You dont have javascript enabled! Please enable it! 1949.04.27 | পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি সত্যি ঠিক হয় নাই? | সৈনিক - সংগ্রামের নোটবুক

পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি সত্যি ঠিক হয় নাই?

পূর্ববঙ্গে বাধ্যতামূলকভাবে উর্দু চালু করা হইয়াছে কোন নীতিতে?
মন্ত্রীসাহেবদের একটা সীমা থাকে বলিয়া পূর্বে জানিতাম, কিন্তু আমাদের মন্ত্রীসাহেবেরা যা শুরু করিয়াছেন, তাহাতে আমাদের পূর্ব ধারণা ভুল প্রমাণিত হইতেছে। সকলেই জানেন, নাজিমুদ্দিন সাহেব শেষ বার যখন পূর্ব পাকিস্তানে আসেন তখন রাষ্ট্রভাষা সম্বন্ধে পূর্ব পাকিস্তানে প্রকাশ্যে কোনাে আন্দোলন হয়েছিল
সেদিনের বড় প্রশ্ন বিরােধী দলের সভা-সমিতির সরকারের প্রশ্ন, ব্যক্তি স্বাধীনতার রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে আমরা বস্তুত নীরব ছিলাম বলিয়া মন্ত্রী হয়তাে জানিলেন যে, আমরা ভাষার প্রশ্ন ভুলিয়াই গিয়াছি। এই সুযােগে বাজিমাৎ করিবার জন্য কিনা জানি না। তিনি ঘােষণা করলেন রাষ্ট্রভাষার প্রশ্ন? সে তাে হইয়াই আছে। (যেন পবিত্র স্থানে লেখা আছে এমনিভাবে)। কায়েদে আযমের ঘাড়ে হাত রাখিয়া তিনি গুলি মারিলেন ভাষা তাে হইবে উর্দু। ঢাকায় অবস্থান কালেই বুঝিলেন, তিনি ভুল করিয়াছেন। তওবা আসতাগফিরুল্লাহ পড়িতে তাঁহার দেরী হইল না। করাচী যাত্রার প্রাককালে সাংবাদিক সম্মেলন করিয়া বলিলেন রাষ্ট্রভাষা শুধু উর্দুই হইবে এমন কথা তাে তিনি বলেন নাই- ভাষা ঠিক করিবে গণপরিষদ। এ তাে মাত্র কায়েদে আযমের কথায় করিয়াছিলেন। যেন এ কোনাে উদ্দেশ্য লইয়া উত্থাপন করে নাই নিজেরই হঠাৎ কায়েদে আযমের ঐ ‘বিশেষ লাইন গুলাে মুখ দিয়া হঠাৎ মুখস্ত বাহির আছে। সে ইতিহাস রক্ত রঞ্জিত। ঢাকার রাজপথে পাকিস্তান সংগ্রামের বীর সৈনিক ছাত্র ও জনতার রক্তে রাঙিয়ে এ জন্য এককালে সারা পাকিস্তান প্রতিবাদ মুখর হইয়া উঠিল। মন্ত্রী সাহেবানরা প্রমাদ গুণিলেন। পূর্ববঙ্গ পরিষদে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার সুপারিশ করিয়া প্রস্তাব পাস হইল। প্রাদেশিক প্রধান মন্ত্রী নূরুল আমীন সাহেব এবং ঢাকা করাচী সরকারি মুখপত্র আশ্বাস দিতে লাগিলেন, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করিয়া লইতে কাহারাে আপত্তি নাই। তােমরা নিশ্চিন্ত হও। ইতিমধ্যে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে ঠাণ্ডা করিয়া দিবার জন্য শুরু হইল বেদম ধরপাকড় ভীতির রাজত্ব। অবশেষে গণপরিষদের অধিবেশন আসিল। এক আজব অজুহাত তুলিয়া আন্দোলনের আপাত নীরবতায় আশ্বস্ত হইয়া কিনা বলিতে পারি না বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রশ্ন আবার শিকায় তুলিয়া রাখা হইল। ঘটনা করিয়া প্রচার করা হইল: রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে তাে কোনাে সিদ্ধান্ত লওয়া হয় নাই, অতএব বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করিবার সময় তাে এখনাে আসে নাই। যথাসময়ে ইচ্ছা বিবেচনা করিলেই চলিবে। শুধু গণপরিষদে ইহা ৫২ করিয়াই মন্ত্রীরা ক্ষান্ত হন নাই। নাজিমুদ্দিন সাহেব পূর্ববাংলার সম্পাদকদের ডাকিয়া সভা করিয়া বুঝাইয়া দিলেন – এখনাে সময় আসে নাই। আলাদিনের চেরাগের মতাে কি হইয়া গেল বুঝিলাম না। চারিদিক হইতে ছােট বড় লীগ নেতৃবৃন্দ, নিমন্ত্রিত সম্পাদকবৃন্দ, সবাই একযােগে ‘রব’ তুলিলেন রাষ্ট্র ভাষা সম্পর্কে আলােচনার উপযুক্ত সময় এখনাে আসে নাই। কিন্তু না জনসাধারণকে আজ পরিষ্কার ভাষায় বুঝাইয়া দিবার সময় আসিয়াছে- ইহা স্পষ্ট ভাঁওতা মাত্র। বার বার রাষ্ট্রভাষার দাবিকে ধামাচাপা দিবার জন্য এই একই কথা। বলা হইয়াছে যে, এ সম্পর্কে এখনাে কোন সিদ্ধান্ত লওয়া হয় নাই। কিন্তু আজ আমরা জিজ্ঞাসা করিতে চাই রাষ্ট্রভাষা কি সত্যি ঠিক হয় নাই? যদি ঠিক না-ই হইয়া থাকে। তবে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিটি স্কুলে ক্লাস ফাইভ হইতে উর্দু বাধ্যতামূলকভাবে শিক্ষা দেওয়া হইতেছে কোন নীতিতে? রাষ্ট্রভাষা যদি কিছু ঠিক নাই হইয়া থাকে তবে উর্দুর মতাে একটা নতুন ভাষা আমাদের কোমলমতি ছাত্রদের ঘাড়ে চাপাইয়া দিবার কোনাে অধিকার সরকারের নাই। যদি বুঝিতাম উর্দু ও বাংলাভাষী জনসাধারণ পারস্পরিক সমঝােতার জন্যই এ ব্যবস্থা, তাহা হইলে আমাদের ইহাতে আপত্তি থাকি না কারণ তাহা ইহলে পশ্চিম পাকিস্তানেরও দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে বাংলাকে বাধ্যতামূলক করা হইত। কিন্তু এতাে তা নয়। পারস্পরিক সমঝােতার বহু আকাঙ্ক্ষিত পথ ইহা নয়— এ হইল এক ভাষার ললাকেদের দ্বারা অন্য ভাষার লােকেদের দাসত্ব করাইবার পথ, এক ভাষা-ভাষীর বিরুদ্ধে অন্য ভাষাভাষীকে লেলাইয়া দিবার পর্থ। এই পথ বিভেদ সৃষ্টির পথ। পাকিস্তানের মজলুম জনতা বিভেদ সৃষ্টিকারীদের এ ষড়যন্ত্র বরদাশত করিতে রাজী নয়।

(সৈনিকের ২৭শে (১৯৪৯) এপ্রিল সংখ্যা থেকে উদ্ধৃত)