ভাষা আন্দোলন ও তমদুন মজলিশ
১৯৪৮ সাল : ভাষা আন্দোলনের সহিত যাহারা জড়িত আছেন, তাহারা একবাক্যে স্বীকার করিবেন— ভাষা আন্দোলনের জন্ম দেয় তমদুন মজলিশ। ১৯৪৮ সালের আন্দোলন পর্যন্ত ইহার বৈজ্ঞানিক নেতৃত্বই এই আন্দোলনকে জনপ্রিয় করিয়া তােলে এবং ঐ সালের আন্দোলনকে অসাধারণ সাফল্য দান করে।
১৯৫২ সাল: ১৯৫২ সালের আন্দোলনে ও তমদুন মজলিশের দান অপুরণীয়। সংগ্রাম পরিষদে তমদুন মজলিশের সম্পাদক ও কর্মিরা নেতৃত্ব দিয়া নানাভাবে সাহায্য করে। বিভিন্ন হলে, কলেজে ও স্কুলে এই প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের কর্মিদের সঙ্গে মিলিয়া ইহাকে জোরালাে করিয়া তােলে। মজলিশ কর্মিদের দ্বারা পরিচালিত ‘সৈনিক’ ভাষা আন্দোলনে সাংবাদিকতার নেতৃত্ব দয়াছে বলা হয়।
মফঃস্বল : মফঃস্বলে অধিকাংশ স্থানে এবার মজলিশের নেতৃত্বেই ভাষা আন্দোলনে হইয়াছে। সমগ্র কুষ্টিয়া জেলা মজলিশের নেতৃত্বেই ভাষা আন্দোলনে আগাইয়া যায়। তমদুন মজলিশের কর্মি জনাব আবদুল হকই জেলা সংগ্রাম পরিষদের কনভেনার হন। রংপুর কর্ম পরিষদের কনভেনার হন মজলিশ কর্মি অধ্যাপক গােলাম আযম সাহেব। ফরিদপুর জেলা ও তমদুন মজলিশের নেতৃত্ব গ্রহণ করে তমদুন মজলিশের সেক্রেটারিই জেলা সংগ্রাম পরিষদের কনভেনার নির্বাচিত হন। এ ছাড়া সিরাজগঞ্জ, জামালপুর, ফেনী, রাজবাড়ি বাগেরহাট, নােয়াখালী, নেত্রকোণা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, মুন্সীগঞ্জ, প্রভৃতি স্থানেও মজলিশের নেতৃত্ব ও প্রচেষ্টায় আন্দোলন গড়িয়া ওঠে। প্রায় সব সমাজে মজলিশ কর্মিরা। কনভেনার নিযুক্ত হন। রাজশাহীতে সর্বপ্রথম পাবলিক মিটিং করে তমদুন মজলিশ। তাহা ছাড়া পাবনা, চট্টগ্রাম, সিলেট, কুমিল্লা, বরিশাল, মােমেনশাহী, বগুড়া প্রতি জেলায় তমুদুন মজলিশ কর্মিরা, আওয়ামীলীগ, ছাত্রলীগ প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের সহযােগিতায় নিঃস্বার্থভাবে কাজ করিতে থাকে মজলিস সম্পাদক জনাব আবদুল গফুর।
সরকারি রােষে মজলিশ কর্মী:
এজন্য মজলিশ কর্মীদিগকে নানা সরকারি রােষের কবলে পড়িতে হয়। ফেনীর বিখ্যাত মজলিশ কর্মী ফরমানউল্লা খানকে প্রথম দিকে গ্রেপ্তার করা হয়। জেলে যাওয়ার সময় তাহাকে হাজার হাজার ছাত্র ও জনসাধারণ অভিনন্দন জানায়। রংপুর মজলিশের সম্পাদক অধ্যাপক জমিরুদ্দিন সাহেব এবং জেলা সংগ্রাম পরিষদের কনভেনার অধ্যাপক গােলাম আযম গ্রেপ্তার হন। তাহাদিগকেও ছাত্র ও জনসাধারণ বিপুলভাবে সম্বর্ধিত করে। এছাড়া ময়মনসিংহের ও জামালপুরের বহু নামকরা মজলিশ কর্মী গ্রেপ্তার হয়। মজলিশের সাধারণ সম্পাদক আবদুল গফুর সাহেব ও অধ্যাপক আবুল কাসেম সাহেবকে গ্রেপ্তার করার জন্য রাত্রি তিনটার। সময় ১৯ নং আজিমপুর পুলিশ ঘেরাও করিয়া ফেলে। তারা দুই জনই প্রায় দুই মাস মফঃস্বলে আত্মগােপন করিয়া থাকিতে বাধ্য হন। সৈনিক ও মজলিশ অফিস এবং মফঃস্বলে ও বিভিন্ন শাখা অফিসেও বহুবার খানাতল্লাসী হয়।
দেওয়ালের লেখা পড়ে দেখার সময় :
জাগ্রত ছাত্র ও জনসাধারণ শহিদদের আত্মত্যাগ ব্যর্থ হতে দেবে না আজ সারা দেশব্যাপী শহীদ দিবস উদ্যাপিত হতে যাচ্ছে। শহীদ দিবস উদ্যাপন করিতে গিয়ে এক বছর আগেকার রক্তাক্ত দিনের বেদনা বিধুর স্মৃতি মনের কোণে ভীড় করছে। গত বছর এমনি দিনে মাতৃভাষার দাবিকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে দেশের শ্রেষ্ঠ কয়েকজন তরুণ তাদের মূল্যবান জীবনকে উৎসর্গ করেন। সেদিন তাঁদের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছিল দেশের প্রত্যেকটি সচেতন মানুষ। সারা দেশব্যাপী স্বৈরাচারী সরকারের দমন নীতির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে তারা মিলিত কণ্ঠে আওয়াজ তুলেছিল রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই- দমন নীতি চলবে না। সেদিন গণআন্দোলনের চাপে আমলাতান্ত্রিক সরকার বাধ্য হয়েছিল জনসাধারণের দাবি মেনে নিতে। ১৯৪৮ সালে যেমন নাজিম সরকার বাধ্য হয়েছিল জনসাধারণের কাছে ওয়াদা দিতে। কিন্তু আন্দোলন বন্ধ করার সঙ্গে সঙ্গেই সরকারি ষড়যন্ত্রের মুখােশ খসে পড়ল। নানা টাল বাহানা দিয়ে রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নকে ধাপাচাপা দেবার অপচেষ্টা শুরু হলাে। তার চরম প্রকাশ আমরা দেখতে পাই মূলনীতি কমিটির শেষ রিপাের্টে। গতবারের মতাে উর্দুই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে একথা বলার দুঃসাহস এবার তাদের না থাকলেও ভাষার প্রশ্নকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে যাবার মতাে বুদ্ধির পরিচয় দিতে তারা কসুর করেনি এমনি টালবাহানা করতে। আশ্বাস ও প্রতিজ্ঞা নেতাদের কাছে হতে বহুবার আমরা পেয়েছি কিন্তু তার কোনােটাই আজ পর্যন্ত কার্যকরী করার সদিচ্ছা দেখা যায়নি। রাষ্ট্রভাষার ব্যাপারেও যে একই কূটনীতির আশ্রয় নেয়া হয়েছে সে সম্পর্কে সন্দেহের কোনাে অবকাশ নেই।
সূত্র: ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ও দলিল – সাহিদা বেগম