিতে সহায়তা করার জন্য। সাধারণ শাসনকার্য চালানাের কাজেও বাধা দেয়া হচ্ছে। ছাত্রদের বিভ্রান্ত করার উদ্দেশ্যে প্রত্যেকটি ঘটনার অপব্যাখ্যা করা হচ্ছে। ছাত্রদের মধ্যে বেশির ভাগই ভুলবশত মনে করছেন যে, এই দুতিকারীরা জাতির মহান কাজে নেমেছে। আইনভঙ্গ করার জন্য ছাত্রদিগকে ক্রমাগত চাপ দেয়া হচ্ছে। প্রদেশের অন্যান্য স্থানেও লােক পাঠানাে হচ্ছে আইনভঙ্গ করার কাজে উস্কানি দেয়ার জন্য।
আমি এখন আপনাদের কাছে যে ঘটনাবলী ও তথ্য খুলে বললাম, সেগুলাে এবং আরও অন্যান্য অনেক তথ্য সরকারের নিকট আছে, যাতে দৃঢ়ভাবে বলা যেতে পারে যে, আপাতদৃষ্টিতে বাইরে থেকে যা দেখা যাচ্ছে প্রকৃত পরিকল্পনা তার চেয়ে অনেকাংশে ও বহুগুণে মারাত্মক। এই মারাত্মক পরিকল্পনার যারা প্রণেতা, তারা পাকিস্তানের বাইরে থেকে সহায়তা এবং অনুপ্রেরণা পাচ্ছে। এরপ অবস্থায় পাকিস্তানের স্থায়িত্ব নষ্ট করার এইসকল মারাত্মক কার্যকলাপ বন্ধ করতে এবং দুষ্ট পরিকল্পনা করতে হবে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে, সরকার এইসকল দৃঢ় ব্যবস্থা অবলম্বনের কাজে পাকিস্তানের মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী ও শান্তিকামী প্রতিটি নাগরিকের পূর্ণ সমর্থন ও সহায়তা লাভ করেন।
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ফলে উদ্ভূত সংকটজনক পরিস্থিতিতে সমঝােতার পথে না গিয়ে প্রাদেশিক মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির নেতা এবং পূর্ববাংলায় মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমীন ২৪ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যাবেলায় এক বেতার ভাষণে পরিস্থিতির জন্য আন্দোলনকারীদের দায়ী করেন। তাঁর এ ভাষণের ফলে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশার জন্ম নেয় যার সুদূরপ্রসারী প্রভাব রয়েছে পরবর্তী রাজনীতিতে। বেতার ভাষণে তিনি বলেন : | ‘আজ ঢাকায় কোন ঘটনা দুর্ঘটনা হয়নি। ঢাকার শৃঙ্খলা বিনষ্ট করিবার যে চেষ্টা হইয়াছে এবং ইহার ফলে যে ঘটনা দুর্ঘটনা হইয়াছে ও সরকার যে ব্যবস্থা অবলম্বন করিয়াছেন, সরকারি ইশতেহারে এ যাবৎ তাহার সত্য বিবরণই প্রকাশ করা হইয়াছে। ১৪৪ ধারা জারির যৌক্তিকতা খােলাখুলিভাবেই প্রকাশ করা হইয়াছে। কলিকাতার সংবাদপত্রে সাধারণত দেশের জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করিবার চেষ্টাই করা হইয়া থাকে; কিন্তু শুধু কলিকাতার সংবাদপত্রে নয়, ঢাকায়ও কোনাে কোনাে মহলে বলা হইয়াছে যে, বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করিবার জন্য যে দাবি উত্থাপন করা হইয়াছে তাহার কণ্ঠরােধ করা হইয়াছে, তৎসম্পর্কেও কতিপয় উত্তেজনাকর এবং বস্তুতপক্ষে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন বিবৃতি দেওয়া হইয়াছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, স্থানীয় সংবাদপত্রে বলা হইয়াছে, শুক্রবার সেনাবাহিনী নিরপরাধ জনসাধারণের উপর গুলিবর্ষণ করে, কয়েকজনকে বেয়নেট দ্বারা ঘায়েল করে এবং লুটতরাজে যােগদান করে। এই বিবরণী সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।
গােলযােগের ফলে, দুর্ভাগ্যক্রমে যাহারা আহত ও নিহত হইয়াছেন, তাঁহাদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করিবার জন্য যানবাহন অচল করিয়া দেওয়ার, দোকানদারদিগকে হরতাল পালনের জন্য প্ররােচিত বা বাধ্য করার এবং সরকারি কর্মচারীদিগকে কাজে যােগদান হইতে বিরত রাখার চেষ্টা করা হয় বলিয়া সরকার হৃদয়ঙ্গম করিয়াছেন। কাজেই এ সম্পর্কে আলােচনা করা প্রয়ােজন বলিয়া সরকার মনে করেন এবং আশা করেন যে, গত বৃহস্পতিবার হইতে যে সকল ঘটনা ঘটিয়াছে, তাহাদের শুধুমাত্র বিবরণ দান করিলেই শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য সরকার ১৪৪ ধারা জারি করাসহ যে সকল সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করিয়াছিলেন জনসাধারণ তাহার যৌক্তিকতা হৃদয়ঙ্গম করিতে পারিবেন। | গত বৃহস্পতিবার হইতে যে পরিস্থিতির উদ্ভব হইয়াছে, তাহাতে দেখা যায় এই ঘটনার তাৎপর্য সম্পর্কিত আরও অধিক তথ্য উদঘাটন এবং যাহারা উহার প্ররােচনাদান করিতেছিল, অথবা উহার পরিকল্পনা করিতেছিল তাহাদের উদ্দেশ্য অনুধাবন করা একান্ত প্রয়ােজন।
ভাষা সমস্যা সম্পর্কে জনমত চাপা দেওয়ার অভিপ্রায়ে ১৪৪ ধারা জারি করা হইয়াছিল বলিয়া যে অভিযােগ করা হইতেছে, তাহা সম্পূর্ণভাবে ভিত্তিহীন। ১৪৪ ধারা জারি করার সহিত ভাষা সমস্যার কোনাে সম্পর্ক নাই। একদল স্বার্থন্বেষী লােক প্রাদেশিক আইন পরিষদ অধিবেশন আরম্ভের দিন এবং যতদিন উহার অধিবেশন চলিবে ততদিন শৃঙ্খলা বিনষ্ট করার পরিকল্পনা করিয়াছে বরিয়া সুস্পষ্ট প্রমাণ পাইয়া জেলা কর্তৃপক্ষ সতর্কতা হিসেবে ১৪৪ ধারা জারি করার সিদ্ধান্ত করেন। আইন ও শৃঙ্খলা ভঙ্গ করার সকল প্রয়াসের মােকাবেলা করার জন্য জেলা কর্তৃপক্ষ এই নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। সরকার আইন ও শৃঙ্খলা ভঙ্গ করার পরিকল্পনার কথা জানিতে পারিয়াছিলেন। ভাষা বা অন্য যে কোনাে প্রশ্ন সম্পর্কে নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে জনমত প্রকাশে বাধা দানের কোনাে অভিপ্রায়ই ছিল না। একপক্ষের অধিককাল পূর্বে সরকার কোনাে প্রকার হস্তক্ষেপ করেন নাই। ভাষার প্রশ্নের ঢাকা ও ঢাকার বাহিরে মিছিল বাহির করিতে এবং সভা ও শােভাযাত্রার অনুমতি দান করিয়াছিল। তাহা হইতেই এই উক্তির সথ্যতা সুস্পষ্ট হইয়া উঠিবে। ভাষা আন্দোলনের যে একটা ধ্বংসাত্মক ঘড়যন্ত্র করা হইয়াছিল ১৪৪ ধারা জারি করার পরবর্তী ঘটনা পরিস্থিতিই তাহার প্রমাণ। এ যুক্তির সমর্থনে দুইটি বিষয় উল্লেখ করা যাইতে পারে। প্রথমত শােভাযাত্রা ও জনসভার অনুষ্ঠান করা যাইতে পারিবে। ভাষার প্রশ্ন সম্পর্কে মতামত ব্যক্ত করার উদ্দেশ্যে জনসভার অনুষ্ঠান করা অথবা শােভাযাত্রা বাহির করিবার যদি তাহাদের ইচ্ছা ছিল তবে তাহার জন্য এই অনুমতি লওয়ার পথে কোনাে বাধাই ছিল না। কিন্তু তাহারা কখনও এরূপ করে নাই। দ্বিতীয়ত : বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়ার জন্য প্রাদেশিক সরকারের সােপারেশ সত্ত্বেও এখনও দৃঢ়তার সহিত ছাত্র ও জনসাধারণকে হিংসাত্মক কাজে উত্তেজিত করার ও আইন ভঙ্গের জন্য সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টা চলিতেছে। এই সকল যুক্তি এবং হাঙ্গামাকারীদের কার্যকলাপ হইতে নিঃসন্দেহে ইহাই প্রতিপন্ন হয় যে, ভীষণ রকমের কোনাে একটা বিপর্যয় সৃষ্টি করাই ছিল তাহাদের প্রধান মতলব : শুধু জনসাধারণের সহানুভূতি লাভের জন্যই তাহারা ইহার সহিত ভাষার প্রশ্নযােগ করে ঢাকার সাম্প্রতিক ঘটনাবলী সম্পর্কে মিথ্যা ও ভীষণ উত্তেজনামুলক গুজব শুধু ঢাকা শহরেই প্রচার করা হইতেছে না। সমস্ত প্রদেশেই ইহা ছড়ানাে হইতেছে। আইন ভঙ্গকারীদের সমর্থন জানানাের জন্য মােছলেম লীগ এম.এল.এ.গণকে এবং স্থানীয় ছাত্রমহলকে উত্তেজিত করার জন্য প্রতি মুহূর্তে সুযােগ গ্রহণ করা হইতেছে। তাহাদিগকে এই বলিয়া উৎসাহিত করা হইতেছে যে, ইহা তাহাদের জাতীয় আন্দোলন। আইন ভঙ্গের জন্য তাহাদিগকে চাপ দেওয়া হইতেছে। অনুরূপ প্রচেষ্টার জন্য প্রদেশের বিভিন্ন স্থানেও তাহারা দল প্রেরণ করিতেছে।
উল্লিখিত ঘটনাগুলাে এবং সরকারের হাতে যেসমস্ত প্রমাণ রহিয়াছে তাহাতে ইহাই প্রতিপন্ন হয় যে, এই ষড়যন্ত্রের মূলে গভীর উদ্দেশ্য রহিয়াছে এবং ষড়যন্ত্রের নেতাগণ পাকিস্তানের বাহির হইতে উৎসাহ পাইতেছে। এমতাবস্থায় এই সকল ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করিয়া রাষ্ট্রের নিরাপত্তা রক্ষা করার জন্য ব্যবস্থা অবলম্বন করিতে সরকার কখনও ইতস্তত করিবে না। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, পাকিস্তানের শুভার্থীগণও এই কাজে সম্পূর্ণরূপে সহায়তা করিবেন।

সূত্র: পাকিস্তান প্রচার বিভাগ ৩রা মার্চ, ১৯৫২